রমজানে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা সমাধানে যা করতে হবে
রমজানের এই পবিত্র প্রশান্তিময় সময়ে, খোদাভীতি, সংযম ও অনেক আনন্দের মুহুর্তের সাথে গ্যাস্ট্রিকের মত সমস্যাও একইভাবে বিরাজ করে। অন্য সময়ে গ্যাস্ট্রিক ভোগালেও বিভিন্ন কারণে রমজানে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা যেন অসহনীয় হয়ে ওঠে। তবে সঠিক নিয়ম মেনে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিয়েও রোজা রাখা যায়। এই প্রবন্ধটিতে গ্যাস্ট্রিক সহ রোজায় পরিপাক ক্রিয়ার গোলযোগ সংক্রান্ত সমস্যা গুলো সম্পর্কে জানব।
বাংলাদেশে সম্ভবত গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার চেয়ে সাধারণ কোন রোগ নেই। সব বয়সেই এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকলেও, বৃদ্ধ ও মধ্যবয়স্ক মানুষেরা এই সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন। অনেকের কাছে এই গ্যাস্ট্রিক এতো সাধারন, যে তারা এটাকে কোন রোগের কাতারে ধরতে চান না। সমস্যা হলে এসিডিটির মুখন্থ ঔষধ খেয়ে চালিয়ে যান দীর্ঘদিন। যদিও এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
তবে রোজা হলো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ার আদর্শ সময়। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা তারপর, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস রোজার সময়য়ে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়িয়ে তোলে অনেকগুন। অবহেলা করলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে গ্যাস্ট্রিক আলসার, ক্যান্সার এমনকি পেট ফুটোও হয়ে যেতে পারে। তাই এই বিষয়ে জ্ঞান রাখা জরুরী। আসুন এই প্রবন্ধে রমজানে গ্যাস্ট্রিকেরর সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
গ্যাস্ট্রিক কি?
গ্যাস্ট্রক হলো আমাদের পাকস্থলি কিন্তু এটিকে রোগ নির্দেশ করতেও ব্যাবহৃত হয় । গ্যাস্ট্রিক বা গ্যাস হলো পরিপাক তন্ত্রে অতিরিক্ত এসিড নির্গমন হওয়ার কারণে পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, অস্বস্তি, বুক জ্বালা করার মত সমস্যা তৈরি হওয়া। আসুন একটু গোড়া থেকে পরিপাক তন্ত্রের প্রাথমিক কাঠামো ও কাজ আলোচনা করি, যা আপনাকে গ্যাস্ট্রিক ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার বিপদ সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করবে।
আমাদের পাকস্থলি হলো একটি মাংসল থলির মত। সেই থলির গায়ে অসংখ্য গ্রন্থি আছো যা থেকে হাইড্রোক্লোরিক এসিড সহ অন্যান্য হজমে দরকারী এনজাইম যেমন পেপসিন নিঃসৃত হয়।
এই এসিডের কাজ হলো আমাদের খাবারকে ভেঙে পরিপাক উপযোগী করা ও খাবারের সাথে আসা জীবানু গুলোকে মেরে ফেলা।
প্রশ্ন জাগতে পারে, পাকস্থলির হাইড্রোক্লোরিক এসিড সব খাবারকে হজম করে ফেলছে, কিন্তু সেটা আমাদের পাকস্থলিকেই হজম করে ফেলছে না কেন?
উত্তরটা হলো আমাদের পাকস্থলির দেওয়ালে মিউকাসের একটি স্তর আছে যা এসিড থেকে আমাদের পাকস্থলিকে রক্ষা করে। এক ধরণের ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণ বা পাকস্থলীর দীর্ঘমেয়াদী গোলযোগ এর কারণে সেই মিউকাস লাইনিং ক্ষতিগ্রস্থ হলে পাকস্থলির এসিডের কারণে সেখানে আলসার এবং পরবর্তিতে যা ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
তাহলে বুঝতেই পারছেন, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাকে যতটা হেলাফেলা করা হয় ততটা সাধারণ এটি নয। তবে গ্যাস্ট্রিকের রোগীরা সঠিক নিয়ম মেনে রোজা রাখতে পারেন। কিন্তু যাদের আলসার আছে তাদের রোজা রাখার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আলসার থেকে পরিপাক তন্ত্রে ফুটো সহ আরো জটিল সমস্যা তৈরি হতে পারে। গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত ১০-১৫ শতাংশ মানুষের গ্যস্ট্রিকে আলসার থাকে, এবং সংখ্যাটি নেহায়েত কম নয়।
গ্যাস্ট্রিক কেন হয়?
