আত্মহত্যা প্রতিরোধ; যথাযথ প্যারেন্টিং বাঁচাতে পারে কিশোর কিশোরীদের প্রাণ
বর্তমান সময়ে আত্মহত্যার সংবাদ যেন খুব সাধারণ একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার অধিকাংশই আজকের তরুণ প্রজন্ম। বয়সন্ধি বা এর ঠিক পরের কিছু বছর মানুষের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রন একটি সহানুভূতিশীল ও সহায়ক পারিবারিক পরিবেশ ছাড়া সম্ভব নয়, যা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাবা-মায়ের। তাছাড়াও, একজন আত্মহত্যা প্রবণ মানুষকে তার বন্ধু ও পরিচিতজন নানা ভাবে সাহায্য করতে পারেন। এই প্রবন্ধটিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের করনীয় নিয়ে আলোচনা করব।
বয়সন্ধির পর কিশোর-কিশোরীদের বাবা মায়ের জন্য সন্তানের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। সাধারণত মা বাবা এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে রাখেন যাতে, সবকিছু স্বানন্দে বাবা-মাকে জানানো, কিংবা তাদের থেকে কোন সহযোগীতা আশা করা দূরহ হয়ে পড়ে। দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারের একটা স্বাভাবিক চিত্র হলো, আবেগ জনিত ও অন্যান্য স্পর্শকাতর সমস্যা গুলো সন্তান কোন অবস্থাতেই বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারে না। সেই সাথে অস্বাভাবিক পারিবারিক সহিংসতার ক্রমবর্ধমান রূপও ভাবাচ্ছে সুশীল সমাজকে।
তবে পরিবারের কি করণীয়? কেন এত অসংখ্য তরুণ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন? সে সম্পর্কে আলোচনার আগে, চলুন কিছু পরিসংখ্যান ও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা জানা যাক।
আত্মহত্যা সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ও সাম্প্রতিক ঘটনা
গত বছর মার্চে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছর লকডাউনে আত্মহত্যা করে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ, অথচ সে সময়ে করনায় মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়ায় নি। এখনো দৈনিক গড়ে আত্মহত্যা করছেন ৩৫ জন মানুষ। তাহলে একটু ভেবে দেখুন আসলে কোনটা বড় মহামারী?
সম্প্রতি ময়মনসিংহের দশম শ্রেণি পড়ুয়া এক মেয়ে ফেসবুকে বাবা-মাকে দায়ী করে একটি সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করে। তার লেখা বড় স্টাটাসটিতে উঠে আসে পরিবারের উপর তার অভিমান ও প্যারেন্টিং এ তাদের ব্যার্থতার কথা। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যে ভালো প্যারেন্টিং কত গুরুত্বপূর্ণ।
আত্মহত্যার মূল কারণ সমুহ
গত কয়েক বছরে করোনার শঙ্কা, লকডাউন, ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবে না, যে কিনা একবারো মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়নি। করোনার কারণে আত্মহত্যার অন্যান্য কারণ গুলোর সাথে সর্বজনীন ভাবে যোগ হয়েছে একাকীত্ব, কর্মহীনতা, একই পরিবেশে অনেকদিন কাটানো ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। আমরা সবাই মানিয়ে নেই, ঘুরে দাঁড়াই। কিন্তু সবার পরিস্থিতি এক নয় আর সহ্যক্ষমতাও সবার সমান নয়। আমাদের সমাজ ব্যাবস্থ্যায় আত্মহত্যার মূল কারণ গুলো লক্ষ করুন।
-
প্রেমে ব্যর্থতা জনিত কারণ
-
পারিবারিক সহিংসতা
-
যৌন নির্যাতন ও সম্মানহানির সঙ্কা
-
ভালো ফলাফলে ব্যর্থতা
-
বেকারত্ব
-
বয়সন্ধিকালীন অবসাদ
-
একাকীত্ব
