ভয় নয়, ডায়বেটিসকে হারানোর সময় এখনই।
বাংলাদেশ সহ বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা আশংকাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখুনি যদি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহন না করা হয় তাহলে জনস্বাস্থ্য চরম হুমকীর মুখে পড়বে। যেখানে প্রতি ৭ সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে সেখানে অতি সত্বর ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আর এই জন্য প্রয়োজন ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানা ও সতর্ক থাকা এবং আক্রান্ত হয়ে গেলে বিশেষ যত্নের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রনে রাখা।
ডায়াবেটিস সম্পর্কে সাধারন ধারণা নেই বা এই সম্পর্কে শোনে নি, এমন মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের জরিপ অনুযায়ী পৃথিবীতে ৪৬ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। বিশেষ করে নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশের মানুষ মনে করেন ডায়াবেটিস খুব বেশী একটা ক্ষতিকর কিছু নয়। কিন্তু বিশ্বে করোনা আঘাত হানার পর এক মর্মান্তিক চিত্র আমাদের সামনে উঠে এসেছে। কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা মানুষের একটি বড় অংশ ছিল ডায়াবেটিসের রোগী।
এছাড়াও ডায়াবেটিস দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত থাকলে কিডনীরোগ, হৃদরোগ, চোখের সমস্যা, স্নায়ুর রোগ এমনকি গর্ভকালীন জটিলতাও দেখা দিতে পারে। প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয়। এ বছর “Access to Diabetes Care” বা “সর্বজনীন ডায়াবেটিস চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণ” প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হতে চলেছে দিবস টি।
আরো পড়ুনঃ " ডায়াবেটিক ও কুসংস্কার ।" ডায়াবেটিক নিয়ে আমাদের সমাজের প্রচলিত ২১টি ভুল ধারণা
ডায়বেটিস দিবস ২০২১ ও এবারের প্রতিপাদ্য
১৯৮০ সালে বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১০৮ মিলিয়ন যেটা ২০১৪ সালে বেড়ে দাড়িয়েছিল ৪২২ মিলিয়নে। সমীক্ষা অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ৪.৭% থেকে ৮.৫% বেড়েছে। এই সংখ্যাটা মারাত্বক রকমের বেশী। বিশেষজ্ঞদের মতে অতিরিক্ত ওজন বা স্থুলতা এর একটি অন্যতম প্রধান কারন। গত এক দশকে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ডায়াবেটিসের প্রকোপ দ্রুত বেড়েছে।
ডায়াবেটিস অন্ধত্ব, কিডনী ফেইলর, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং অঙ্গহানীর মত ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ। তবে আশার কথা হচ্ছে সুষম খাদ্যাভাস, নিয়মিত শরীরচর্চা ও ধূমপান পরিহারের মাধ্যমে টাইপ ২ ডায়াবেটিস অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে যদি এই রোগে আক্রান্ত হয়েই যায়, তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঔষধ সেবন, নিয়মিত পরীক্ষা, এবং রোগীর সঠিক যত্ন অনেক জটিলতা এড়াতে সাহায্য করে।
২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের ৬১/২২৫ রেজুলেশনে ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এই রেজুলেশনটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোকে তাদের হেলথ-কেয়ার সিস্টেমের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ডায়াবেটিসের যত্ন, চিকিৎসা, ও প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ নীতিমালা গ্রহনেও উৎসাহিত করে।
প্রতি বছরের মত এ বছরেও আগামী ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হবে। এবারের ২০২১-২৩ এর থিম বা প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে “Access to Diabetes Care”- ‘সর্বজনীন ডায়াবেটিস চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করণ’।
ইনসুলিন আবিষ্কারের ১০০ বছর পরেও, বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস আক্রান্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় যত্ন বা চিকিৎসা সেবা পান না। ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের তাদের রোগ নিয়ন্ত্রনে রাখতে এবং জটিলতা এড়াতে প্রতিনিয়ত যত্ন এবং সাপোর্ট প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডায়বেটিস
বিবিসি নিউজ এর তথ্য মতে নিপোর্ট (জাতীয় জনসংখ্যা গবেষনা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান) এর একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। যদিও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সুনির্দিষ্ট বয়স সীমা নির্ধারন করা যায় না তবে তুলনামূলক মধ্য বয়সের পরেই এর আক্রমন বেশী হয়ে থাকে।
এই রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮-৩৪ বছর বয়সী আক্রান্তের সংখ্যা ২৬ লাখ এবং ৩৫ বছরের বেশী বয়সী আক্রান্তের সংখ্যা ৮৪ লাখ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সংখ্যা সত্যিই অনেক বেশী ভয়ানক।
এই ভয়ানক পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্বস্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন। এই লক্ষে বাংলাদেশের ডায়াবেটিস সমিতির স্বাস্থ্য কর্মীরা সমিতির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনটিকে অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারী জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করে।
এ বছর জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস এর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “কোভিড ও ডায়াবেটিস- প্রতিরোধে বাঁচবে জীবন”। এই দিনকে সামনে রেখে নানাবিধ কর্মসুচী গ্রহন করা হয়েছিল।
দুঃখের বিষয় হল এত কর্মসূচি, এত প্রচারের পরেও ডায়াবেটিস আশংকাজনকহারে গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বিডিএইচএস (বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভ) এর সর্বশেষ জরিপ মতে গ্রামাঞ্চলে ১৮ বছরের ঊর্ধে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলার সংখ্যা ৮% এবং পুরুষের সংখ্যা ১০%। অপরদিকে শহরাঞ্চলে এই সংখ্যা যথাক্রমে ১৪% ও ১৩%।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে ২০১৮ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রতি ১১ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং ডায়াবেটিসের কারনে মৃত্যুর হার ৩%।
আরো পড়ুনঃ ডায়াবেটিস ও ক্রনিক কিডনি ডিসিজ রোগীদের খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিৎ
ডায়বেটিস কেন হয়? এর প্রকারভেদগুলো কি কি?
