পলিথিন কেন পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ?

দৈনন্দিন কাজে পলিথিন ও প্লাস্টিক আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। আবার আমাদের মতই অনেক অসচেতন মানুষেরাই তা ব্যবহারের পর যত্রতত্র ভাবে ফেলে আসছি। কিন্তু আমরা জানি কি এই পলিথিন কতটা ভয়ংকর! কতটা ক্ষতি করছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের। আসুন জেনে নেই পলিথিন যেভাবে আমাদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

যে কারণে পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে

 

সম্প্রতি একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২ এর প্রবেশ পথে একটি নতুন বিষয় চোখে পরে মেলার দর্শনার্থীদের। কাগজের তৈরী "পরিবেশ বান্ধব কলম"। বিষয়টা একই সাথে আশ্চর্য জনক আবার অদ্ভুতও। কাগজ দিয়ে আবার কলম তৈরী করা যায় না কি! হ্যাঁ যায়। প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধে এ উদ্যোগ নেয়া। আবার পাটের আঁশ দ্বারা তৈরী ব্যাগ উদ্ভাবন করা হয়েছে যা কি না পলিথিনের বিকল্প। মূলত পলিথিন পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর আর এই ক্ষতি এড়াতেই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সব কিছুর উদ্ভাবন করা হচ্ছে।

তবে মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশে পলিথিনের ব্যবহার ব্যান করা হলেও যত্রতত্র পলিথিনের ব্যবহার চোখে পড়ছেই। এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা পলিথিন কি, পলিথিন ব্যবহারের ঝুঁকি, পলিথিন দূষণ রোধে করণীয় সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানব।

পলিথিন কি?

একরকম বুঝতে শেখার পর থেকেই প্রত্যেকেই আমরা পলিথিন শব্দটা শুনে এসেছি। শব্দটার পরিচিতির কারণ ব্যবহার। আমাদের দৈনিক ব্যবহার্য্যের মধ্যে পলিথিন অন্যতম যা কিনা পরিবেশের জন্য মারত্মক ক্ষতিকর।

পলিথিন হচ্ছে রাসায়নিক যৌগ ইথেনের পলিমার, যা বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে তৈরি। পলিথিন হলো একধরণের নমনীয় কিন্তু শক্ত প্লাস্টিক। এমনকি পলিথিন এসিড, ক্ষার সহ অন্যান্য দ্রাবক দ্বারা আক্রান্ত তথা ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। সাধারণ ভাবে তাই বলা যায় পলিথিন বায়োডিগ্রেডেবল বা পচনশীল নয়।

বাংলাদেশে পলিথিন দূষণের বর্তমান পরিসংখ্যান

পলিথিন এমন একটি পদার্থ যা পঁচন অযোগ্য। এমনকি পলিথিন পোড়ালে এর উপাদান পলিভিনাইল ক্লোরাইড কার্বন মনোঅক্সাইড উৎপন্ন করে বায়ু দূষণ করে। 

  • পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে বাংলাদেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। তবু পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই। 

  • পরিসংখ্যানে জানা যায় চমকপ্রদ তথ্য, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি করে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসাবে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিনের ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। 

  • বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বলছে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি পলিথিনের ব্যাগ জমা হচ্ছে। 

  • একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজধানীর লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় প্লাস্টিকের কারখানা আছে প্রায় কয়েক শত। লালবাগের চান্দিরঘাট এলাকাতে ঘুরে দেখা যায়, পুরোটাই প্লাস্টিক উৎপাদের কারখানা। এখানে প্রকাশ্যে চলে অবৈধ পলিথিনের উৎপাদন ও বিক্রি।

  • পলিথিন দূষন নিয়ে সারা বিশ্বে শোরগোল, হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড। গবেষকরা বলছেন বর্তমানের পলিথিন দূষনের মাত্রা বজায় থাকলে ২০৫০ নাগাদ সাগরে মাছের চাইতে পলিথিনের খন্ডিত অংশের সংখ্যা বেশী হবে। বিষয়টি কতটা উদ্বেগের তা আমরা হয়তো অনেকেই ঠাওর করতে পারছি না। 

