কসমেটিকসের যে ৭টি উপাদান আপনার ত্বকের জন্য ক্ষতিকর
সৌন্দর্য, আভিজাত্য ও ত্বকের যত্নে এমন খুব কম নারীই আছেন যারা কোন না কোন প্রসাধনী ব্যবহার করেন। তাছাড়া ক্রিম লোশন ও অন্যান্য স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট তো পুরুষেরাও ব্যবহার করেন। তবে কসমেটিকসে এমন কিছু উপাদান দেখা যায়, যা কিনা ত্বক, চুল ও স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর হতে পারে।

ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রসাধনী সম্পর্কিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে,
-
বাংলাদেশে ব্যবহৃত ১৫% প্রসাধনী বিদেশ থেকে আমদানী হয়,
-
১৫% চাহিদা মেটে দেশীও কোম্পানী থেকে
-
এবং বাকী ৭০% প্রসাধনী তৈরি হয় নকল প্রসাধনীর কারখানায়।
এই যখন দেশীয় প্রসাধনী বাজারের অবস্থা, সেখানে কোন প্রসাধনী তে ক্ষতিকর উপাদান আছে, এই নিয়ে আলোচনা করা একটু কঠিনই হয়ে যায়।
বিদেশ থেকে আমদানী কৃত ও দেশীয় প্রসাধনী যদি চিনতে পারেন, তাহলেই তার ক্ষতিকর উপাদান সম্পর্কে সচেতন হতে পারবেন। নকল প্রসাধনীতে কি ব্যবহার হয় তার কোন হদিস না থাকাই স্বাভাবিক, তবে এটুকু নিশ্চিত যে খুব উপকারী কিছু তাতে নেই। নকল প্রসাধনীর প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে ধরা না পড়া। অন্যদিকে আসল কিংবা বিদেশী প্রসাধনীতেও থাকতে পারে ক্ষতিকর উপাদান। তাই এ সম্পর্কে জ্ঞান রাখা জরুরী।
আসুন জেনে নেই কোন কোন উপাদান থেকে সতর্ক থাকতে হবে, ক্ষতিকর কসমেটিকস থেকে বাঁচার উপায় ও এ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি।
আসল কসমেটিকস চেনার উপায়
কথিত আছে বাংলাদেশের নকল পণ্য কারিগরেরা প্লেনের পার্টস পর্যন্ত নকল করে ফেলেন। সেখানে আসল প্রসাধনী চেনা যে কষ্টকর হতে পারে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবুও একটু সতর্ক ভাবে লক্ষ করলে আসল নকলের বিভেদ বোঝা যায়।
-
সবসময় বিশ্বস্ত ও বড় দোকান থেকে কসমেটিকস কিনুন।
-
দেশী পণ্যের নকল হওয়ার সম্ভাবনা কম।
-
বার কোড স্ক্যান করুন।
-
গুগলে উক্ত প্রডাক্টের ছবির সাথে মেলান।
-
প্রডাক্টের গায়ে ও প্যাকেটের গায়ে সিরিয়াল ভিন্ন হলে তা নকল।
-
তীব্র গন্ধ, নিন্মমানের ব্রাশ, রং এর তারতম্য নকল প্রসাধনীর বৈশিষ্ট্য।
স্কিন কেয়ার প্রডাক্টের ৭ টি ক্ষতিকর উপাদান
আসল ও নকলের ভেতর থেকে আসল প্রডাক্ট চিনতে পারলে, পরবর্তি করণীয় হলো তার উপকরণ দেখা। অনেক সময় প্রডাক্টের গায়ে উপকরণ লেখা থাকে না। সেক্ষেত্রে গুগলে সার্চ দিলে উপকরণ গুলো জানা যায়। এই সাতটি উপকরণ যদি কোন কসমেটিকসে পেয়ে থাকেন তা ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
১. পারাবেনস (Parabens)
বর্তমানে ব্যবহৃত কসমেটিকস প্রডাক্টের ভেতরে প্যারাবেনস একটি বহুল ব্যবহৃত উপাদান। এটি একটি প্রিজারবেটিভ যা মেকাপ, শেভিং ক্রিম, মশ্চারাইজাই ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। এটি শরীরের এন্ডোক্রিন অর্থাৎ হরমোন উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায়, যার ফলে প্রজনন স্বাস্থ্য ও অন্যান্য হরমোন সম্পর্কিত ও স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তার সাথে অনেকের ইমিউন সিস্টেম এই উপাদানে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কারণে এলার্জি, রেশ ও এ ধরণের ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
