প্রস্রাব ধরে রাখলে যে সব সমস্যা হয়!
কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ততা বা মুভি দেখার সময় টানটান উত্তেজনার কারণে, অনেকেই সঠিক সময়ে প্রস্রাবের বেগকে দমিয়ে রাখে। তবে এটি করা আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশ ক্ষতিকারক। আপনার যখনি টয়লেটে যাওয়ার দরকার মনে হবে তখনি যাওয়া উচিত।
দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততায় কিংবা নিছক আলসেমিতেই আমরা সময়ে সময়ে মূত্র বর্জন করাকে একটি তুচ্ছ ব্যাপার মনে করে হরহামেশাই অবহেলা করি। আমরা প্রায়ই শরীরের বিভিন্ন সাবধান বাণী উপেক্ষা করি, ফলশ্রুতিতে নিজেদের ঠেলে দিই বিপদের দিকে। আমি-আপনি-আমরা সবাই তুচ্ছ করে দেওয়া এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করে জীবনকে কোন ঝুঁকির মুখে ঢেলে দিচ্ছি সেটা কখনো ভেবেছেন কি? দিনে কয়েকবার মূত্র নিঃসরণ করা আমাদের সুস্থ জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক। সঠিক নিয়ম মেনে মূত্র বিসর্জন না করার ফলে আমরা কতটা বিপদের দিকে আগিয়ে যাচ্ছি তা সম্পর্কে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই !
ব্লাডার বা মূত্রাশয় কী?
ব্লাডার মূলত ইউটেরাসের দ্বারা কিডনি থেকে মূত্র গ্রহণ করে। ব্লাডার প্রসারণযোগ্য যা মূত্র দ্বারা পরিপুর্ণ হয় কিডনির অবিচ্ছিন্ন পরিস্রাবিত তরলের কারণে। আমাদের মূত্রাশয়ের ধারণক্ষমতা মুলত ১.৫ থেকে ২ কাপ তরল। যখনই আমাদের ব্লাডার তার ধারণক্ষমতা ছুঁই ছুঁই, সে আমাদের ব্রেইনে নির্দেশনা পাঠায় মূত্র বর্জনের সময় এলো বলে। সৌভাগ্যক্রমে, আমাদের বেশিরভাগেরই নিজ নিজ মূত্রাশয়ের কার্যকারিতার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তাই আমরা যখন এই চাপটি অনুভব করি তখন আমরা তাড়াতাড়িই নিজেকে উপশম করতে বা এটি ধরে রাখতে পারি। আমাদের দেশে, বিশেষ করে মহিলারা সবখানে বাথরুমে যাওয়ার সঠিকব্যবস্থার অভাবে অনেকটা সময় ধরে মূত্র চেপে রাখেন। এই প্রক্রিয়া বিভিন্ন স্কুলপর্যায় থেকে শুরু করে বড় বড় কর্মক্ষেত্রেও দেখা যায়। কিন্তু এই ফলে তারা ভবিষ্যতে কতটা বিপদে রয়েছেন তাদের কোন ধারণা নেই। এই মূত্র ধরে রাখার ফলে আমরা কিভাবে নিজেদের বিভিন্ন বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি আজ জানা যাক।
প্রস্রাব আটকে রাখার ফলে যেসব সমস্যার সমুখীন হতে হয়
১) ব্যথা অনুভব করা
সাধারণত যখন অনেক সময় ধরে প্রসাব চেপে থাকা হয়, পরবর্তীতে মূত্র বিসর্জনের সময় ব্যাথা অনুভূত হতে পারে। আপনি যদি সবসময় মূত্র বিসর্জনের ব্যাপারটা উপেক্ষা করেন- প্রায়শই ব্লাডারে কিংবা কিডনিতে বিভিন্নরকমের ব্যাথা অনুভব করতে পারেন। এইসব ব্যাথা দেখা দিলে দেরি না করি ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। বেশি করে পানি সেবন এবং বিভিন্ন ব্যয়াম করা উচিত।
২) ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন (UTI)
