পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধের উপায়!

পানি বাচ্চাদের জন্য খেলার এক মজাদার জিনিস, তবে এটি মারাত্মকও হতে পারে। আমরা সকলেই আমাদের বাচ্চাদের সুরক্ষিত রাখতে চেষ্টা করি। তাই ডুবে যাওয়ার মতো শিশুদের মারাত্নক দুর্ঘটনা জনিত কারণগুলি কীভাবে রোধ করা যায় তা জানা আমাদের খুবই জরুরী।

নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্যা নদী নালা খাল বিল। গ্রামের দিকে গেলে একেক বাড়িতে এক বা একাধিক পুকুর, দিঘি কিংবা ডোবা। জলপানির সাথে আমাদের এক নিবিড় সম্পর্ক। 

কিন্তু এই নিবিড় সম্পর্কও কখনো কখনো কাল হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান একটি কারণ হল পানিতে ডুবে মৃত্যু। এর মধ্যে বেশির ভাগ মৃত্যুই ঘটে বাড়ির পাশের পুকুরে কিংবা স্কুলের পাশের ডোবায়, বাবা মায়ের হাত বাড়ানো দূরত্বে। শিশুদের জন্য  অল্পস্বল্প পানি আছে এমন পুকুর ডোবাই হতে পারে এক ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ। 

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে দিনে প্রায় ৫০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। আর এসব ঘটনা গ্রামাঞ্চলেই বেশি ঘটে। দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে, সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এসব দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। কারণ সহজেই অনুমেয়। এই সময়ে বাচ্চাদের মায়েরা ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকে। বাবারা কাজেকর্মে ঘরের বাইরে থাকে। ফলে বাচ্চার দিকে খেয়াল করার মত লোক থাকে না। সঠিক তত্ত্বাবধান ও শিক্ষার অভাব, মায়েদের অসচেতনতা, নিম্নবিত্ত পরিবার এক্ষেত্রে রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। অথচ একটু সতর্কতা অবলম্বন করলেই আমরা এসব দুর্ঘটনা এড়াতে পারি। 

 

গরমে আপনার শিশুকে সুস্থ রাখতে ৯টি টিপস

 

সতর্ক থাকুন, সন্তানকে নিরাপদ রাখুন 

পানি এবং এ সম্পর্কিত সুরক্ষা নিয়ে আমাদের সবারই সচেতন থাকা উচিত, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। প্রতি বছর আমাদের দেশে অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। শুধুমাত্র আমাদের অসচেতনতা এবং অবজ্ঞার কারণে মূল্যবান অনেক জীবন অচিরেই হারিয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র বড় নদী বা পুকুরে ডুবেই যে মৃত্যু হচ্ছে তা নয়, সুইমিং পুল, বাথটাব এমনকি এক বালতি পানিও আপনার সন্তানের জন্য বিপদজনক হতে পারে।

পানির প্রাকৃতিক উৎস

পুকুর, খাল বিল, নদী নালায় সাঁতার কাটতে গিয়ে প্রতি বছর কত যে শিশু মারা যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। পানির এসব প্রাকৃতিক উৎসের ক্ষেত্রে পানির তাপমাত্রা, স্রোত, আবহাওয়া এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গ্রাম গঞ্জে পানিতে ভেসে থাকতে পারলেই সাঁতার শেখা হয়ে গেছে বলে ধরে নেয়া হয়। যেটা কোনোমতেই উচিত নয়। ভালো ভাবে সাঁতার না জানা শিশুকে কোনো মতেই  পুকুরে গোসল করতে পাঠানো যাবে না। টিউবওয়েল কিংবা পুকুরের তোলা পানিতে গোসল করাতে হবে। 

সমুদ্র/নদী

সমুদ্রে বা নদীতে সাঁতার কাটার আগে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরে নিতে হবে। বাচ্চা কিংবা বড় সবার জন্যই এই নিয়ম প্রযোজ্য। বায়ুভর্তি যেসব সুইমিং এইড পাওয়া যায় তা কখনোই লাইফ জ্যাকেটের বিকল্প নয়। 

বাচ্চাদের নিয়ে সমুদ্রে নামার আগে অবশ্যই সৈকতে থাকা সতর্কতা বানী পড়ে নিন। জোয়ার ভাটার টাইমটেবল, কোথায় সাঁতার কাটা নিরাপদ, কোথায় নামা বিপদজনক এসব জেনে নিয়ে তবেই সমুদ্রে নামুন। 

বাথরুম

ঘরে ছোট বাচ্চা থাকলে বাথরুমের দরজা সব সময় লক করে রাখতে হবে। 

কখনো কোনো অবস্থায়ই আপনার শিশু সন্তানকে বাথরুমে একা ছাড়বেন না। বাচ্চাকে গোসল করাচ্ছেন, এমন সময় হয়ত একটা জরুরি ফোন এল কিংবা কেউ ঘরের বেল বাজাল, যাই হোক না কেন সন্তানকে বাথরুমের বাইরে রেখে যেতে হবে। 

বাথরুমে রাখা বাথটাব, বালতি কিংবা পানি ভর্তি কনটেইনার শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন। সম্ভব হলে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখুন। কমোডের ঢাকনাও ব্যবহারের পর বন্ধ করে রাখতে হবে। 

 

কেন গোসল বা বাথরুমে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক ঘটে?

