টয়লেটে বসার সবচেয়ে ভালো উপায় কোনটি?

প্যান টয়লেট (লো কমোড) নাকি হাই কমোড! কোনটি ব্যবহার করবেন? কোন অবস্থানে বসে টয়লেট করলে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী? কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেট পরিষ্কার রাখতে টয়লেটে যেভাবে বসা উচিৎ?

আমরা আজ টয়লেট এবং মলত্যাগ সম্পর্কিত বিষয়ে কথা বলব। শুনতে একটু অন্যরকম লাগলেও এটি কিন্তু আপনার স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টয়লেট বা মলত্যাগ করা মানুষের একটি প্রাকৃতিক কাজ যা নির্দেশ করতে পারে যে আপনার শরীরের ভিতরে কিছু ভুলত্রুটি আছে কিনা, এবং যা উপেক্ষা করা একদমই উচিৎ নয়।

নিয়মিত টয়লেট করা আপনার ডাইজেস্টিভ সিস্টেম বা পাচনতন্ত্র সুস্থ রাখারই একটি অংশ। কিন্তু যখন প্রকৃতি ডাক দেয়, তখন এটা সবসময় এত স্বাভাবিকভাবে আসে না। যদিও মাঝে মাঝে মলত্যাগের সময় অস্বস্তি হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু তা যেন  ক্রমাগত ব্যথার উৎস না হয়।

আপনি কীভাবে টয়লেট ব্যবহার করেন সে সম্পর্কে চিন্তা করুন -আপনি কি প্যান টয়লেট (লো কমোড) নাকি হাই কমোড ব্যবহার করছেন?  আপনি হয়তো আগে কখনো এটা নিয়ে ভাবেননি, কিন্তু আপনি যখন টয়লেটে যাবেন তখন বসার ভঙ্গি একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই আসুন আপনার অন্ত্র খালি করার সেরা উপায়টি বের করার চেষ্টা করি।

টয়লেট বা মলত্যাগ করার সবচেয়ে ভাল উপায় কোনটি?

একজন সুস্থ মানুষ প্রতিদিন কত বার টয়লেট করে থাকে? আসলে এর সাধারণ কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, ক্ষেত্র বিশেষে এইটা প্রতিদিন ৩ বার থেকে শুরু করে সপ্তাহে ৩ বার পর্যন্ত স্বাভাবিক ধরা হয়ে থাকে।

এই বিষয়ে প্রায় ২০০০ জনের উপর একটা জরিপ করা হয়। সেই জরিপে বলা হয়-

  • প্রায় ৫০% লোক প্রতিদিন একবার হলেও পটি বা টয়লেট করে থাকে

  • ২৮% লোক প্রতিদিন ২ বার

  • ৫.৬% লোক সপ্তাহে ২-৩ বার পটি বা টয়লেট করে থাকেন

  • এর মধ্যে ৬১.৩% বলেছিলেন যে তাদের পটি বা টয়েলট করার প্রেশার বা বাওয়েল মুভমেন্ট ছিল সকালে।

  • ২২% বলেছিল তাদের এই বাওয়েল মুভমেন্ট বিকালে হয়ে থাকে এবং

  • মাত্র ২.৬% বলেছিল তারা রাতে টয়লেট বা পটি করে থাকেন।

সুতরাং বোঝায় যাচ্ছে বিষয়টি খুবই ন্যাচারাল। আর এই ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক বিষয়টি আমরা ১৬ শতকের পুর্ব পর্যন্ত আমরা প্রাকৃতিক ভাবে উবু হয়ে বসে (Squatting) সেরে ফেলতাম। ১৬ শতকে স্যার জন হ্যারিংটন প্রথম ফ্লাশ টয়লেট আবিষ্কার করেন। ১৯ শতকে এসে এই ফ্লাশ টয়লেট বা হাই কমোডে বসা (Sitting) টয়লেট বিপুলভাবে ওয়েস্টার্ন দেশ গুলোতে ব্যবহার শুরু হয়। তার পরিক্রমায় আমরাও পিছিয়ে নেই আমাদের দেশেও এখন ফ্লাশ টয়লেট বা হাই কমোড বিপুল ভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চলে এখনো লো কমোড বা (উবু হয়ে বসা টয়লেট বা squtting) দেখা যায়, শহরাঞ্চলেও পুরোনো বাসা গুলোতে এখনো এইসব টয়লেট দেখা যায়। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো এই দুটির মধ্যে কোনটি ভাল? প্রাকৃতিক ভাবে উবু হয়ে বসা (Squatting) নাকি বসে করা ( sitting) এই বিতর্কে যাওয়ার আগে চলুন জেনে নেই -