খুব সহজ ভাষায়, মানবদেহে গ্লুকোজের পরিমান স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী থাকলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে ডায়াবেটিস বলে। আমাদের শরীরে ইনসুলিন হরমোন উৎপাদিত হয় অগ্ন্যাশয় থেকে যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে সাহায্য করে। ইনসুলিন যদি কার্যকর না থাকে অথবা অগ্ন্যাশয় যদি পর্যাপ্ত পরিমানে ইনসুলিন উৎপাদনই না করতে পারে তাহলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায় আর একেই ডায়াবেটিস বলে।
ডায়াবেটিস মূলত ২ প্রকারের-
-
টাইপ ১ ডায়াবেটিস- অগ্ন্যাশয় পর্যাপ্ত পরিমানে ইনসুলিন উৎপাদন করতে না পারলে অথবা একেবারেই উৎপাদন করা বন্ধ করে দিলে সেটাকে টাইপ ১ ডায়াবেটিস বলে।
-
টাইপ ২ ডায়াবেটিস- যদি শরীরে ইনসুলিন উৎপাদিত হওয়ার পরেও অকার্যকর থাকে তখন সেটাকে টাইপ ২ ডায়াবেটিস বলে।
ডায়বেটিস থেকে কিভাবে সতর্ক থাকতে পারি?
যদিও ডায়াবেটিসের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে তবে আশার কথা হল সময়মত কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারলে রোগটি অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। চলুন দেখি সেগুলো কি কি-
চিনি ও শর্করা গ্রহনের পরিমান কমিয়ে দিন
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে চিনি, মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং পরিশোধিত শর্করা গ্রহন কমিয়ে দিতে হবে।
শরীর চর্চা করুন প্রতিদিন
বিশেষজ্ঞদের মতে ডায়াবেটিসকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলে প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য শরীর চর্চা করা জরুরি। অন্ততপক্ষে প্রতিদিন ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা হাটার অভ্যাস করা উচিত।
প্রচুর পরিমানে পানি পান করুন
প্রচুর পরিমানে পানি পান করলে সাধারন খাবার গ্রহনের পরিমান অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রন করা যায়। এতে ওজন নিয়ন্ত্রন করা সহজ হবে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমবে।
ওজন নিয়ন্ত্রিত রাখুন
আমরা আগেই বলেছি যে অতিরক্ত ওজন অথবা স্থুলতা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেক বেশী বাড়ায়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে যে কোন উপায়ে।
ধুমপান পরিহার করুন
ডায়াবেটিস, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদির মত বহু মারাত্বক রোগের ঝুঁকি বাড়াতে ধূমপান অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।
লো কার্ব ডায়েট অনুস্বরণ করুন
ডায়াবেটিসকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য শর্করা তুলনামূলক কম গ্রহন করতে হবে। এতে অতিরিক্ত খাদ্যাভাসেও নিয়ন্ত্রন আসবে।
চা অথবা কফি পান করুন
গবেষনা থেকে জানা যায় যে, নিয়মিত চিনি ছাড়া চা অথবা কফি খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকটা কমে যেতে পারে।
ডায়বেটিস হয়ে গেলে কি করনীয়?
ডায়াবেটিস থেকে বাচার জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম। চলুন দেখি যদি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে কি করবেন-
-
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত রাখার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর হতে হবে
-
ধূমপান পরিহার করুন
-
আপনার উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্তে কোলেষ্টোরেল নিয়ন্ত্রনে রাখুন
-
নিয়মিত শরীরের এবং চোখের পরীক্ষা করুন
-
নিয়মিত দাঁতের যত্ন নিতে হবে
-
পায়ের যত্ন নিতে হবে
আরো পড়ুনঃ ডায়াবেটিসে ভয় নয়, সচেতন হোন ও জীবনকে উপভোগ করুন
ডায়াবেটিস একটি নীরব ঘাতক রোগ। তবে আশার কথা হল আপনার দৃঢ় মনোবল ও ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে একে অনেকটায় নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারবেন। সতর্কতা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি এড়িয়েও যেতে পারবেন। বাংলাদেশের ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ড. এ কে আজাদ খান বলেন আগাম সতর্কতা অবলম্বন করলে ৭০% টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই হতাশা ঝেড়ে ফেলুন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে মনোযোগী হোন।