ফেসমাস্ক কেন এত কার্যকরী! বিজ্ঞান কি বলে?
জীবাণুর দ্রুত বিস্তার রোধ করতে এবং একে দ্রুত নির্মূল করতে ফেসমাস্ক খুবই শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে কাজ করে, বিশেষত যদি একটি অঞ্চলের সকলেই মাস্ক ব্যবহার শুরু করেন।
গতবছর ডিসেম্বরে চীনের উহানে সংক্রমনের মাধ্যমে সারা বিশ্বজুরে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। ইতালি ,আমেরিকার পর সমগ্র ইউরোপ কে নাস্তানাবুদ করে মার্চ থেকে বাংলাদেশেও শুরু হয় কভিড-১৯ ভাইরাসের আক্রমন। সরকারী হিসেব মতে এখন পর্যন্ত দেশে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষের প্রান কেড়ে নিয়েছে রোগটি। ভ্যাকসিন আবিস্কারের দোরগোড়ায় থাকলেও কবে নাগাদ বাংলাদেশ তার আওতায় আসবে তা একপ্রকার অনিশ্চিতই বলা যায়। তাই করোনা ভাইরাস কে রোধ করতে সচেতনতার বিকল্প নেই। আর সচেতনতার ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে ফেসমাস্কের ব্যবহার।
ভাইরাস ঠেকাতে মাস্কের ব্যবহার প্রায় সর্বজন স্বীকৃত হলেও এর বিপক্ষেও আছে একদল মানুষ। আমেরিকার সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে ইউররোপের অনেক দেশেও মাস্ক বিরোধিতা মোটা দাগে আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। ভিত্তিহীন এসব দাবির বিপরীতে সচেতন থাকতে তাই মাস্কের কার্যপদ্ধতি সকলেরই জানা প্রয়োজন।
ফেসমাস্ক যেভাবে কাজ করে
আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক ড. মেইলান হান এর মতে, করোনা ভাইরাস মূলত ছড়ায় শ্বাসযন্ত্রের ড্রপলেট বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকনার আকারে। কভিড-১৯ দ্বারা সংক্রমিত এমণ যেকোন ব্যাক্তি যখন কথা বলেন কিংবা হাচি বা কাশি দেন তখন তার মুখ থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে ভাইরাস ভর্তি ক্ষুদ্র থুথুর কণা।
ড্রপলেট গুলো সবসময় খালি চোখে দেখা বা অনুভব করা সম্ভব নয়। এসকল ক্ষুদ্র কণা বাতাসে ভেসে থাকতে পারে এমনকি হাঁচির ক্ষেত্রে প্রায় ছয় ফিটের মত দুরত্ব অতিক্রম করতে পারে অনায়াসে। ফেসমাস্ক এক্ষত্রে একধরনের দেয়ালের মত কাজ করে। যেহেতু কভিড-১৯ এর লক্ষণ সবার ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রকাশ পায় না তাই একটি অঞ্চলের সকলেই যদি ফেস মাস্ক ব্যবহার করেন তবে, বাঁধা পাবার কারণে ভাইরাস আক্রান্তের কাছ থেকে ড্রপলেটের মাধ্যমে সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করতে পারে না। আর এভাবেই ফেস মাস্ক ব্যবহারের মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে আমরা রক্ষা পাই।
ফেসমাস্কের সপক্ষে প্রমাণ সমূহ
ফেসমাস্ক পরিধানের পক্ষে বেশ কিছু গবেষণা ইতমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি প্রকাশ হওয়া এক গবেষণায় দেখা যায়, হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের সবাইকে মাস্কের আওতায় নিয়ে এলে সংক্রমনের হার দ্রুত হ্রাস পায়। আমেরিকার বোস্টন হাসপাতালে সম্পন্ন হওয়া এই গবেষণার আগে হাসপাতালটিতে সংক্রমনের হার ছিল অত্যন্ত বেশি। ফেসমাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করার পর সংক্রমণ কমে আসে আশানুরূপ ভাবে।
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক দল গবেষক এক গবেষণায় দেখতে পান সাধারন ফেসমাস্ক থেকে ভাইরাস প্রতিরোধে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে এন-৯৫ মাস্ক।