বাংলাদেশে পলিথিন দূষণের বর্তমান প্রেক্ষাপট

পলিথিনের অতিরিক্ত ব্যবহার নদী দূষণ, বর্জ্র ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা সহ সামগ্রিক পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়গুলোকে পৃথক ভাবে আলোচনা করা হচ্ছে এ পর্যায়ে।

নদী দূষণে পলিথিনের প্রভাব

দৈনিক পলিথিনের অপ্রতুল ব্যবহার নদী দূষণেও অংশীদার হয়েছে। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ পলিথিন। পলিথিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় সিটি করপোরেশন, জেলা শহর, পৌরসভা ও উপজেলা শহর এলাকায়। ফলে শহর এলাকার নদ-নদীগুলোই পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী নদী যা রাজধানী ঢাকার,  বরিশালের কীর্তনখোলা নদী; চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। এছাড়া নরসুন্দা, নবগঙ্গা, সুরমা, করতোয়া, ইছামতিসহ বিভিন্ন নদ-নদী পলিথিন দূষণের কবলে পড়েছে।

বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, হালদা ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে কয়েক ফুট পুরু পলিথিনের স্তর জমার কারণে নদীর দূষণ তো বটেই, জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিনের প্রভাবে নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে যে কারণে বন্যা, নদীভাঙনের মতো সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে। সেই সাথে নদীতে মাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। 

বর্জ্র ব্যবস্থাপনা

বর্জ্র ব্যবস্থাপনা বলতে আবর্জনা সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পুনঃব্যবহার এবং নিষ্কাশনের সমন্বিত প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়। সহজ কথায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায় বর্জ্য বস্তুর উৎপাদন কমানো। সমন্বিত এবং সম্পূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তিনটি R নীতি প্রয়োগ করা হয়। তিনটি R নীতি হলো-

  • Reduce (কমানো)

  • Re-use (পুনব্যবহার) এবং 

  • Recycle (পুনশ্চক্রীকরণ) । 

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বর্জ্র ব্যবস্থাপনায় কোনো গুরুত্ব নেই আমাদের। পলিথিনের ব্যবহার কমানো, তা পুনব্যবহার এবং রিসাইকেল এর কোন পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়ে না।  যার কারণে পরিবেশ দিনকে দিন দূষিত হচ্ছে।

জলাবদ্ধতা

শহর কিংবা গ্রাম প্রতিটি অঞ্চলের ক্ষেত্রেই জলাবদ্ধতা একটি মারাত্মক সমস্যা। শহর, গ্রামের পয়নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত হয় ড্রেন। কিন্তু ইদানিংকালে এই ড্রেন ময়লায় বদ্ধ হয়ে গিয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে। ময়লার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পলিথিন ও প্লাস্টিক বোতল। ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ ড্রেন পলিথিনে আবদ্ধ।  জলাবদ্ধতা মানুষকে বিরক্তিকর যন্ত্রণা দেয়। তবু মানুষ নিজেরাই সচেতন হচ্ছেনা জলাবদ্ধতা এড়াতে।

পলিথিনের পরিবেশগত ঝুঁকি

পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব বস্তু দায়ী তার অন্যতম প্রধান হচ্ছে পলিথিন বা প্লাস্টিক। ইথিনের পলিমার এই পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। যার অপ্রতুল ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রাণ প্রকৃতি। পৃথিবীব্যাপী প্রতি মিনিটে এক মিলিয়ন মানুষ বছরে গড়ে ৪০০টি ব্যাগ ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দৈনিক এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগসহ প্লাস্টিক থেকে তৈরি করা টিস্যু ব্যাগের ব্যবহার ৩০ লাখেরও বেশি যা ক্ষতি করছে পরিবেশের। মাটির উর্বরতা নষ্ট করে ফসলের ক্ষতি করছি পলিথিন। পলিথিন পোড়ালে কার্বন মনো অক্সাইডের বিষাক্ততা পরিবেশকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। পলিথিন মাটিতে পড়ে থাকায় মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ঠে বলেও উল্লেখ করেছে ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট, ইরি।

পলিথিনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি

পলিথিন স্বাস্থ্যের ক্ষতি ধীর গতিতে করতে থাকে। পলিথিনের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশ দূষণ করে যার ফলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। যেমন-