২. কার্বন ব্ল্যাক (Carbon Black)
কাজল, মাশকারা সহ কালো যে সব বিউটি প্রডাক্ট রয়েছে তাতে কার্বন ব্লাক এর ব্যবহার রয়েছে। এই উপাদানটি ক্যান্সার তৈরি, ফুসফুসে প্রদাহ, ও নানা ধরণের নিউরোজিক্যল সমস্যা তৈরি করার জন্য দায়ী হতে পারে। মাত্র ১০% এর কম কার্বন ব্লাকই স্বাস্থ্যের জন্য হতে পারে হুমকি স্বরূপ। ইউ.এস. ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) কসমেটিকস বা প্রাসাধনীতে এই উপাদানটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও অনেক প্রডাক্টে এটির ব্যবহার আছে।
৩. পেট্রোলিয়াম জেলি
পেট্রোলিয়াম জেলী ক্ষতিকর এর তালিকায় থাকতে পারে সেটা অনেকের কল্পনায়ও আসার কথা নয়। বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম জেলি নামের একাধিক প্রডাক্টই রয়েছে যা মশ্চারাইজার হিসেবে বেশিরভাগ মানুষই ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রাকৃতিক তেল থেকে উৎপাদিত এই উপদানটিতে যদি ঠিক ভাবে পরিশোধিত না হয়, এটি ক্যান্সারের কারণও হতে পারে। তাছাড়া রেশ ও বিভিন্ন এলার্জি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। ত্বকের যত্নে মশ্চারাইজার হিসেবে অন্যান্য তেল জাতীয় উপাদান অনেকাংশেই নিরাপদ হয়ে থাকে।
৪. সুগন্ধি
প্রায় সব ধরণের প্রসাধনীতেই কোন না কোন সুগন্ধি ব্যবহার করা হয়, যার ভেতর কিছু কিছু সুগন্ধিযুক্ত ক্যামিক্যাল মানব স্বাস্থ্যের জন্য হতে পারে হুমকি স্বরূপ। বিশেষ করে নিন্ম মানের কসমেটিকস ও পারফিউমে বিষাক্ত ক্যমিক্যল থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ক্ষতিকর সুগন্ধিগুলো স্নায়বিক সমস্যা, হরমোনের সমস্যা ও ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। তাই খুব তীব্র গন্ধ যুক্ত কসমেটিকস এড়িয়ে যাওয়া উচিত ও পারফিউমের ক্ষেত্রে ভালো মানের পারফিউমও অল্প মাত্রায় ব্যবহার করা উচিত।
৫. অক্সিবেনজোন (Oxybenzone)
গরমে ত্বকের যত্নে অনেকেই সানস্কিন ব্যবহার করেন। অক্সিবেনজন সানস্কিনে থাকা একটি সাধারণ উপাদান। একটি বড় অংশ সানস্কিনে অক্সিবেনজন এর ব্যবহার রয়েছে। এই উপাদানটি সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি ত্বকে প্রবেশ করা থেকে আটকায় ও সানবার্ণ থেকে রক্ষা করে। যদিও গবেষণায় দেখা গেছে এই উপাদানটি মানুষের হরমোন ব্যাবস্থায় বিঘ্ন ঘটায় ও হরমোনাল রোগের সূত্রপাত করে। তাছাড়া অক্সিবেনজন পরিবেশের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর হওয়ায় অনেক বড় বড় প্রাসাধনী কোম্পানী তাদের প্রসাধনীতে এটি ব্যবহার বর্জন করেছে।
৬. থ্যালাটেস (Phthalates)
Phthalates উপাদানটি নেইলপলিশ, পারফিউম, আর লোশনে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই উপাদানটির মূল কাজ হলো প্লাস্টিককে নমনীয় ও কম ভঙ্গুর করা। নেইলপলিশে এই কারণেই এই উপাদানটি ব্যবহার রয়েছে। তাছাড়া পারফিউমের গন্ধ স্থায়ী করতেও এটি কাজ করে। এটি কোন একটি উপাদান নয়, বরং একটি আমব্রেলা টার্ম হিসেবে ব্যবহার হয়। এর মধ্যে রয়েছে,
