দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে যে ১০টি রোগে ভুগতে পারেন

ব্যঙ্কার, ফ্রিল্যান্সার, কোম্পানির ম্যানেজার সহ বিভিন্ন কাজের সিংহভাগই বসে করতে হয়। প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিতে বসে থেকে কাজ করতে হয় ৬ থেকে ১৮ ঘন্টা পর্যন্ত। যার ফলশ্রুতিতে অনেকেই ভুগছেন দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায়। সেসব রোগ ও প্রতিকার সম্পর্কেই আজ আমরা জানবো।

ফ্রিল্যান্সিং এ ক্যারিয়ার গড়া ফারহান ইদানিং অসহ্য রকম ব্যাক পেইনে ভুগছেন। অন্যদিকে আনোয়ার সাহেব একটি অফিসের একাউন্টেন্ট অফিসার। ইদানিং ওজন বৃদ্ধির পাশাপাশি ডায়াবেটিস দেখা দিয়েছে। দু'জনকেই ডাক্তার জানিয়েছেন তাদের এসব সমস্যার কারণ দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা। 

বসে-শুয়ে আরামে দিন যাপন কে না করতে চায়?  তবে এই আরাম কখনো কখনো স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ। ইদানিংকালে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার কুফল খুব ভালো ভাবেই চোখে পড়ছে। এই আর্টিকেলে আমরা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার কুফল এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে জানবো।

দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ভয়াবহতা

দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে শরীরে বিভিন্ন রোগ ও অস্থিরতা দেখা দেয়। এর মধ্যে একটি বড় সমস্যা হলো, আমাদের কটিদেশীয় কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্ক গুলো ফুলে ওঠা, যা পরবর্তীতে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার রুপ নেয়। এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোমরে চর্বি জমা, রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল, হার্টের সমস্যা, ওজন বৃদ্ধি সহ নানান রোগ হতে পারে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার কারণে। এই সমস্যা গুলো সম্পর্কে এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় জানা জরুরি।

১. হৃদ রোগ

দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। কেননা একটানা অনেক সময় বসে থাকার ফলে শরীরে রক্ত চলাচল কমে যায়। যার কারণে দেহে সঞ্চিত ফ্যাট তুলনামূলক কম গলতে থাকে। যার দরুণ ফ্যাটি এসিডের প্রভাবে হার্টের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যারা বেশি বসে থাকেন তাদের হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৬৫ শতাংশ বেশি থাকে। আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলোজিতে প্রকাশিত এক গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, যারা দিনে ১০ ঘন্টা বা তার বেশি সময় বসে কাজ করেন, তাদের হৃদ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যারা দৈনিক ৫ ঘন্টার কম বসে থাকেন তাদের থেকে বেশি হয়। অর্থাৎ, এ থেকে স্পষ্ট যে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে হৃদ রোগ অবশ্যম্ভাবী।

২. ওজন বৃদ্ধি

বর্তমান সময়ে আমরা ওজন বৃদ্ধি নিয়ে বেশ চিন্তিত। ওজন বিভিন্ন কারণে বেড়ে থাকে, এর মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকাও উল্লেখযোগ্য। বসে থাকার ফলে ওজন বৃদ্ধা ও শরীরের মেটাবলিজম কমে যাওয়ার মত সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বিপাক ক্রিয়া হ্রাস করে, যার ফলে ওজন বৃদ্ধি পায়। ওজন বৃদ্ধি পেলে শারীরিক সৌন্দর্য্য হ্রাসের পাশাপাশি শরীরে নানারকম রোগ বাসা বাঁধে। 