  • চোখ জ্বালা করা, শ্বাসকষ্ট, লিভারের কার্যকারিতা হ্রাস, ক্যান্সার, মাথা ব্যাথা সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা যায়।

  • আমরা বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য পলথিন ব্যবহার করে আনায়ন করি, নিম্নমানের এসব পলথিন খাদ্যে একধরণের বিষক্রিয়া করে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। 

  • পলিথিন মোড়ানো গরম খাবার খেলে মানুষের ক্যান্সার ও চর্মরোগের সংক্রমণ হতে পারে। 

  • পলিথিনে মাছ ও মাংস প্যাকিং করলে তাতে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়।

  • এ ছাড়া উজ্জ্বল রঙের পলিথিনে রয়েছে সিসা ও ক্যাডমিয়াম, যার সংস্পর্শে চর্মরোগ তৈরি হয়

পলিথিন দূষণ রোধে করণীয়

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সবদিক থেকে। যেভাবে চলছে এমনটা আগামীতেও চললে বিপদ সীমার চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবেনা আমাদের। জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক অনেক কারণ থাকলেও পলথিন দূষণও এর অন্যতম একটি কারণ। পলিথিন দূষণ আমাদের নিজেদের রোধ করা উচিত। আর পলিথিন দূষণ রোধ করতে আমাদের অনেক কিছুই করণীয় আছে। যেমন-

  • পলিথিনের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা।

  • পচনশীল ময়লা ফেলার আগে প্লাস্টিক ও পলিথিনের বিভিন্ন সামগ্রী আলাদা করে ফেলা। 

  • যত্রতত্র পলিথিন না ফেলিয়ে একজায়গায় রাখা।

  • বাজার করার ক্ষেত্রে পাটের বা কাপড়ের ব্যাগ সাথে রাখা 

পলিথিনের দূষণ ও ব্যবহার কমাতে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার করণীয়

পলিথিনের দূষণ যে পর্যায়ে গেছে তার লাগাম টেনে না ধরতে পারলে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে আমাদের। পরিবেশ দূষণ ও ব্যবহার রোধে সরকার আইন করলেও তার বাস্তবায়ন হয়ে ওঠেনি। তবে এখন আর থেমে থাকার সময় নেই। পলিথিন দূষণ ঠেঁকাতে এখন সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া জরুরী।

সরকারের পদক্ষেপ সমূহ

  • পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে প্রণয়নকৃত আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।

  • পলিথিনের দূষণ ও ব্যবহার কমাতে বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাতে হবে এবং কার্যক্রম চালাতে হবে।

  • পলিথিনের কারখানা গুলো বাজেয়াপ্ত করে সিলগালা করে দিতে হবে।

  • পলিথিনের ব্যবহার ও দূষণ কমাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিনিয়ত নজরদারি করা।

বিভিন্ন সংস্থার করণীয়

  • জনগণকর পলিথিন দূষণ সম্পর্কে অবগত রাখা।

  • দোকানে গিয়ে নিশ্চিত করা যে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয়েছে।

  • পলিথিনের ক্ষতি সম্পর্কে ও সচেতনতা সম্পর্কে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিভিন্ন প্রতিবেদন করা।

  • জনসচেতনতা বাড়াতে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এলাকায় পলিথিনের ক্ষতি সম্পর্কে জনগণকে জানানো।

এসকল পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পলিথিন দূষণ রোধ করা সম্ভব। 
 

পলিথিনের অপকারিতা সম্পর্কে আমরা অবগত হয়েছি। সব জেনে শুনেও আমরা নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে আনছি। আমাদের উচিত পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে, সম্ভব হলে বন্ধ করে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তবেই পরিবেশ ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে।

Default user image

বিশাল সাহা, লেখক, আস্থা লাইফ

পড়ছি ঢাকা কলেজে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। লেখালিখির প্রতি টান ক্লাস নাইনের শেষ থেকে। মূলত কবিতা লিখলেও গল্প, জাতীয় পত্রিকায় কলাম লেখা হয় নিয়মিত। আস্থা লাইফ এ লেখার সুযোগ পেয়ে আমার জানার ও লেখার পরিধিটা বিস্তৃত হচ্ছে। ইমেইলঃ bishalsahabd@gmail.com

Related Articles