-
dibutyl phthalate (DBP), নেইলপলিশে ব্যবহার হয় ও এর ভঙ্গুরতা কমাতে সাহায্য করে।
-
dimethyl phthalate (DMP), চুলের যত্ন নেওয়ার উপায় হিসেবে অনেকে হেয়ার স্প্রে ব্যবহার করেন, যাতে DMP থাকে। এটি চুলের উপর নমনীয় আবরণ তৈরি করে।
-
diethyl phthalate (DEP), পারফিউম ও লোশনে এই উপাদানটি পাওয়া যায়।
ক্যন্সার তৈরির সাথে এই উপাদানটির যোগসূত্র আছে। সেই সাথে প্রজনন স্বাস্থ্য ও হরমোনের ভারসাম্যকে এসব উপাদান ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
৭. ফর্মালিন
ফর্মালিন শুধু মাছ ও সবজিতে নয়, প্রসাধনীতেও ফরমালিন ও ফরমালিন উৎপন্ন কারী দ্রব্য থাকতে পারে। আমেরিকায় একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ৫ টি কসমেটিকস প্রডাক্টের ভেতরে একটিতে ফর্মালিন পাওয়া গেছে। বিউটি প্রডাক্ট গুলোতে ফর্মালিন একটি প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহার হয়। এটি আমাদের ডিএনএ এর আচরণ বদলে দেয় যার ফলে মিউটেশন ঘটে ও পরবর্তীতে ক্যন্সারে রূপ নেয়। তাছাড়া, এলার্জি, স্নায়ুর ক্ষতি এসব সমস্যা তো আছেই। তাই কোন প্রাসধনীতে ফর্মালিন পাওয়া গেলে তা অবশ্যই বর্জনীয়।
ত্বকের জন্য অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান
উপরিক্ত তালিকায় যে উপাদান গুলো ক্ষতিকর হবার পরও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আরও অনেক ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে যা সম্পর্কে সচেতনতা প্রয়োজন। নিচে এ ধরণের কিছু উপাদানের নাম উল্লেখ করা হলো-
-
Butylated hydroxytoluene
-
1,4-Dioxane
-
Ethanolamines (TEA, MEA, DEA)
-
Sulfates
-
Toluene
-
Triclosan
-
Lead
-
Diethanolamine
-
Hydroquinone
কিছু সাধারণ প্রশ্ন
প্রশ্ন: চর্মরোগে কোন ডাক্তারের কাছে যাব?
চর্মরোগ ও ত্বক সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতায় ডারমাটোলজিস্ট বা ত্বক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
প্রশ্ন: গরমে ত্বক ভালো রাখার উপায় কি?
অতিরিক্ত গরমে ত্বক ভালো রাখতে প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে হবে, ঘাম ত্বকে জমতে দেওয়া যাবে না। দিনে দুইবার মুখ ধোয়া সাথে এলোভেরা, বাটা হলুদ ব্যবহার ঘরোয়া পদ্ধতিতে ত্বকের যত্নে কার্যকারী হতে পারে।
পরিশেষ
ত্বক আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ ও এর স্বাভাবিক সুস্থতাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। ক্ষতিকর প্রসাধনী, স্কিনকেয়ার প্রডাক্ট এসব ত্বকের সুস্থতা যেমন ব্যাহত করে তেমনি ডেকে আনতে পারে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য ঝুঁকি। তাই যেকোনো নতুন স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট ব্যবহার এর আগে সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা ও উপকরণ সম্পর্কে জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।