কেন ইন্টারনেট আসক্তি মাদকের চেয়েও ভয়াবহ? পর্ব-২

ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে সচেতনতা মূলক ধারাবাহিক লেখার এটি ২য় পর্ব। ইন্টারনেট আসক্তির প্রকারভেদ, ইন্টারনেট আসক্তির বাংলাদেশ ও বিশ্বের নানারকমের পরিসংখ্যান হচ্ছে আজকের প্রতিপাদ্য বিষয়

 

"ইন্টারনেট হচ্ছে দুর্গম জঙ্গলের মত, যেখানে কোন নিয়ম-নীতি নেই" --- স্টিভেন রাইট  

ইন্টারনেট আসক্তির ধরণ বা প্রকারভেদ

মাদকাসক্তের মতো, আপনি যখন অতি মাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এর ফলেও কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নামক একটা নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ হয়। আর এই কারণে আপনার কর্ম ক্ষমতাকে দূর্বল করে তুলে ও আপনার মানসিক প্রভাবের ফলে স্বাভাবিক ভাবনা-চিন্তায় পরিবর্তন নিয়ে আসে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি

বিশ্বের সকল দেশে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে ফেসবুক, লিংকডিন, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম অন্যতম। আর সব থেকে জনপ্রিয় মাধ্যম হলো ফেসবুক। ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি ব্যবহারকারী হলো তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েরা। বিভিন্ন পোস্ট করা, ব্যক্তিগত মতামত ও মানসিক পরিস্থিতি নিজের টাইমলাইনে শেয়ার করা, ভিডিও ও ছবি আপলোড, লাইভ ভিডিও করা এবং চ্যাটিংসহ আরো অনেক কিছু নিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে সময় কেটে যায়।  

অতীতে ক্যামেরা থাকলেও মানুষ খুব বেশি ছবি তুলতো না, কেবল কোন অনুষ্ঠানে বা বিশেষ কাজে ছবি তুলতো। কিন্তু এখন স্মার্টফোন হাতে পাবার পর সবাই প্রতিদিন শতশত ছবি ওঠানোতে ব্যস্ত। এছাড়া অনেকে নানা রকম অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সেলফি তুলে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে। প্রতিদিন তাদের বিভিন্ন মুহুর্তের ভাবমূর্তি  টাইমলাইনে প্রকাশ না করতে পারলে যেনো চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ নিজে না প্রকাশ করলেও অন্যান্যদের পোস্ট দেখে দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে। আর এমন অতিমাত্রায় ফেসবুক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় আসক্তি। বর্তমানে ফেসবুক আসক্তি খুবই বড় একটি ডিসঅর্ডার।

সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও দেখার প্লাটফর্ম হচ্ছে ইউটিউব। স্ট্যাটিস্টার মে ২০১৯ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি মিনিটে ৫০০ ঘন্টার বেশি রেঞ্জ এর ভিডিও ইউটিউবে আপলোড হয় এবং ঘন্টায় প্রায় ৩০ হাজার ঘন্টার মত নতুন ভিডিও কনেটন্ট আপলোড হয়। হাজারো রকমের বিষয় নিয়ে এসব ভিডিও দর্শকদের আনন্দ দেয় এবং দীর্ঘ সময়  ধরে একটার পর একটা নতুন ভিডিও স্ক্রিনে চলতে থাকে। এর ফলে তৈরি হওয়া আসক্তি ব্যক্তি  জীবনে, কর্মজীবনে নানা সমস্যা ডেকে আনে।

অনলাইন/ ইন্টারনেট গেম আসক্তি

তরুণদের কাছে অনলাইনে ভিডিও গেম খেলা নিত্য দিনের সঙ্গী। বাড়িতে কিংবা গাড়িতে, স্কুলে-কলেজে কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় মোবাইলে ভিডিও গেম খেলায় ব্যস্ত হয়ে যায়। গেমস গুলোতে মূলত মারামারি, রক্তপাত ও উত্তেজনাপূর্ণ রসদ দিয়ে এসব গেম তৈরি করা হয়। যার ফলে যারা গেম খেলে তাদের মধ্যে জিঘাংসা, জেদ, রাগ ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত ভিডিও গেম খেলার কারণে শরীরে একজাতীয় হরমোন নিঃসৃত হয়। এতে গেমারদের মন মেজাজ কিছুকালের জন্য উত্তেজনাপূর্ণ ও ভিডিও গেমসের উস্কানিমূলক বৈশিষ্ট্যের জন্য তাদের মানসিক প্রভাব পড়ে। পরবর্তীতে তা তাদের আচরণে পরিবর্তন আনে। বাবা-মা ও অভিবাবকদের অবাধ্য হয়ে যায়। দীর্ঘকাল এ গেমসে পড়ে থাকলে তারা চরমভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।