গ্যাস্ট্রিক হওয়ার মূল কারণটি হলো পাকস্থলিতে অতিরিক্ত এসিড ক্ষরন হওয়া। অতিরিক্ত এসিড পাকস্থলির দেওয়ালের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে যার কারণে শরীর পেটে ব্যাথা, অস্বস্তির মত উপসর্গ দেখায়।
এখন আসা যাক এটি শুরু হয় কেন? এডিডসিটির বিভিন্ন ট্রিগার আছে। ট্রিগার বলতে এমন ঘটনা যা এসিডিটি শুরু করে। যেমন অতিরিক্ত ঝাল ও স্পাইসি জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার, বাসি জীবানু যুক্ত খাবার, দীর্ঘসময় খাবার ছাড়া থাকা, ভাজা পোড়া ও তৈলাক্ত খাবার গ্রহন, পর্যাপ্ত পানি পান না করা ইত্যাদি। কারণ গুলো দেখেই আশা করি অনুমান করতে পারছেন কি কারণে রমজানের সময় এসিডিটি এতো বেড়ে যায়।
রমজানে রোজা রাখায় যতটা বেশি সমস্যা খাবার না খাওয়ার কারণে হয় তার চেয়ে বেশি সমস্যা হয় পানি না খাওয়ার কারণে। পর্যাপ্ত পানি পান না করলে খাবার হজম হয় না। খাবার হজমের জন্য পানি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। সেটা কার্বহাইড্রেট হোক কিংবা প্রটিন। পানি স্বল্পতায় পাকস্থলির এসিডের ঘনত্ব বেড়ে যায় যার কারণে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা তীব্র হয়ে থাকে। আসুন রোজার সাথে গ্যাস্ট্রিকের সম্পর্ক ও এর প্রতিকার জেনে আসি পরবর্তি অংশে।
রোজার সাথে গ্যাস্ট্রিকের সম্পর্ক
রোজা রাখার সাথে সাথে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস সেই সাথে নিজের গ্যাস্ট্রিক এর সম্পর্কে উদাসীন থাকা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আসুন রোজা রাখার সাথে গ্যাস্ট্রিকের সম্পর্ক জেনে নেই।
-
ইফতারিতে অতিরিক্ত ভাজা পোড়া খাবার সহজে হজম হওয়া সম্ভব হয় না। যার কারণে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে।
-
ইফতারি ও সেহেরির মাঝে একদিনে যে পরিমান পানি প্রয়োজন তা অধিকাংশ সময় পূরণ হয়। না। ইফতারিতে আর সেহরীর সময় গ্রহণ করা পানি অান্যান্য পানি স্বল্পতা যেমন দেহের বিভিন্ন অংশে ব্যাবহার হয়, হজমের জন্য যথেষ্ট পানি থাকে না। যার জন্য বদহজম, গ্যাস্ট্রিক হতে পারে।
-
একবারে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করা গ্যাস্ট্রিক ও বদহজমের কারণ হতে পারে। সেহরি বা ইফতারে অতিরিক্ত খাওয়া সবসময়ই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করলে সব খাবার একসাথে হজম করতে গিয়ে বদহজম ও ফলস্রুতিতে ডায়রিয়া হতে। রোজা রাখা অবস্থায় ডায়রীয়া হতে পারে অত্যন্ত বিপদজ্জনক। ডায়রীয়ার কারণে পানিস্বল্পতায় কিডনী ফেইলর ও নানাবিধ জটিলতা হতে পারে।
-
রোজায় আমাদের খাদ্যাভ্যাস এতো অস্বাস্থ্যকর যে সুস্থ্য মানুষই গ্যাস্টিকের সমস্যায় ভুগতে পারেন। সেখানে যাদের আগের থেকে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে তাদের জন্য তো আরো জটিল আকার ধারণ করে।
গ্যাস্ট্রিকের সাধারণ সমস্যা সমুহ
গ্যাস্ট্রিক অর্থাৎ পরিপাকতন্ত্রে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণ কিছু সমস্যার উল্লেখ করা হলো।
এসিডিটি