অনেকক্ষণ ধরে প্রস্রাব আটকিয়ে রাখার ফলে ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে যার পরিণামে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন (UTI) হতে পারে। ছেলেদের থেকে মেয়েদের UTI তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদিও ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের সঠিক কারণ কোন রিসার্চেই ধরা পড়েনি তবুও ডাক্তাররা এটি রোধে প্রস্রাব না আটকিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আপনার যদি তরল পদার্থ কম সেবনের অভ্যাস থাকে তবে আপনার UTI হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে। প্রস্রাবের সময় জ্বালা-পোড়া, শ্রোনী বা তলদেশে ব্যাথা অনুভব, মূত্রাশয় খালি করার অবিরাম ইচ্ছা, প্রস্রাবের সাথে রক্তপাত – এইসবই UTI এর লক্ষণ। সাধারণত চিকিৎসকরা এ্যান্টিবায়োটিকের সহায়তায় UTI এর চিকিৎসা করে থাকেন। সঠিকভাবে এ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলে UTI থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
৩) মূত্রাশয়ের বিস্ফোরণ
এটি যদিও সকলের ক্ষেত্রে ঘটে না তবে যারা অনেক বেশি প্রসাব চেপে থাকেন তাদের অনেকেরই মূত্রাশয়ের বিস্ফোরণ দেখা দিতে পারে। মূত্রাশয় যখন বিস্ফোরিত হবে তখন প্রস্রাব এবডোমেনে পৌঁছে যাবে। এই ঘটনা ঘটলে একদম সময় ব্যয় না করে সার্জারি করে ফেলতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর কারণে ব্লাডারের পেশীগুলি অনেক দুর্বল হয়ে পড়বে এবং পরবর্তীতে প্রস্রাবের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। দেরি না করে যথাসম্ভব সার্জারি করলে এবং চিকিৎসকের আওতায় থাকলে এই সমস্যার সঠিক উপায় পাওয়া সম্ভব।
৪) প্রস্রাবে অসংযম
প্রস্রাবে অসংযমতার মত অস্বস্তিকর অবস্থা দ্বিতীয় আরেকটি হতে পারে না। এর দরুণ হাঁচি-কাশি, অনেক সময় একটু বেশি হাসলে ও ভারী কোন কাজ করলেও প্রস্রাব বের হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় বার বার প্রস্রাব করার পরিণতি হতে পারে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে ঘনঘন প্রস্রাব করার অভিজ্ঞতা হতে পারে কারণ মূত্রাশয় সম্পূর্ণরুপে খালি হয় না। এরুপ হলে, সঠিক ওজন বজায় রাখা খুব দরকার। সেই সাথে শ্রোণী তল পেশীর (Pelvic floor muscles) ব্যয়াম ও বেশি বেশি আঁশজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। কফি, অ্যালকোহল, ধূমপান থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
৫) কিডনিতে পাথর
কিডনিতে পাথর গঠিত হয় যখন রক্তে বর্জ্য পণ্যগুলি স্ফটিক হয় এবং সময়ের সাথে সাথে এদের বিকাশ ঘটে। আপনি যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল পান না করেন এবং আপনি যদি প্রায়শই প্রস্রাব আটকে রাখেন তবে কিডনিতে পাথর হবার ঝুঁকি অনেকবেশি রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিডনিতে পাওয়া পাথরগুলি খুব ক্ষুদ্র হয় - ব্যথাযুক্ত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এই পাথরগুলো অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। পিঠে ব্যাথা, আপনার পেছনের অংশে অবিরাম ব্যথা অনুভব করতে পারা বমি বমি ভাব, - এইসব আপনার যদি কিডনির পাথর থাকার লক্ষণ। এমতাবস্থায় দ্রুত চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত কারণ কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার অনেক বেশি সম্ভাবনা থাকে।
