করোনাভাইরাস সম্পর্কিত ২০ টি ভ্রান্ত ধারণা
২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি হলে করোনাভাইরাস ধ্বংস হয়ে যায়? গরম পানি দিয়ে গোসল করলে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? নিউমোনিয়ার ভাক্সিন করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করে? করোনাভাইরাস দ্বারা বয়স্করা আক্রান্ত হয়, যুবক বা তরুণরা হয় না? এইরকম আরো অনেক তথ্য বাতাসে, ফেসবুকে ভাসছে! আসুন আসল ঘটনা জানি তারপর শেয়ার করি।
বিশ্বজগতের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে করোনাভাইরাসের নাম। মাত্র ৩-৪ মাস আগে এর আবির্ভাব অথচ সবার কাছে বর্তমান আতঙ্কের অপর নাম করোনাভাইরাস। বিশ্বের বাকি সব বিষয় নিয়ে যতটুকু আলোচনা তার চেয়ে অনেক বেশী আলোচনা এই এক ভাইরাসকে নিয়ে। আর যেটা নিয়ে যতো বেশী আলোচনা সেটা নিয়ে ততো বেশী ভ্রান্ত ধারণা !!!
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অনেক অনেক বৈজ্ঞানিক আলোচনার পাশাপাশি তৈরি হয়েছে অনেক অনেক ভ্রান্ত ধারণার। আসুন জেনে নেয়া যাক করোনাভাইরাসকে নিয়ে সৃষ্ট এমন ২০টি ভ্রান্ত ধারণা সম্পর্কে।
১. সূর্যের আলোতে অথবা কোন জায়গার তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি হলে করোনাভাইরাস আক্রমন করতে পারে না
যেকোনো আবহাওয়ায় করোনাভাইরাসের আক্রমন সম্ভব। সাধারনত যেকোনো ভাইরাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার উপরের তাপমাত্রায় মৃত্যুবরণ করে। সুতরাং কোন জায়গার তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশী হলে করোনাভাইরাস আক্রমন করতে পারবে না কথাটি ভুল।
২. ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং বরফ করোনাভাইরাসকে মেরে ফেলতে পারে
ঠাণ্ডা আবহাওয়া করোনাভাইরাসকে মেরে ফেলতে পারে এই উক্তির কোন যৌক্তিকতা নেই। কেননা বাইরের আবহাওয়া যাই হোক না কেন মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর কাছাকাছি হয়ে থাকে। এমন অনেক দেশের মানুষ করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত যেখানকার তাপমাত্রা মাইনাস বা তার কাছাকাছি।
৩. করোনাভাইরাস অত্যন্ত ভয়ঙ্কর রোগ এবং এর দ্বারা আক্রান্ত হলে মৃত্যু অনিবার্য
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সুস্থ হয়ে যাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে করনীয় হচ্ছে করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। যেমনঃ শুকনো কাশি, জ্বর হলে কমপক্ষে ১৪ দিনের জন্য নিজেকে আলাদা করে একাকী বাসায় অবস্থান করা এবং দরকার হলে প্রয়োজনীয় ঔষধ গ্রহন করা। সম্ভব হলে ফোনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। আর যদি শ্বাসকষ্ট হয় অথবা অসুস্থতা ৭ দিনের মধ্যে ভালো না হয় বরং খারাপের দিকে যায় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
যথাযথ ব্যবস্থা নিলে করোনাভাইরাস থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষদের মধ্য থেকে মৃত্যুর হার শতকরা ৫% এরও কম।
৪. কাশি এবং কোন ধরনের সমস্যা ছাড়া ১০ সেকেন্ড যদি শ্বাস বন্ধ করে রাখা যায় তাহলে বুঝতে পারবেন আপনি করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত নন এবং আপনার ফুস্ফুসে কোন সমস্যা নেই
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর হবে, শুকনো কাশি হবে। অবস্থা আরও খারাপ হলে শ্বাস কষ্ট হবে, নিউমোনিয়া হবে। করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হয়েছে কিনা বুঝার একমাত্র উপায় ল্যাবরেটরি টেস্ট। শ্বাস কিছুক্ষণ বন্ধ করে রাখতে পারার সাথে করোনাভাইরাসের কোন সম্পর্ক নেই।
৫. গরম পানি দিয়ে গোসল করলে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়
গরম বা ঠাণ্ডা যে পানি দিয়েই গোসল করা হোক শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর আশে-পাশেই থাকে। বরং খুব বেশি গরম পানি দিয়ে গোসল করলে সেটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে কুসুম গরম পানি দিয়ে যেকোনো সময় গোসল করা যেতে পারে। তবে এর সাথে করোনাভাইরাসের কোন সম্পর্ক নেই।