এসিডিটি বলতে পূর্বে উল্লেখ করা পাকস্থলিতে এসিডের আধিক্যকেই বোঝানো হয়। এসিডিটি হলে পেটে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব হয় সেই সাথে বমি হতে পারে।
বদহজম
পাকস্থলি হজমের ক্ষমতার বেশি খাবার খেলে তা বদহজমের রূপ নেয়। বদহজমের ফলে পেটে ব্যথা, বমি, ডায়রীয়া ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হয়।
হার্ট বার্ন
বুক জ্বলা বা হার্ট বার্নের সাথে হার্টের সম্পর্ক নেই। পাকস্থলির উপরে যে ভালবটি খাদ্যনালির সাথে সংযুক্ত, সেটি খুলে গেলে এসিড উপরে উঠে আসে। যার কারণে বুকের দিকে খাদ্যনালিতে যন্ত্রণা হয়। এটিও গ্যাস্ট্রিকের একটি সমস্যা।
রোজার সময়ে গ্যাস্ট্রিক প্রতিরোধে করণীয়
গ্যাস্ট্রিক রোজা রাখার ক্ষেত্রে কোন বাঁধা নয়, তবে প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও সতর্কতা। রোজার সময় গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে বাঁচতে নিচের পয়েন্টগুলো খেয়াল করুন।
-
ইফতারে ভাজা-পোড়া খাবার এড়িয়ে ফল, সবজি, ডিম, খেজুর ইত্যাদি সহজপাচ্য খাবার গ্রহণ করুন। এসব খাবারে ট্রান্স ফ্যাট থাকার কারণে এগুলো হার্টের জন্যও বিশেষভাবে ক্ষতিকর।
-
ইফতার ও সেহরীর ভেতরে কমকরে ৮ গ্লাস পানি পান করুন। নামাজ পড়ার সময় সাথে পানির বোতল রাখতে পারেন। তাছাড়া জাগ্রত সময়ে প্রতি ঘন্টায় ১ গ্লাস করে পানি পান করলে গ্যাস্ট্রিক ও পানিস্বল্পতার ঝুঁকি কমবে।
-
অতিরিক্ত মিষ্টি ও লবনাক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
-
ঝাল ও মশলাদার খাবার অনেকের ক্ষেত্রে এসিডিটির ট্রিগার হিসেবে কাজ করে। খাবার গুলো এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
-
ইফতার বা সেহরী কোন সময়ই অতিরিক্ত ভোজন সুফল বয়ে আনে না। পেট ভরে গেছে এটা বুঝতে আমাদের শরীরের কিছুটা সময় লাগে। তাই ধীরে ঠিকমতো চাবিয়ে খান। আমাদেরর লালাও এক ধরণের হজমের এনজাইম। এবং খাবার হজমের প্রক্রিয়া আমাদের মুখেই শুরু হয়ে যায়। তাই ধীরে ধীরে চিবিয়ে খেলে বদহজম ও গ্যাস্ট্রিকের সম্ভাবনা কমবে।
-
যাদের আগে থেকে গ্যাস্ট্রিক তারা সেহরী ও ইফতারের আগে গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক গ্রহণ করতে পারেন।
-
যাদের আলসার আছে, তারাও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত ঔষধ গ্রহণের মাধ্যমে রোজা রাখতে পারবেন।
-
রোজার ভেতর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা মারাত্নক আকার ধারণ করলে রোজা ভেঙে ফেলা উচিৎ। রোজা ভেঙে সঠিক ঔষধের মাধ্যমে গ্যাস্ট্রিক প্রতিকারে ব্যাবস্থা নিতে হবে। যারা রোজা রাখতে অসমর্থ তাদের রোজা ভাঙার বা না রাখার নমনীয়তা পবিত্র ইসলামে রয়েছে। তাই জেদ ধরে নিজের শরীরের ক্ষতি করবেন না।
পরিশেষ
গ্যাস্ট্রিক যেন আমাদের সাধারণ জন জীবনের অংশ। তবু রমজানের এই মহিমান্বিত মাসে কিছু অসতর্কতার কারণে ঘটতে পারে বিপদ। তাই গ্যাস্ট্রিক কে অবহেলা নয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও যথাযথ পদক্ষেপই বয়ে আনতে পারে সুস্থ্যতা।