পর্ণোগ্রাফি বা সাইবার সেক্স আসক্তি

পর্ন ওয়েবসাইটে ভিজিট করা বা পর্ণ ভিডিও দেখে না এমন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই কম। ইন্টারনেট আসক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর আসক্তি হলো পর্ণো আসক্তি। গবেষণায় দেখা যায়, পর্ণোগ্রাফীর এই আসক্তি মষ্কিস্কের পিছনের দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। এইজন্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা বারবার নতুন যৌণ আকাঙ্খায় অতৃপ্ত হয়ে ওঠে ও ধীরে ধীরে হিরোইন আসক্তির মতো তার মধ্যে পর্ণোআসক্তি তৈরি হয়।

পর্ণাসক্তির ফলে অনেক পুরুষের স্ত্রী থাকা সত্বেও সে অন্য নারীদের সঙ্গে যৌণ মিলনে যেতে চায় এবং সে সুযোগ না থাকলে নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে যৌণকর্মীদের সাথে মিলিত হয়। নারীদের ক্ষেত্রেও তারা স্বামী বিদ্যমান থাকলেও অসংখ্য ছেলে বন্ধুদের সাথে কথা বলা, ঘুরতে যাওয়া ও অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়। এমনকি কেউ কেউ একাধিক বিবাহ ও সম্পর্কে জড়ায়। 

বিশেষ করে কিছু পর্ণো আসক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে যারা ভার্চুয়াল সেক্স করার জন্য বিভিন্ন সাইবার সেক্স সাইট ভিজিট করে থাকেন। আমাদের সমাজে পর্ণোআসক্তি একটি মারাত্মক ব্যাধি। এর ফলে নারী নির্যাতন, যৌণ হয়রানি, নারীদের উত্যেক্ত করা এবং শিশুদেরকে পর্যন্ত রেপ করছে। সমাজে এমন ভয়ানক আসক্তির ফলে দিনের পর দিন অপরাধ প্রবণতা বেড়েই যাচ্ছে।

অনলাইন অডিও ও ভিডিও চ্যাটিং

অসংখ্য মেসেঞ্জার রয়েছে যেগুলো মানুষের সাথে দূর-দূরান্তে থেকে কথা বলার জন্য বিশ্বব্যাপী খুবই জনপ্রিয়। এসব মেসেঞ্জারে তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা প্রিয় ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে কাটিয়ে দেয়। এছাড়া ঘরে-বাইরে, রাস্তায়, রেস্তুরায়, কর্মক্ষেত্রে, ক্লাসরুমে, গাড়িতে ও যেকোন জায়গায় যেকোন মুহুর্তে বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয় মানুষদের সাথে চ্যাটিং করতে থাকে। 

যার ফলে সবধরনের কাজে ব্যাঘাত ঘটে এবং কথা বলার সময় বিভিন্ন পরিস্থিতি অনুযায়ী তাদের মেজাজের পরিবর্তন হয় এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। এমনকি সম্পর্কে ভুলবুঝাবুঝি ও দীর্ঘসময় ধরে কথা বলার ফলে একে অন্যের প্রতি বিরূপ ধারনার জন্ম হয়। অনেক ব্যক্তিকে দেখা গেছে মুহুর্তের মধ্যে তার আচরণে বিস্তর পরিবর্তন হয়ে গেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে চ্যাটিং করতে করতে রাস্তা পারাপারের সময় সড়ক দুর্ঘটনাও ঘটে।