৬) মূত্রাশয় প্রসারিত হওয়া
অনেক্ষন ধরে প্রস্রাব চেপে রাখার ফলে মূত্রাশয় প্রসারিত হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনার মূত্রাশয়টি খুব পরিপূর্ণ হয়ে যাবে এবং প্রস্রাব তখন পেশী এবং ঝিল্লিগুলির চারপাশকে প্রসারিত করে তুলবে- ব্যাপারটি অনেকটা বেলুনের মধ্যে পানির মতো। তবে যখন এটি একবার ঘটে যায় তখন কারো পক্ষেই ভবিষ্যতে প্রস্রাব স্বাভাবিকভাবে বর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে কারণ মূত্রাশয়টি আর কখনওই মূল আকারে ফিরে আসে না। এক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা ক্যাথেডার বা পাতলা রাবার টিউব ঢুকিয়ে রাখেন যাতে ধরে রাখা প্রস্রাব অপসারণ করতে পারে।
৭) পেলভিক ফ্লোর বা শ্রোণী তল পেশীর ক্ষতি
পেলভিক ফ্লোর পেশীগুলি দুই পায়ের মধ্যে অবস্থিত, মেরুদণ্ডের গোড়ায় সামনের পিউবিকব হাড় থেকে বিদ্যমান। এগুলি মূলত আপনার মূত্রাশয় সহ সমস্ত শ্রোণী অঙ্গকে ধরে রাখে। আপনি যখন ঘন ঘন আপনার প্রস্রাব ধরে রাখেন, পেশী দুর্বল হয়ে পড়ে। এই পেশীগুলোতে শক্তি বজায় রাখার জন্য আপনাকে যখনই প্রয়োজন হবে তখন মূত্র বর্জন করতে হবে এবং শ্রোনীতল পেশীর ব্যায়ামগুলি অনুশীলন করতে হবে।
৮) মূত্রনালীর কাঠামোর ক্ষতিসাধন
দিনে কয়েকবার মূত্র বিসর্জন না করলে মূত্রনালির কাঠামোতে তারতম্য দেখা দিতে পারে। মুত্রনালির কাঠামোর ক্ষতিসাধনের ফলে শরীরে বিভিন্নরকম সমস্যা দেখে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অবস্থা এড়াতে সঠিক পরিমানে তরল সেবন এবং দিনে কয়েকবার প্রস্রাব করা আবশ্যক। মুত্রনালীর কাঠামো বজায় রাখতে বিভিন্ন ব্যয়াম এবন যোগাসন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
যদিও প্রস্রাব চেপে রাখা ঠিক নয় তবে কিছু কিছু সময়ে প্রস্রাব ধরে রাখা আমাদের জন্য অনেক জরুরি। সেইসব সময়ের জন্যে কিছু টিপস হলোঃ
-
এবডোমেন কিংবা তলদেশে চাপ পড়লে প্রস্রাব করার তাগিদ প্রবল থাকে সেই জন্য উচিত দুই’পাএকত্রে করে বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকা, সেই ক্ষেত্রে প্রস্রাব করার তাগিদ কম অনুভুত হবে।
-
যতটা সম্ভব নড়াচড়া কম করতে হবে। তাহলে ব্লাডারের চাপ কম অনুভুত হবে।
-
নিজেকে ব্যস্ত রাখা। যেমন মানুষের সাথে কথা বলা কিংবা বই পড়া এই ক্ষেত্রে অন্যমনস্ক থাকতে সাহায্য করবে।
পরিশেষে, প্রস্রাব চেপে রাখা আমাদের জন্য বিশাল ক্ষতিকারক। আমাদের উচিত নিছক আলসেমি কিংবা অপ্রয়োজনীয় ভেবে সচারচ প্রস্রাব আটকে না রেখে সময়ের অন্তর অন্তর প্রস্রাব ত্যাগ করা। দিনে ৭ থেকে ৮ গ্লাস (২ লিটারের মত) পানি পান করা এবং যতবার মূত্রাশয়ে চাপ অনুভব করবেন ততবার মূত্রত্যাগ করা সুস্থ- স্বাভাবিক জীবনের জন্য খুবই দরকারি। সকলের উচিত এইসব নিয়ম বিধি মেনে চলা, যার দরুণ এইসব সমস্যা সহজেই উপেক্ষা করে সুস্থ জীবন অতিবাহিত করা সম্ভব।