গোসলের বিজ্ঞানসম্মত ১০টি উপকারী দিক!

 

সুইমিং পুল

আজকাল শহরের কিছু কিছু বাড়ির ছাদে কিংবা বাড়ির পিছনে সুইমিং পুল কিংবা পানি ভর্তি চৌবাচ্চা থাকতে দেখা যায়। আবার অনেক বাড়িতে সৌন্দর্য বর্ধনকারী মাছের চৌবাচ্চা বা খোলা একুরিয়াম থাকে। 

বাচ্চাদের জন্য সুইমিং পুলে নানা রকম প্লাস্টিকের খেলনা রাখার ব্যবস্থা থাকে। খেলতে খেলতে বাচ্চা যেন সুইমিং পুলের কাছাকাছি না যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পুল থেকে প্লাস্টিকের নানা রকম খেলনা, পুলে নামার মই এসবও সরিয়ে রাখাই ভালো। খেলনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাচ্চা পুলে নামার চেষ্টা করলে একটা বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। 

রেসিডেন্সিয়াল এলাকায় পুলের চারপাশে অন্তত একটা উঁচু বেড়া বা কোনো ধরনের বেষ্টনী থাকা দরকার। বেষ্টনী এমন হতে হবে যেন বাচ্চা সহজে তা ডিঙিয়ে যেতে না পারে আবার বাইরে থেকেও যেন পুল এরিয়া ভাল ভাবে দেখা যায়। পুলের পাশে যেন অতিরিক্ত পানি জমে না থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। পানি জমে জমে পাড় পিচ্ছিল হলে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত লাগতে পারে।

পর্যাপ্ত ইমার্জেন্সি লাইফ সেভিং ইকুইপমেন্ট পুলের পাশেই একটা জায়গায় গুছিয়ে রাখা উচিত যেন দরকারে সহজেই ব্যবহার করা যায়। 

সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে 

  • সাঁতার জানা হাটাচলার মতই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা একটা 'বেসিক লাইফ স্কিল'। তাই সন্তানকে অবশ্যই সাঁতার শেখান।

  • লাইফ জ্যাকেট, ভেস্ট বা রিং যেমন সাঁতার জানার বিকল্প নয় তেমনি সাঁতার জানা থাকলেও অনেক সময় পানিতে ডুবে মৃত্যু হতে পারে। বাচ্চা সাঁতার জানুক বা না জানুক, তাকে কখনোই বড়দের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ছাড়া সুইমিং পুল কিংবা পুকুর, খাল বিল, নদী নালার কাছাকাছি যেতে দেবেন না। 

  • নদীতে ভ্রমণ করার সময় কিংবা সাঁতার কাটার আগে মদ্যপান বা এ জাতীয় নেশা থেকে বিরত থাকতে হবে। 

  • ইর্মাজেন্সি সময়ে জীবন বাঁচাতে 'কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন' অথবা CPR খুবই কার্যকর একটি পদ্ধতি। পদ্ধতিটি জেনে রাখুন। 

  • জরুরি হেল্পলাইন নাম্বার, ডাক্তারের ফোন নাম্বার হাতের কাছেই রাখুন। 

  • ঘরে সহজে নাগাল পাওয়া যায় এমন জায়গায় একটি বাক্সে প্রয়োজনীয় 'ফার্স্ট এইড কিট' রাখুন। 

পানির প্রতি বাচ্চাদের আকর্ষণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। পানি নিয়ে খেলতে ভালোবাসে না এমন বাচ্চা খুঁজে পাওয়া শক্ত। সুযোগ পেলেই পানির মধ্যে ঝাঁপাঝাপি করতে কার না ভালো লাগে! কিন্তু পাঁচ বছরের নিচের বাচ্চার জন্য এটা খুবই বিপদজনক একটা খেলা। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। যার বড় অংশই হচ্ছে শিশু। এরা সবাই যে সাঁতার জানে না তাও কিন্তু নয়। তাই সতর্কতা অবলম্বন না করে উপায় নেই। ভাল করে সাঁতার শিখে তবেই পানিতে নামুন। বাচ্চাকেও ছোট বেলায়ই সাঁতার শেখার ব্যবস্থা করে দিন। বড়দের কাউকে সাথে না নিয়ে একা যেন সাঁতার কাটতে না যায় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের একটু সতর্কতাই পারে আমাদের শিশুদের নিরাপদ রাখতে।

Default user image

ডাঃ ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প স্বল্প লেখালেখি করতে ভালো লাগে। আস্থা লাইফের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্লগগুলি মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনতা তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস। ভালো লাগে ঘুমাতে, গান শুনতে, নানা রকম খাবার খেতে আর সবচেয়ে ভালো লাগে কথা বলতে।

Related Articles