এছাড়া ফ্লোরিডা আটলান্টিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দেখান একাধিক স্তর সম্পন্ন এবং সম্পূর্ন ভাবে মুখ নাক ঢাকতে সক্ষম এমন ঘরে তৈরী ফেসমাস্কও ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে ভালো সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
এছাড়াও আমেরিকার কেন্দ্রিয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিডিসি এপ্রিল থেকেই পরামর্শ দিয়ে আসছে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকতে ফেসমাস্ক ব্যবহার করার।
ফেসমাস্ক সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণা সমূহ
ফেসমাস্ক পরা নিয়ে জনমনে অস্বস্তি এবং ভয়ের কোন অভাব নেই। অনেকেই নানা কারণে মাস্ক পরতে চান না। এর মাঝে কিছু ভ্রান্ত ধারণার বিপরীতে সবাইকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। যেমন-
১) মাস্ক ভাইরাস থেকে রক্ষা করে না
এটি ভুল ধারণা। মাস্ক অবশ্যই ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দেয়। সংক্রমিত ব্যক্তি এবং সুস্থ ব্যক্তির মাঝে দেয়াল হিসেবে কাজ করে মাস্ক। বিশেষজ্ঞরা যেহেতু সর্বদা মাস্ক পরিধান করতে বলছেন, তাই নিজের এবং প্রিয় মানুষদের সুস্থতার জন্যে অবশ্যই ফেসমাস্ক পরিধান করা উচিত।
২) ফেসমাস্ক পরিধান করা বিরক্তিকর এবং অসুবিধাজনক
বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং লোকাল অনেক মাস্ক থাকায় কোনটি পরিধান সুবিধাজনক তা অনেক সময় বোঝা যায়না। অনেকের ক্ষেত্রেই মাস্ক ব্যবহারে মুখ অসম্ভব রকম ঘেমে যায়। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন পলিস্টারের বদলে সুতি কাপড়ের মাস্ক খুঁজে বের করা।
এছাড়া কানের উপর ইলাস্টিকের কারণে ব্যাথা হতে পারে অনেকের। তারা ইলাস্টিকের নিচে নরম কাপড় যুক্ত মাস্ক কিংবা অপেক্ষাকৃত নরম ইলাস্টিক ব্যবহার করতে পারেন।
যারা চশমা পরিধান করেন, তাদের সমস্যাটা হয় সবচাইতে বেশি।সেক্ষত্রে চশমাটিকে মাস্কের উপর রাখা যায় কিংবা যে সকল ফেসমাস্কে নাকের অংশের সাথে এঁটে দেয়ার জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা থাকে সে সকল মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে,সুরক্ষার জন্যে মাস্ক ব্যবহার করতেই হবে।
৩) মাস্ক কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগে বাধা দেয়
এই ভ্রান্ত ধারনাটির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কার্বন-ডাই –অক্সাইড ত্যাগের জন্যে যতটুকু জায়গা প্রয়োজন ,মাস্কের বেলায় তা ঠিকমতই থাকে। নইলে চিকিতসকরা এতকাল যাবত ফেসমাস্ক পরিধান করে রোগীদের সেবা দিতে পারতেন না।
৪) আমি সুস্থ তাই মাস্ক প্রয়োজন নেই
করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে অনেকের দেহেই সংক্রমনের লক্ষণ প্রকাশিত হয় না। কিন্তু তাদের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছে এমন অনেকেরই অবস্থা জটিল দিকে যেতে পারে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
এছাড়া মাস্ক পরিধান করলে অন্য অনেক সংক্রমিত ব্যক্তি যারা মাস্ক পরিধান করছেন না তাদের হাত থেকে বাঁচা যায় কিছুটা হলেও। তাই ফেস মাস্ক পরিধান করাই শ্রেয়।
শেষ কথা
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সকল বৈজ্ঞানিক গবেষণা ফেস মাস্ক পরিধানের গুরুত্ব স্বীকার করে। ভাইরাস ছড়ায় মূলত হাঁচি কাশি এবং সংক্রমিত ব্যক্তির অন্যান্যদের সাথে কথা বলার সময়। মাস্ক এক্ষত্রে সংক্রমণের বিরুদ্ধে সরাসরি বাঁধা দেয়। ফেসমাস্ক নিয়ে জনমনে গেথে থাকা বেশিরভাগ বাজে ধারণাগুলোই ভিত্তিহীন। তাই নিজেকে এবং প্রিয়জনকে রক্ষায় সকলকেই বাইরে বেরুলে ফেসমাস্ক পরিধান করা উচিত।