অনলাইন শপিং

বিশ্বজুড়ে আজকাল শপিং করার নতুন প্লাটফর্ম হচ্ছে অনলাইন শপিং প্লাটফর্ম। অ্যামাজন, আলীবাবা, দারাজ এর মতো অসংখ্য অনলাইন শপিং এর ওয়েবসাইট রয়েছে। যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহার করার মাধ্যমে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করে বিভিন্ন পন্য কেনার জন্যে। এমনকি কেউ কেউ প্রয়োজন ছাড়াও অনেক কেনাকাটা করে। যারা নিয়মিত ঘরে বসে অনলাইনে প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে শপিং করে তাদের এটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এছাড়া অনলাইন শপিং ওয়েবসাইট গুলোতে সর্বদা বিভিন্ন ডিসকাউন্ট পদ্ধতিতে কাস্টমারদের বারবার ভিজিট করতে আকৃষ্ট করে। আর এভাবেই গড়ে ওঠে অনলাইন শপিং আসক্তি। অন্যান্য অনলাইন আসক্তির মতো শপিং করার নেশাও কম নেশা নয়। 

ইন্টারনেট আসক্তির ক্ষেত্রে বিশ্ব তথ্য

সাড়া পৃথিবীতে ইন্টারনেটের অত্যাধিক জনপ্রিয়তা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপক প্রসারতার কারণে বিশ্বের অসংখ্য  প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, ইন্টারনেট এর সুষ্ঠু ব্যবহারের স্থলে অপব্যবহারই বেশি হয় এবং এটির ফলে সংগঠিত হয় বিভিন্ন রকমের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। ইন্টারনেট পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে সম্ভাব্য কিছু আসক্তিমূলক কাজে নিযুক্ত করছে। যেমন- শপিং, গ্যামব্লিং, চ্যাটিংঅনলাইন নির্ভর সম্পর্ক তৈরি, অনলাইন ভিত্তিক নানা রকম খেলাধূলা, তথ্য অনুসন্ধান এবং পর্নোগ্রাফির। 

  • জুলাই ২০১৯ এর ডিজিটাল অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড এর রিপোর্ট অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যা ৭৭১ কোটি, স্বতন্ত্র মোবাইল ব্যবহারকারী ৫১১ কোটি, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৪৩৩ কোটি, সক্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী ৩৫৩ কোটি, মোবাইলে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী ৩৪৬ কোটি।

  • সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা হচ্ছে মোট জনসংখ্যার ৫৭%।

  • মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৫০.৬%, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৪৫.৫%, ট্যাবলেটে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩.৭৫%।

  • প্রতিদিন ৯ লাখ নতুন ইন্টারনেট ব্যববহারকারী যুক্ত হচ্ছে।

  • বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রতিদিন গড়ে ৬ ঘন্টা ৪২ মিনিট সময় ব্যয় করেন। 

  • ৮-১০ বছর বয়সী শিশুরা বিভিন্ন রকমের ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ৮ ঘন্টা সময় ব্যয় করে এবং ১০-১৮ বছরের শিশু-কিশোররা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে দৈনিক গড়ে ১১ ঘন্টা ব্যয় করে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যা ইন্টারনেটে কি নিয়ে এতো সময় কাটিয়ে দিচ্ছে? বিভিন্ন মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারের তথ্য পরিক্রমা,

  • ৩৪৮ কোটি বা ৪৫% জনসংখ্যা সক্রিয় সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী।

  • প্রায় ২৪৫ কোটি মানুষ এই মাধ্যমের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। 

  • অক্টোবর ২০১৮ এর এক রিপোর্ট অনুসারে ভারত, আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া ফেসবুক ব্যবহারে অগ্রগামী ছিল।

  • ইনস্টগ্রাম এর উপর জুন ২০১৮ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিমাসে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে।

  • ইনস্টগ্রামের অধিকাংশ ব্যবহারকারী বাড়ন্ত বয়সী।

  • ইন্টানেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৯০% মানুষ যেকোন ডিভাইসে ভিডিও দেখে সময় কাটায়। এর মধ্যে প্রায় ৩০% ব্যবহারকারী শুধু ইউটিউব এ ভিডিও দেখে।

  • সারা পৃথিবীতে ইউটিউব ব্যবহার করে এমন মানুষের সংখ্যা ১৬০ কোটিরও বেশি।

  • গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে মাসে ১ বিলিয়ন সক্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী রয়েছে।

  • বিশ্বব্যাপী হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিমাসে প্রায় ১৬ কোটি।

  • প্রত্যেক ব্যক্তির সার্চ ইঞ্জিনে ইন্টারনেট ব্যবহারকৃত গড় সময় ৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ড এবং গড়ে ৮.৫৭ টি পেইজ ভিজিট করে।