৩. ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস বর্তমানে অতি পরিচিত একটি রোগ। আমাদের আশেপাশের অধিকাংশ মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। দিনকেদিন ডায়াবেটিস মহামারীর রূপ নিচ্ছে। যারা প্রতিদিন দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিশেষ করে তারা ডায়াবেটিস-টাইপ ২ এর ঝুঁকিতে থাকেন। শরীরের চর্বি এবং চিনির ভাঙনে শারীরিক কার্যকলাপ তথা হাঁটা-চলা, ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে এই কার্যকলাপ গুলো বাঁধাগ্রস্থ হয়। ডায়াবেটিস আক্রান্তরা দ্রুত চিকিৎসা না নিলে এটি কিডনি, হৃদরোগ এবং অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। 

৪. দূর্বল রক্ত সঞ্চালন

রক্ত সঞ্চালন বলতে হৃদপিন্ড থেকে রক্ত সারাদেহে সঞ্চালনকে বোঝায়। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে রক্ত সঞ্চালনেও সমস্যা দেখা দেয়। রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক ভাবে না হলে পায়ের রক্তে পুল তৈরী হতে পারে যার ফলে ভেরিকোজ শিরা এবং গোড়ালি ফুলে যায়। দূর্বল রক্ত সঞ্চালন বিপজ্জনত রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকির পাশাপাশি ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (DVT) হয়। রক্ত জামাট বাঁধার পর কিছু অংশ ভেঙ্গে গেলে এটি ফুসফুসে গিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে।  

৫. অস্টিওপোরেসিস

অস্টিওপোরেসিস বলতে হাড়ের ক্ষয় জনিত রোগকে বোঝায়। এ রোগ হলে হাড়ের ক্যালসিয়ামের ঘনত্ব বা পরিমাণ কমে স্বাভাবিক গঠন নষ্ট হয় ও হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়।  একপর্যায়ে কোমরের হাড়, মেরুদণ্ড ও হাতের কবজির হাড় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে এই রোগ হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। 

৬. বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ

বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ ইদানিংকালে মানুষের সহজাত আচরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যায় আমরা অধিকাংশই প্রায় সময়ই বিষণ্ণতায় থাকি এবং অল্পেই মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগ প্রকাশ করি। মানুষ কাজের মধ্যে অর্থাৎ হাঁটা-চলা, ব্যায়াম, শারীরিক কসরতের মধ্যে থাকলে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের পরিমাণ তুলনামূলক কম হয়। যারা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন তাদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ও হতাশার পরিমাণ বেশি দেখা যায়। 

৭. পিঠ ও মেরুদণ্ডের সমস্যা

পিঠ ও মেরুদণ্ডে ব্যাথা, মেরুদণ্ড বাঁকা বর্তমানে একটি পরিচিত রোগ। অধিকাংশই এই সমস্যায় ভুগছেন। এই সমস্যার উল্লেখযোগ্য একটি কারণ দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা। দীর্ঘক্ষণ এক ভাবে বসে থাকলে পিঠ ও মেরুদণ্ড একভাবে থাকে। যার ফলে মেরুদণ্ডে মারাত্মক চাপ পরে। যে কারণে পিঠে ব্যাথা ও মেরুদণ্ডের নানান সমস্যা দেখা দেয়। 

৮. বদ হজম

খেয়ে উঠেই যদি কোনো কাজের জন্য দীর্ঘ সময়ের জন্য কোনো কাজে বসা হয় এবং এটি ধারাবাহিক ভাবে প্রতিনিয়ত চলতেই থাকে তবে বদ হজম, অম্বল সহ নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। 

৯. ক্যান্সার

ক্যান্সারকে আমরা মরণব্যাধি হিসেবেই জানি। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে কোলন ক্যানন্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এর মূল কারণ হলো দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা। কেননা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে শরীরে ইনসুলিনের উৎপাদন বেড়ে যায় এবং কোষের জন্মহার বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শরীরে ক্যন্সার কোষ জন্ম নেয়। এভাবে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে ক্যান্সার বাসা বাঁধে শরীরে।

১০. মস্তিষ্কের ক্ষতি

মস্তিষ্ক একজন মানুষের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গ। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে মস্তিষ্কের ক্ষতির মতো বড় ধরণের সমস্যা হতে পারে আমাদের। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে ব্রেন ফাংশন ধিমে তালে কাজ করে। সেই সাথে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত কম পরিমাণে পৌঁছায়। ফলে স্মৃতিশক্তিতে প্রভাব পরে।

দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানোর উপায়

জীবিকার তাগিদে আমাদের দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করতে হয়। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে আমরা জেনেছি। এসব ঝুঁকি থেকে নিজেকে বাঁচাতে নিজেদের অভ্যাস ও আচরণে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। এখন আমরা এসকল বিষয়ে জানবো।

বিরতি নিয়ে বসা

একটানা বসে না থেকে এক ঘন্টা বা ৩০ মিনিট পর কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করতে হবে। এতে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হবে।

ঘাড়ের ব্যায়াম 

দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে আমরা ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করি। এই ব্যথা দূর করতে আমাদের বসে থেকেই কিছু ঘাড়ের ব্যায়াম করতে হবে। যেমন, মাথা ধীরে ধীরে এক পাশে নামানো, ঘাড় ঘোরানো ইত্যাদি।

নিয়মিত যোগব্যায়াম করা

শরীরের জন্য যোগব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকরী। শরীর সুস্থ রাখদে যোগব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকরী। নিয়মিত যোগব্যায়াম করলে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে যে সকল স্বাস্থ্য ঝুঁকি হয় তার কিছুটা এড়ানো সম্ভব।

সঠিক ভঙ্গিতে বসা

সঠিক ভঙ্গিতে না বসে কাজ করার ফলে ঝুঁকি আরো বাড়তে পারে। সঠিক ভঙ্গিতে বসে কাজ করলে কিছু ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। সঠিক ভঙ্গির মধ্যে আছে-

  • সোজা হয়ে বসে চেয়ারে পিঠ স্পর্শ করানো

  • পা মাটির সমতলে রাখা

  • ঘাড় না চাপিয়ে সামনের দিকে তাকানো।

বসে থাকার ঝুঁকি কমানোর কার্যকরী পদক্ষেপ এক নজরে

  • হেঁটে বা সাইকেলে চলাচল করা

  • দূরের পথ হলে বাস থেকে একটু দূরে নেমে বাকি অংশ হেঁটে যাওয়া

  • লিফট বা এসকেলেটর পরিহার করে সিঁড়ি ব্যবহার করা

  • নিয়মিত অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা

  • নিয়মিত ব্যায়াম, সাঁতার করার অভ্যাস করা

  • অফিসে কলিগদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলা

  • চেয়ারে বসার সময় পিছন পকেট থেকে ওয়ালেট ড্রয়ারে রাখা

শেষ কথা

দৈনন্দিন কাজ কর্মে কিংবা জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার বিকল্প নেই। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকায় যেহেতু বাভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে তাই এদিকটায় সচেতন হয়ে দিকনির্দেশনা মেনে কাজ করতে হবে। একটানা দীর্ঘক্ষণ বসে না থেকে ৩০ মিনিট বা ১ ঘন্টা পরপর বিরতি নেওয়া জরুরী। শারীরিক সুস্থতার জন্য এসকল দিকনির্দেশনা মেনে চলা দরকারি। তাছাড়া বেশি সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই রেজিস্টার ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে জানতে নিয়মিত আমাদের ওয়েব সাইট ভিজিট করুন। সচেতন হোন, নিজে জানুন, অন্যকে জানান। ধন্যবাদ।

আরও পড়ুনঃ

Default user image

বিশাল সাহা, লেখক, আস্থা লাইফ

পড়ছি ঢাকা কলেজে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। লেখালিখির প্রতি টান ক্লাস নাইনের শেষ থেকে। মূলত কবিতা লিখলেও গল্প, জাতীয় পত্রিকায় কলাম লেখা হয় নিয়মিত। আস্থা লাইফ এ লেখার সুযোগ পেয়ে আমার জানার ও লেখার পরিধিটা বিস্তৃত হচ্ছে। ইমেইলঃ bishalsahabd@gmail.com

Related Articles