কারণ যতই গুরুতর হোক, পরিবার থেকে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলার সঠিক মনোভাব গড়ে দিতে পারলে, আত্মহত্যা প্রবনতা অনেকাংশে দূর করা যায়। সেই সাথে কাছের মানুষের সহায়ক ভূমিকা সবসময় মানুষকে বাঁচার প্রেরণা যোগায়। চলুন জেনে আসি, আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবারের করনীয় সমুহ।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবারের করনীয়
আত্মহত্যা প্রতিরোধ মানে শুধু আত্মহত্যা করতে বাঁধা দেওয়া নয়। শৈশব থেকেই একটি সুস্থ্য পারিবারিক সম্পর্ক সবল মনের মানুষ গড়তে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চলুন পরিবারের করনীয় গুলো জেনে আসা যাক।
-
১০ জনের মধ্যে নয় জন কিশোরই বয়সন্ধির কোন এব সময়ে গুরুতর মানসিক অবসাদের স্বীকার হয়, এবং এ সময়ে বিশেষজ্ঞের কাউন্সিলিং প্রয়োজন হয়। অথচ আমাদের সমাজে বিশেষজ্ঞ তো দূরে থাক বাবা-মা ও সঠিকভাবে সন্তানের কথা গুলো শোনার চেষ্টা করেন না।
বলতে আগ্রহী হোক আর না হোক, মন খারাপ দেখলে, "কি হয়েছে? তোমার মন খারাপ? আমাকে বলতে পারো, হয়ত সাহায্য করতে পারি" এ ধরণের কথাও অনেকাংশে স্বস্তি দেয়, সহজ হতে সাহায্য করে।
-
মন খারাপ করে বসে থাকে মানেই কোন শিশু বা কিশোর আত্মহত্যা প্রবণ এমন নয়। কিন্তু শৈশবের ট্রমা পরবর্তি জীবনে খারাপ সময় মোকাবেলার ক্ষমতা ও আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়িয়ে তোলার ঝুঁকি বাড়ায়। এর সমাধান হলো সন্তানের সাথে যোগাযোগ বাড়ানো ও তার কথা জানার চেষ্টা করা।
-
সন্তানের কথাবার্তা ও কার্যক্রমে খেয়াল রাখুন। কথাবার্তা, বা লেখায় কোন আত্মহত্যার প্রবণ কথাবার্তা বা ইঙ্গিত প্রকাশ পেলে সতর্ক হউন।
-
সন্তান লম্বা সময় ধরে মানসিক অবসাদে ভুগলে মন বিশেষজ্ঞের সহযোগীতা নিতে দেরী করবেন না। একজন বিশেষজ্ঞ কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে তার মনের হতাশা ও বিষাদের বীজ গুলো দূর করতেপ পারেন।
-
সন্তানকে আপনার মনের কথা জানান। তাকে বলুন আপনি তাকে ভালোবাসেন ও তার বিষন্নতা আপনাকে চিন্তিত করছে। খারাপ সময় সবসময় থাকবে না আর সবাইকেই কোন না কোন সময় এর ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
-
সন্তানকে একা থাকতে নিরুৎসাহিত করুন। অবশ্য আপনি নিজে থেকে কারোর সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দিতে পারবেন না, কিন্তু এমন পরিবেশে রাখুন যেখানে সে কথা বলা ও খেলাধুলার মানুষ পাবে। সাধারণত স্কুল থেকেই মানুষের ভেতর এ ধরণের সামাজীয়িকিকরণ হয়ে থাকে।
-
খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় অংশগ্রহণ করতে বলুন। দীর্ঘসময় শরীর স্থির থাকলে মন অস্থির হয়ে ওঠে, তাই বিভিন্ন শারিরীক পরিশ্রম সম্পর্কিত কাজে উৎসাহিত করুন। শহরে মাঠের সংকট থাকলে, ক্যারাটে, জুডো বা স্কেটিং দল গুলোতে ভর্তি করতে পারেন। খেলায় আগ্রহ থাকলে ক্লাবে ভর্তি করে দিতে পারেন।
বিস্ময়কর হলো, বিশ্বজুড়ে ২৪ বছর এর নিচে বয়সী মানুষের সর্বচ্চ মৃত্যুহার হলো আত্মহত্যায়। তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে সংযুক্ত। সম্প্রতি ফেসবুকে স্টাটাস দিয়ে আত্মহত্যা একটা দুঃখজনক ট্রেন্ড তৈরি হয়ে গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, আত্মহত্যাকারী একটা আবেগী স্টাটাস দিয়ে আত্মাহুতি দিচ্ছে, এদিকে হাজার হাজার মানুষ পোস্টটি শেয়ার করে সমবেদনা জানাচ্ছে। এতে করে অনেক সুইসাইডাল তরুণ একই কায়দায় আত্মহত্যায় আগ্রহী হচ্ছে। চলুন জানা যাক, অনলাইনে পরিচিত কেউ আত্মহত্যার ইঙ্গিত দিলে কি করবেন।
কেউ অনলাইনে আত্মহত্যা প্রবণ ভাবনা প্রকাশ করলে কিভাবে সাহায্য করবেন?