  • জনপ্রতি গড়ে ২১ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড ইউটিউব ব্যবহার করে এবং গড়ে ৮.৯৪ টি  ভিডিও দেখে।

  • উইকিপিডিয়ায় দৈনিক গড়ে ৩০ মিনিট ৪০ সেকেন্ড ব্যয় হয়।

  • প্রায় ৬০% অনলাইন সেক্স আসক্তি আসে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে। 

  • সব থেকে বেশি পর্নসাইটে ভিজিট করা হয় রাত ১২ টা থেকে ২টার মধ্যে।

  • ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে ২৫% ভিজিটর, ২৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে ৩৬% ভিজিটর, ৩৫ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে ১৭% ভিজিটর, ৪৫ থেকে ৫৪ বছরের মধ্যে  ১১% ভিজিটর পর্নসাইটে ভিজিট করে।

  • একটি অতি জনপ্রিয় পর্নসাইটের রিভিউ  ২০১৯ অনুযায়ী, সারাবছরে ভিজিটের সংখ্যা ৪২ বিলিয়ন, প্রতিদিন ভিজিটের সংখ্যা ১১.৫  কোটি, সারা বছরে ভিডিও আপলোড করা হয়েছে ৬৮.৩ লাখ, ভিডিওর সাইজ ১৩ লাখ ঘন্টা বা দেখতে টানা ১৬৯ বছর লেগে যাবে। উক্ত সাইটের রিভিউতে দেখানো হয় প্রতিবার ভিজিটে গড়ে ১০ মিনিট ২৮ সেকেন্ট সময় অতিবাহিত করে এসব ভিডিও দেখে।

  • সারা পৃথিবীতে অনলাইনে গেম খেলার জন্য একজন সপ্তাহে গড়ে ৭ ঘন্টা ৭ মিনিট ব্যয় করে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার ও ইন্টারনেটে আসক্তির চিত্র

ইন্টারনেট আসক্তির বিশ্ব পরিসংখ্যান দেখে চোখ কপালে উঠতেই পারে। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠের কথা যদি ভাবা হয় তাহলে বলতে হবে আমাদের দেশেও সেই পরিসংখ্যান খুব সুখবর দিচ্ছে না। কারণ একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও এদেশের প্রযুক্তিগত উন্নতির নাম করে যেসব ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বর্তমান বাজারে এসেছে তা কি কেবল তথ্য ও যোগাযোগের উন্নয়ন তরাণ্বিত করছে? নাকি এ প্রযুক্তি আমাদের জন্য এক ভয়ংকর অভিশাপও বটে?

কম্পিউটার ও ল্যাপটপে ইন্টারনেট ব্যবহার প্রারম্ভে শুধুই বাণিজ্যিক এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে আমাদের দেশের মানুষের ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহ ও জনপ্রিয়তার জন্যে কিছু উন্নত দেশের চেয়েও বেশি পরিমাণ আসক্তি চিত্র ফুটে ওঠেছে।  এই ধরনের স্ক্রিন আসক্তি যে শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সীমাবদ্ধ তা নয় বরং কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে ছোট শিশুদের মধ্যে পর্যন্ত তা বিরাজ করছে। 

আজকাল প্রবীণদেরকেও দেখা যায় সেই প্রজন্মের সাথে উপযোগী হওয়ার জন্যে কিংবা নেহাত কৌতুহলের ছলে ইন্টারনেট ব্যবহার করা এবং সহজলভ্য সকল এক্সেস হাতের নাগালে পেয়েও তারা একধরনের ভাললাগা নামক নেশায় ডুবে যায়। তবে আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ডিভাইসগুলোর মধ্যে টিভি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ এর চেয়ে অত্যাধিক সহজলভ্য এবং আকর্ষণীয় ডিভাইস হলো মোবাইল বা স্মার্টফোন। 