কিভাবে মলত্যাগ বা Defaecation  হয়ে থাকে?

মলত্যাগের পুরো প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল তাও চেষ্টা করছি সহজ ভাবে বলার। যখন আমাদের রেকটাম ( Rectum) বা মলদ্বারা পূর্ণ হয়ে যায় তখন এটা সংকুচিত হয়ে যায়। এর সাথেই থাকে এনাল ক্যানাল যা কিনা মসৃণ পেশী (Smooth muscle) দিয়ে তৈরি এবং তা প্রসারিত হয়ে যায়।  রেক্টামের বা মলদ্বারের চারপাশে একধরনের পেশি থাকে তার নাম পিউবোরেক্টালিস পেশি যা রেকটামকে সামনের দিকে টেনে ধরে রাখে এবং একটি শক্ত কোন সৃষ্টি করে ।এই কোণকে এনোরেক্টাল কোণও (Anorectal angle) বলা হয় যার মান মোটামুটি ৩৫° থেকে ৪৫° এর মধ্যে। মলত্যাগের সময় এই পিউবারেক্টালিস পেশি প্রসারিত হয়ে যায় এবং ফলস্রুতিতে এনোরেক্টাল কোণ প্রশস্ত হয়ে যায় এবং সহজেই তখন এনাল ক্যানাল দিয়ে মল সোজা পথে বের হয়ে যায়।

প্রাকৃতিক ভাবে উবু হয়ে বসা (Squatting) নাকি বসে করা ( sitting)?

  • Squatting বা উবু হয়ে বসা বা লো কমোড ব্যবহারে এই এনোরেক্টাল কোণ সহজেই সৃষ্টি হয় এবং মল ত্যাগে সহজ এবং তাড়াতাড়ি হয়।

  • ঈসরাইলী এক গবেষক ডব সিকিরভ ২৮ জন সেচ্ছাসেবক এর  উপর Squatting or sitting এই ২ ভংগি তে মলত্যাগের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে,  যে সমস্ত সেচ্ছাসেবী Squatting ভংগি তে ছিলেন তাদের বাওয়েল মুভমেন্ট গড়ে ৫১ সেকেন্ড সময় লেগেছে অন্যদিকে সিটিং বা হাই কোমোড বসে গড়ে ১৩০ সেকেন্ড সময় লেগেছে এবং অংশগ্রহনকারি সেচ্ছাসেবক বলেছেন Squatting ভংগিতে মলত্যাগে সহজ হয়েছে।

  • জাপানের এক স্টাডিতে দেখা গেছে এনোরেক্টাল কোন বেশি প্রশস্ত ছিল Squatting বা উবু হওয়া বসাতে এবং কম প্রশস্ত ছিল বসে বা হাই কমোড সিটিং এ।

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এটা বলা যায় সেই আদি কাল থেকে আমরা যেই squatting ভংগিতে বসা ব্যবহার করছি তা প্রকৃত পক্ষেই আমাদের মলত্যাগ করতে সহজ করছে বিশেষ করে যাদের কোস্টকাঠিন্য বা হেমোরয়েডস আছে।  আর তাই টয়লেটে সঠিকভাবে বসা আমাদের বিভিন্না স্বাস্থ্যগত সমস্যা যেমন কোস্টকাঠিন্য,  হেমোরয়েডস এবং বিভিন্ন কোলন সংম্পর্কিত রোগ থেকে রক্ষা করবে।