৬. মশার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে
এখন পর্যন্ত এমন কোন প্রমান পাওয়া যায়নি যে মশার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়। করোনাভাইরাস শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস এবং মানুষের হাচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। ধারণা করা হয় আক্রান্ত ব্যক্তির মাত্র একবারের হাচি বা কাশির মাধ্যমে ৩০০০ করোনাভাইরাস বের হতে পারে। সুতরাং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে হাচি কাশির সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে আর টিস্যু না থাকলে জামার হাতা দিয়ে মুখ ঢাকতে হবে।
৭. অতিবেগুনী রশ্মি করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি দেয়
অতিবেগুনী রশ্মি শরীরের কোন নির্দিষ্ট অংশে প্রয়োগ করে জীবাণুমুক্ত করা যায় এমন একটি ভ্রান্ত ধারণার প্রচলন রয়েছে। মূলত অতিবেগুনী রশ্মির সাথে করোনাভাইরাসের কোন সম্পর্ক নেই।
৮. থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে করোনাভাইরাস সনাক্ত করা যায়
থার্মাল স্ক্যানার ব্যবহার করা হয় জ্বর হয়েছে কিনা সনাক্ত করার জন্য। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গ হিসেবে জ্বর এবং শুকনো কাশি হয়ে থাকে। আর এ কারনে এয়ারপোর্ট এবং অফিস আদালতে থার্মাল স্ক্যানার ব্যবহার করা হয় কারো জ্বর হয়েছে কিনা দ্রুত সনাক্ত করার জন্য।
৯. সারা শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন স্প্রে করে করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করা সম্ভব
করোনাভাইরাস যদি শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে তাহলে সারা শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন স্প্রে করে কোনও লাভ নেই বরং এগুলো চোখ এবং মুখের জন্য ক্ষতিকর। তবে দরজার হাতল, মেঝে এবং অন্যান্য পৃষ্ঠতল জীবাণুমুক্ত করার কাজে নির্দিষ্ট পরিমানে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন ব্যবহার করা যেতে পারে।
১০. নিউমোনিয়ার ভাক্সিন করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করে
নিউমোনিয়ার ভাক্সিন যেমনঃ নিউমোক্ককাল ভাক্সিন এবং হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি ভাক্সিন করোনাভাইরাসের বিপক্ষে কোন কার্যকরী ভুমিকা পালন করে না। ভাইরাসটি একদমই নতুন এবং ভিন্নরকমের হওয়ায় এর জন্য নতুন ভাক্সিনের দরকার যার জন্য বিশেষজ্ঞরা কাজ করে যাচ্ছেন।
১১. নাক প্রতিনিয়ত স্যালাইন দিয়ে ধুলে বা নাকের ড্রপ ব্যবহার করলে করোনাভাইরাসের আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়
নাকের ড্রপ বা স্যালাইন পানি ব্যবহারের সাথে করোনাভাইরাস আক্রমনের কোন সম্পর্ক এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সাধারন ঠাণ্ডার ক্ষেত্রে বা নাক বন্ধ হলে গেলে সাধারনত স্যালাইন পানি ব্যবহার করা হয়।
১২. নিয়মিত রসুন খেলে করোনাভাইরাসের বিপক্ষে শরীর ভালো কাজ করে
নিঃসন্দেহে রসুন অত্যন্ত উপকারী একটি খাবার যেটা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যেসব ভাইরাসের কারনে ঠাণ্ডা বা ফ্লু হয় সেগুলোর বিরুদ্ধে রসুন ভালো কাজ করে তবে করোনাভাইরাসের বিপক্ষে রসুনের কার্যকারিতার কোনও প্রমান এখনও পাওয়া যায়নি।
১৩. করোনাভাইরাস দ্বারা বয়স্করা আক্রান্ত হয়, যুবক বা তরুণরা হয় না
যেকোনো বয়সের মানুষ করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তবে বয়স্ক এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষ (যেমন- হৃদরোগ, এজমা, ডায়াবেটিক) করোনাভাইরাস দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়।
১৪. এন্টিবায়োটিক করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী
এন্টিবায়োটিক ব্যকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ভাইরাসের বিরুদ্ধে নয়। যেহেতু করোনাভাইরাস এক শ্রেণীর ভাইরাস, সুতরাং এর প্রতিরোধ বা চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিকের কোনও ভুমিকা নেই।
১৫. করোনাভাইরাস চিকিৎসার ঔষধ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে
করোনাভাইরাস চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট ঔষধ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা কিছু বলে নাই। করোনাভাইরাসের ভ্যাক্সিন এবং চিকিৎসা কি হতে পারে এগুলো নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।
১৬. বেশী বেশী পানি পান করলে এবং মুখকে সবসময় আদ্র রাখলে করোনাভাইরাসের আক্রমন থেকে বাচা যায়
শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম ঠিক রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনাকে সচল রাখতে পর্যাপ্ত পরিমান পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া জ্বর, পেট খারাপ এবং অন্যান্য অসুস্থতার সময় পানি একটু বেশী পরিমানে পান করতে হয়। কিন্তু তাই বলে এটা বলা যাবে না যে পানি বেশী করে পান করলে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে কেননা এখন পর্যন্ত এর কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমান পাওয়া যায় নাই।
১৭. পানি পান করলে করোনাভাইরাস গলা থেকে পাকস্থলীতে নেমে আসবে এবং পাকস্থলীর এসিড ভাইরাসকে মেরে ফেলবে
পানির মাধ্যমে যদি করোনাভাইরাস গলা থেকে পাকস্থলীতে নেমে যেত তাহলে হাত ধোয়ার সময়ও সাবানের দরকার ছিল না। পানি দিয়ে ধুলেই হাত থেকে করোনাভাইরাস চলে যেত। করোনাভাইরাসের লিপিড (গ্লাইকোপ্রোটিন) আবরণ থাকে যেটা পানির সাথে মিশে না। সুতরাং এই কথার কোনও যুক্তি নাই যে পানি পান করলে করোনাভাইরাস গলা থেকে পাকস্থলীতে নেমে যাবে।
১৮. শুধুমাত্র জ্বর বা কাশি হলে করোনাভাইরাস হয় না
করোনাভাইরাসের প্রথম উপসর্গই হচ্ছে শুকনো কাশি এবং জ্বর। সাথে ক্লান্তি ভাব, মাথা ব্যথা থাকতে পারে। সুতরাং শুধু জ্বর বা কাশি হলেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা করোনাভাইরাস আক্রমনের ২ থেকে ১৪ দিনের মাথায় উপসর্গ দেখা দেয়। তাই শুধু জ্বর বা কাশি হলেও হেলাফেলা করা যাবে না বরং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেমনঃ বাসায় একাকী অবস্থান করা, বারবার হাত ধোয়া, ধূমপান না করা, সঠিক খাবার খাওয়া, ব্যয়াম করা, পর্যাপ্ত ঘুম ইত্যাদি। আর শরীর বেশী খারাপ লাগলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
১৯. মাস্ক পড়লে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে
অবশ্যই নিরাপত্তার জন্য মাস্ক পরতে হবে। তবে মাস্ক পড়লেই যে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে কথাটি ঠিক নয়। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বেশীরভাগ মানুষই মাস্ক ঠিক মতো ব্যবহার করছে না। যে মাস্কগুলো একবার ব্যবহার করার কথা সেটা একাধিক বার ব্যবহার করছে, মাস্কের সম্মুখ ভাগ বারবার হাত দিয়ে ধরছে, মাস্ক খুলে যেখানে সেখানে রেখে দিচ্ছে। এতে করে আমরা যে নিরাপত্তার জন্য মাস্ক পড়ছি সেটা রক্ষা করা হচ্ছে না। আমাদের মাস্ক ব্যবহার করার সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে অবশ্যই অবগত থাকা লাগবে।
২০. করোনাভাইরাস বাদুড়ের সুপ থেকে এসেছে
করোনাভাইরাস প্রথম দেখা যায় চিনের উহান নগরীতে। কিন্তু এর উৎপত্তি ঠিক কোথা থেকে হয়েছে সেটা এখনও জানা যায়নি এবং বাদুড়ের সুপ থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি কথাটি প্রমানিত নয়।
পরিশেষে বলবো, প্রামাণিক তথ্যের পাশাপাশি যতো ভ্রান্ত এবং অবৈজ্ঞানিক ধারণারই সৃষ্টি হোক না কেনো একটা জায়গা থেকে সবারই পরিস্কার ধারণা পাওয়ার বাসনা, “কবে পরিত্রান পাবো এই মহামারী থেকে”।
ঘরে থাকুন, পরিচ্ছন্ন থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
তথ্য সূত্র,
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এ বি সি নিউজ, বিজনেস ইনসাইডার।