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা প্রায়শই দেখি পাঁচ মাসের একটা শিশু কান্না করছে বলে তার মা-বাবা তাকে শান্ত করার জন্য তাদের হাতে থাকা মোবাইল ফোনের ভিডিও প্রদর্শণ করছে। যেহেতু শিশুদের চোখে আকর্ষণীয় বস্তু সবসময়ই আগ্রহের বিষয় তাই ধীরে ধীরে সেই শিশুটিই একটা মন্দ অভ্যাস গড়ে তোলে এবং কয়েক বছর হবার পর সে আর ওই মোবাইলে থাকা গেমস, ভিডিও দেখা ও নিত্যনতুন বিনোদনের স্বাদ পেতে পেতে একসময় সক্রিয় আসক্তিতে পরিণত হয়।

  • বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ২০১৯ অনুসারে, ১৬ কোটি, ৮০ লাখ, ৬৫ হাজার, ৯২০ জন।

  • বিশ্বব্যাংকের ২০১১ সালে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৪.৫ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতো। যা ২০১৪ সালে দুইগুণ বেড়ে গিয়ে ৯.৫ শতাংশে দাড়িয়েছে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লাখের উপরে, যা মোট জনসংখ্যার ৩১.৯ শতাংশ মানুষ ইন্টারটের আওতাভুক্ত।

  • বিটিআরসি এর জুন ২০১৯ তথ্যমতে, ৯ কোটি, ৬১ লাখ, ৯৯ হাজার মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ৫৭.২% মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সাথে সংযুক্ত।

  • মোট মোবাইল ব্যবহারকারী রয়েছে প্রায় ১০ কোটিরও অধিক।

  • মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৫ ভাগ ব্যবহারকারী হচ্ছে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী।

  • ইউনিসেফ বাংলাদেশ’র এক জরিপে দেখানো হয়, ‘এদেশের ২৫ ভাগ শিশু যাদের বয়স ১০ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শুরু করে। তাদের মধ্যে ৬৩ ভাগ শিশু নিজেদের পছন্দ মতো ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

  • বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়নেরও অধিক সক্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী রয়েছে। 

  • বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ২.৮ কোটি বেশি মানুষ মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে।

  • কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা যথাক্রমে প্রায় ৬০% থেকে ৭০% মানুষই এডাল্ট সাইটে যাওয়া-আসা করে।

  • বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায় আমাদের দেশের একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দৈনিক গড়ে ১৫০ বার ফোনের স্ক্রিন চ্যাক করে।

  • বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে যাদের বয়স ১১-১৫ বছর তাদের মধ্যে অনলাইন গেমিং, ভিডিও দেখা ও ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়।

  • ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েরা সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন গেমিং, অনলাইন চ্যাটিং, ভিডিও দেখা, অনলাইনে জুয়া খেলা, তথ্য অনুসন্ধান করা ও পর্ণো ভিডিও দেখায় তাদের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে।

উপরোক্ত পরিসংখ্যান থেকে এইটা পরিষ্কার যে, ইন্টারনেটের ব্যবহার ও ব্যাপ্তি অনেক। আমাদের জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে এর ছোঁয়া লাগেনি। শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ পর্যন্ত সবার হাতের নাগালে ইন্টারনেট। যার ফলে ইন্টারনেট আসক্তির মাত্রাটা এত বেশি।   

ইন্টারনেটের ব্যবহারের পরিসংখ্যান দেখে নিশ্চয় ভিরমি খেয়ে গেছেন! সমস্যা আছে, আছে এর প্রতিকার ও সমাধান। তাই আগামী পর্বে ইন্টারনেট আসক্তির প্রভাব, প্রতিকার ও সমাধান নিয়ে থাকছে ৩য় ও শেষ পর্ব...  


 

Default user image

মোঃ অলিউল্লাহ, লেখক, আস্থা লাইফ

সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এর পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের একজন লেখক। বিডিজবস.কম এ কনটেন্ট ডেভেলপার হিসাবে দায়িত্বরত আছি। সবধরনের লেখালেখি, গবেষণা ও বিশ্লেষণ করতে আমার ভাললাগে। মেডিকেল সাইন্স ও মেডিসিনের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ও দূর্বলতা থেকেই “আস্থা লাইফ” এর নাম শুনামাত্র কাজ করার জন্যে রাজি হয়ে যাই। একজন সচেতন মানুষ হিসাবে আমার দায়িত্ব মানুষকে শারীরিকভাবে সচেতন হতে সহায়তা করা। আর সেজন্যে “আস্থা লাইফ” এ কাজ করার থেকে ভাল প্লাটফর্ম আর হতে পারেনা।

Related Articles