  • Squatting  সব সময় ই ভাল বুঝাই যাচ্ছে কিন্তু অনেক সময় এই ভংগিতে টয়লেট করা কস্ট সাধ্য। বিশেষ করে যারা বেশি স্বাস্থ্যবান বা স্থুলতায় ভুগছেন অথবা বয়স্ক লোক অথবা যাদের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। এছাড়া আমাদের দেশে একটু বয়স্ক মহিলাদের হাড় জনিত রোগে ভুগে থাকেন যেমন অস্টিওপরোসিস,  আর্থাইটিস , কোমড় ব্যথা,  বাতের ব্যথা ইত্যাদি নানা ধরনের ব্যথায় তাদের জন্য অনেক সময় চিকিৎসকরাই হাই কমোড ব্যবহার করতে বলে থাকে। আবার অনেকেই আছে ছোট বেলা থেকেই সিটিং ভংগিতে বসে অভ্যস্ত সে ক্ষেত্রেও তার জন্য Squatting কস্টকর হয়ে যাবে। আর তাই হাই কমোডে বসেও বা সিটিং ভংগিতে বসেও আমরা squatting এর মত সুফল পেতে পারি। সেক্ষেত্রে আমাদের বসাকে একটু পরিবর্তন করতে হবে।

সাধারণত আমরা হাইকমোডে যখন বসি তখন আমাদের হাটু এবং নিতম্ব ৯০° কোন সৃষ্টি করে যা আমাদের  এনোরেক্টল এংগেলকে সংকুচিত করে দেয় বা এনাল ক্যানাল সরু হয়ে যায়।

আর তাই আমরা আমাদের পায়ের নিচে একটি ছোট টুল বা পিড়ি দিয়ে তার উপর পা রাখবো এতে করে আমাদের হাটু নিতম্ব থেকে উপরে থাকবে। ফলে পিউবোরেক্টালিস পেশি সহজে প্রসারিত হয়ে মলত্যাগকে সহজ ও তড়ান্বিত করবে।

টয়লেট থেকে এসে আমরা অবশ্যই প্রপার হাইজিন মেনে হাত ধুয়ে নিবো। আর এখন করোনা ছাড়াও বিভিন্ন ভাইরাস সংক্রমণ এর ঝুকি আছে সেহেতু এই কাজ টি বেশি বেশি করবো। যেকোন কাজ শুরুর আগে ও পরে ভাল মত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত দুয়ে নিবো।

Default user image

মোঃ এহসানুল হক, সিনিয়র লেখক, আস্থা লাইফ

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঔষধ প্রকৌশল ( ফার্মেসি) বিষয়ে। এখন কর্মরত আছেন একটি নামকরা ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানির মানব সম্পদ বিভাগের প্রশিক্ষন ও উন্নয়ন শাখার জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা হিসেবে। যেহেতু কাজের ধরনই হচ্ছে ঔষুধ এবং রোগ বালাই নিয়ে প্রশিক্ষন দেয়া, স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা জাগ্রত করা। তাই এই বিষয় নিয়েই টুকিটাকি লেখালেখি করে থাকেন নিজের কাজের সুবিধার জন্যে। আর তাই যখনি শুনেছেন "আস্থা লাইফ " স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করবে, সবার মাঝে বাংলা ভাষায় সঠিক স্বাস্থ্যবার্তা পৌছে দিবে। তখনি নিজ আগ্রহে যোগ দিয়েছেন "আস্থা লাইফ" পরিবারের সাথে। কাজের পাশাপাশি তিনি পুরোদমে একজন ট্রাভেলার, একজন শিক্ষক, যে ভালোবাসে জীববিজ্ঞান নিয়া কাজ করতে এবং পড়াতে। আর তাই যুক্ত আছেন নারায়ণগঞ্জের "কিউরিয়সিটি" নামক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর সাথে যেখানে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলা হাতে কলমে শিখানোর পাশাপাশি ভালো মনের মানুষ হিসেবে গড়তে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

Related Articles