গোসলের সময় হার্ট অ্যাটাক হলে কী করবেন?
হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক কি? কেন গোসল বা বাথরুমে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক ঘটে? গোসল বা গোসলের কোনো সঠিক নিয়ম আছে কি?

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক রুটিন কার্যক্রমের একটি হলো গোসল বা গোসল। দিনের শুরুটা অনেকেই গোসল দিয়ে করে আবার অনেকে দিনের শেষে। কারণ গোসল করলে শরীরের ক্লান্তি দুর হয়, রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় এবং সাথে সতেজ অনুভব হয়। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় এই গোসলের সময় অনেকেই স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। জাপানের কয়তো প্রিফ্যাকচুরাল ইউনিভার্সিটির চিকানিশিয়ামা ও তার সহকর্মীরা তাদের এক জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী; তাদের ২ বছরের গবেষণার সময়কালে প্রায় ১১০০০ হাজার রোগী হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছিল যাদের ২২% ঘুমের মধ্যে, ৯% গোসলের সময়, ৩% কাজের সময় এবং ০.৫% ব্যায়াম করার সময়।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে ব্যায়াম করা অবস্থার চেয়ে গোসলের সময় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঘটনা ঘটেছে। একই ভাবে গোসল বা গোসলের সময় স্ট্রোক হওয়ার ঝুকি থাকে। কানাডার মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্ট্রোক বা মিনি স্ট্রোকের কারণে যে ধরনের ঝুঁকির কথা আগে ধারণা করা হতো, প্রকৃতপক্ষে এই ঝুঁকি দীর্ঘস্থায়ী এবং আরও ভয়াবহ। বিশ্বের একাধিক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গোসলের সময় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। আর এই দুটি বিষয়ে বিস্তারিত যাওয়ার আগে এদের মধ্যে মুল যেই পার্থক্য আছে তা বুঝতে হবে। আমাদের অনেকেই আছে যারা ভুল করে বলে থাকে যে ব্রেইন অ্যাটাক হয়েছে অথবা হার্ট স্ট্রোক করেছে। এইটা সম্পূর্ণ ভুল। স্ট্রোক মানেই ব্রেইনে ঘটবে এবং সেটা কখনো হার্টে হবেনা।
হার্ট অ্যাটাক
যখন আমাদের হৃদপিণ্ডে বা হার্টে রক্তচলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয় তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। আমাদের শরীরের যে ধমনি যার মধ্য দিয়ে রক্ত হৃদপিণ্ডে পৌছে সেই ধমনি যদি রক্ত চলাচলে বাধা প্রাপ্ত হয় তখন হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
হার্ট ফেইলর বা কার্ডিয়াক এরেস্ট
যখন হৃদপিণ্ড আর কাজ করছে না অর্থাৎ হৃদপিণ্ড রক্ত পাম্প করতে পারছে না ফলে শরিরের অন্যান্য অংশে এবং ব্রেইনে রক্ত পৌছাতে পারছে না। ফলে পেশি সংকোচন ও প্রসারণ হয় না। হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলর একই সুত্রে গাথা। হার্ট অ্যাটাকের পর হঠাৎ কার্ডিয়াক এরেস্ট বা হার্ট ফেইলর এর ঘটনা ঘটতে পারে।
স্ট্রোক
স্ট্রোক হল এমন একটা মেডিকেল অবস্থা যখন ব্রেইন বা মতিষ্কের কোষে রক্তচলাচল কমে যায় যার ফলে কোষগুলো মারা যায়। স্ট্রোক প্রধানত ২ প্রকার, ইস্কেমিক এবং হেমোরেজিক। ইস্কেমিক হল যখন মতিষ্কে রক্তচলাচল কমে যায় এবং হিমোরেজিক হলো মতিষ্কে রক্তক্ষরণ।
স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক সাধারণত বাথরুমে বা গোসলের সময় হয় কেন?
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গোসলের সময় মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হৃদরোগ এবং বিভিন্ন শ্বাসনালির রোগে আক্রান্ত ছিল। এসব ছাড়াও আর কোনো কারণ আছে কি না, নাকি এগুলা সবই এমনি হয়ে থাকে? নিচে আমরা গোসলের সময় হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হওয়ার জন্য দায়ী এমনি কিছু পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবো।
বাথরুমে চাপ (Toilet Strain)
আমাদের চারপাশে অনেকেই আছে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছে। কোষ্ঠকাঠিন্য হলো ঠিক মত মলত্যাগ না হওয়া। খাবারে আশ যুক্ত খাবার কমে গেলে এবং পানির পরিমাণ কমে গেলে আমাদের এই রোগ হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত রোগী যখন মলত্যাগের জন্য বাথরুমে যায় তখন সে অনেক সময় নেয় এবং মলত্যাগের জন্য চাপ প্রয়োগ করে এবং এই চাপের জন্য সে তার শ্বাস বা দম আটকে রাখে ফলে নিচের দিকে চাপ কাজ করে। মেডিকেল এর ভাষায় একে বলে “ ভালসালভা মানেউবের ( Valsalva Maneuver)”। এই অবস্থা এবডোমিনাল (পেটের) চাপ বাড়িয়ে দেয় এবং রেকটাম বা পায়ুপথ দিয়ে মল বের হয়ে যেতে সাহায্য করে। কিন্তু এই অবস্থা হার্ট এবং রক্তসংবহন তন্ত্রের জন্য খুব ক্ষতিকর। কেননা বুকের ভিতরে চাপ বেড়ে যাওয়ায় হার্টে রক্তচলাচল কমে যায় ফলে হার্ট এর পাম্প করার ক্ষমতা ধীর গতির হয়ে পরে ফলশ্রুতিতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। অনেক সময় এই ধীর গতির পাম্প এর কারণে ব্রেইনে রক্তচলাচল কমে গিয়ে কেউ কেউ অজ্ঞান ও হয়ে যেতে পারে। মেডিকেল এর ভাষায় একে বলে সিনকপি (Syncope)।
অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হয় যদি বাথরুমের চাপের কারণে হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং এই অনিয়ন্ত্রিত এবং আকস্মিক রক্তচাপ বাড়ার ফলে মতিষ্কের ধমনী ফেটে গিয়ে ভিতরেব রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেটি পরবর্তীতে স্ট্রোকএ রুপান্তিত হতে পারে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যাদের দীর্ঘদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্য আছে তাদের মলত্যাগের সময় আকস্মিক অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুকি বেশি থাকে।
রক্তচাপের আকস্মিক পরিবর্তন
অনেকেই আছে যারা উচ্চরক্ত চাপে ভুগছে। তাদের ক্ষেত্রে গোসলের ধাপ, পানির তাপমাত্রা এবং কোন ঋতু চলমান তা অবশ্যই আমলে এনে গোসল করা উচিত। গোসলের সময় হঠাৎ ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে আসলে সিম্পেথেটিক টোন বেড়ে যায় ফলে স্কিন বা ত্বক এর তাপমাত্রা কমে যায়। ফলশ্রুতিতে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
আমাদের দেশের বয়স্ক ব্যক্তিগণ সচরাচর সকালে উঠেই টয়লেট এবং গোসল করে নেয়। কিন্তু বলা হয়ে থাকে সকালের এই গোসল যাদের উচ্চরক্তচাপ আছে তাদের জন্য খুবই বিপদজনক।
আর তাই, ধারণা করা হয়ে থাকে আকস্মিক এই রক্তচাপের পরিবর্তন স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক অথবা কার্ডিয়াক এরেস্ট এর জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে
গোসলখানায় পিছলে পড়া
অনেক বৃদ্ধ এবং বয়স্ক লোক গোসলখানায় পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পায়। ফলে মতিষ্কের রক্তক্ষরণ হয়। আর তাই এর জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। সতর্কতাস্বরুপ বেঞ্চ, টুল বা চেয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে যেন তাদের দাড়িয়ে থাকতে না হয়।
গোসলের সঠিক নিয়ম
গোসলের সময় যেন আকস্মিক রক্তচাপের পরিবর্তন না হয় তার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলা গরুরী। গোসলের সময় প্রথমে মাথায় পানি দিবো না পায়ে পানি দিবো সেটা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের উপর সেগুলো হলো-
-
গোসলের সময় আপনার দেহের তাপমাত্রা
-
আপনার ব্যবহৃত পানির তাপমাত্রা (গরম / ঠান্ডা)
-
আপনার হার্টের শারিরীক অবস্থা
এই বিষয়গুলা ছাড়াও আমাদের একটি সাধারণ নিয়ম মনে রাখা উচিত যে,
“ঠান্ডা তাপমাত্রায় রক্তনালি সংকোচন হয় এবং গরম তাপমাত্রায় রক্তনালি প্রসারণ হয়, বিশেষ করে আমাদের যে সুপারফিশিয়াল শিরা আছে সেগুলো।”
আর তাই যদি আমরা প্রথমে ঠান্ডা পানি মাথায় দেই তাহলে আমাদের সুপারফিশিয়াল করোনারি শিরা সংকুচিত হয় ফলে রক্ত প্রবাহ কম হয় এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক এর দিকে ধাবিত হতে পারে। এই ঘটনা সাধারণত ঘটে থাকে যারা হৃদরোগে ভুগছেন।
চিকিৎসকদের মতে গোসল করার সময় নিয়ম মেনে গোসল করা উচিত। সঠিক নিয়ম মেনে গোসল না করলে হতে পারে মৃত্যুও। গোসল করার সময় প্রথমেই মাথা এবং চুল ভেজানো একদম উচিৎ নয়। কারণ, মানুষের শরীরে রক্ত সঞ্চালন একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় হয়ে থাকে। শরীরের তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে। চিকিৎসকদের মতে, মাথায় প্রথমেই জল দিলে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত সঞ্চালনের গতি বহু গুণ বেড়ে যায়। সে সময় বেড়ে যেতে পারে স্ট্রোকের ঝুঁকিও। তা ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত রক্তচাপের ফলে মস্তিষ্কের ধমনী ছিঁড়ে যেতে পারে।
গোসলের ধাপগুলি
-
প্রথমে পায়ের পাতা ভেজাতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে উপর দিকে কাঁধ পর্যন্ত ভেজাতে হবে।
-
তারপর মুখে পানি দিতে হবে।
-
সবার শেষে মাথায় পানি দেওয়া উচিত।
ইসলাম ধর্মেও গোসলের এই নিয়ম বলা আছে যে নিচ থেকে আসতে আসতে উপরের দিকে পানি ঢালা এবং সব শেষে মাথায় পানি দিয়ে পুরো শরীর ভিজিয়ে গোসল করা।
এই পদ্ধতি যাদের উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল এবং মাইগ্রেন আছে তাদের অবশ্যই পালন করা উচিৎ।
গোসল আমাদের দৈনন্দিন কাজের অংশ হলেও আমরা অনেকেই উপরোক্ত বিষয়গুলা খেয়াল করি না। আমাদের সবার উচিৎ গোসলের সঠিক নিয়মগুলি মেনে চলা। আর যারা অসুস্থ তাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যাতে গোসলের সময় কোন দুর্ঘটনা না ঘটে।