আশার বিষয় হলো, যারা আত্মহত্যা করে তাদের ভেতর মানুষকে সূত্র দেবার প্রবণতা দেখা যায়। তারা অবচেতনে চায় কেউ একজন এসে তাকে রক্ষা করুক। এসব সূত্র দেখে সচেতন হলে ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে হলে অসংখ্য প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। বন্ধু, পরিচিত বা অপরিচিত কোন ব্যক্তির আত্মহত্যার সম্ভাবনা দেখলে কি করবেন, একটা বিস্তারিত তালিকা করা যাক,
সময় ক্ষেপন করান
যার ভেতর আত্মহত্যার সম্ভাবনা দেখা গেছে যেকোনো উপায়ে তার সময় ক্ষেপন করান। যত সময় গড়াবে, আত্মহত্যা করার প্রবণতা ও সম্ভাবনা তত কমে আসবে। যুক্তরাষ্টে আত্মহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা মানুষদের নিয়ে এক গবেষণায় উঠে আসে, ৭০% মানুষ মাত্র ১ ঘন্টার কম ভেবে আত্মহত্যা করে, ১৩% মানুষ ৮ ঘন্টা বা তার বেশি ভেবে আত্মহত্যা করে, আর ১৭% মানুষের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা আসার মাত্র ৫ মিনিটের মাথায় আত্মহত্যা করেছিলো। অর্থাৎ সময় গড়ালে মানুষ ২য় বার ভেবে দেখতে পারে ও বেশিরভাগ সময়ই সেবারের মত আত্মহত্যার থেকে জীবনের পথই বেছে নেয়। আপনার কিছুই করার না থাকলেও, একটা সহানুভূতির বার্তাও তাকে অন্তত অতিরিক্ত ২ মিনিট ভাবতে সাহায্য করবে। বিনিময়ে খারাপ ব্যাবহার পেলেও কিছু মনে করবেন না।
কথা বলুন ভেবেচিন্তে
এখন আসা যাক সম্ভাব্য আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে এমন কাউকে কি বলবেন। এই ব্যাপারটা খুব সতর্কতার সাথে ও গুরুত্ব সহকারে করতে হবে। আপনি যতই ভালো বন্ধু হোন না কেন, আপনি যদি, "ফাইজলামি করিস?" টাইপ রিএক্ট করে নিজেই রাগ দেখানো শুরু করেন, খুব সম্ভবত সে আপনার আর রিপ্লাই-ই দেবে না। উল্টো, কেউ আমাকে বোঝে না ভেবে পৃথিবী ছাড়বে। এমন কিছু বলুন যাতে বোঝা যায় আপনি তাকে পছন্দ করেন, কেয়ার করেন। তার থাকা না থাকাটা আপনার কাছে অনেক বড়। আবেগপ্রবণ কিছু বলুন যা তাকে ইমোশনালি টাচ করবে ও আত্মহত্যা থেকে নিরুৎসাহিত করবে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখাবেন না, "আমি জানি তুমি এ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে" বলার চেয়ে বলুন, পরিস্থিতি যাই হোক আপনি সবসময় তার পাশে আছেন।
তার পরিবারকে জানান
আপনি নিজে তার ভালো বন্ধু বা পরিচিত না হলে এমন কাউকে জানান যে তার ভালো বন্ধু বা যার কথা সে সত্যি সত্যি আমলে নেবে। অবস্থা বেগতিক মনে হলে দ্রুত তার পরিবারকে জানিয়ে দিন। যদিও আপনাদের বন্ধুত্ব ভেঙে যায় তার জীবন রক্ষা পেতে পারে। পরবর্তিতে সে নিশ্চই আপনার অনুভূতি বুঝতে পারবে।
একসাথে সময় কাটানোর প্রস্তাব দিন
কারো ভেতর আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দিলে তাকে সময় দিন, বাসায় ডাকুন, কিংবা তার বাসায় গিয়ে একটা মুভি দেখতে চান। এমন কিছু করুন যাতে সে আলাদা পরিবেশ উপভোগ করতে পারে। কোথাও ভ্রমণে যাবার কথা বলুন, গান করুন, একটা ভালো বই এনে দিন, বিকেলে খেলতে ডাকুন, তার শখের কোন কিছু একসাথে করতে পারেন। কোন কিছুতেই রাজি করানো না গেলে, একসাথে শুধু বসে থাকুন। তাতে ও উপকার হবে।
তার কথাগুলো শুনুন
তার দুঃখ গুলো শেয়ার করতে জোর করবেন না বা অতিরিক্ত প্রশ্ন করবেন না। এমন একটা আস্থাশীল শ্রোতার মত নিজেকে প্রকাশ করুন যেন আপনি তার কোনকিছু বিচার করতে যাবেন না। সময় দিলে সে নিজে থেকেই বলবে। তার কষ্ট গুলো তে সমব্যাথী হউন, তবে মিথ্যা আশা দেবেন না। আত্মহত্যার চাইতে জীবন ভালো এরুপ যুক্তি তর্ক শুরু করবেন না। যুক্তিতে জেতা আপনার উদ্দেশ্য নয়। তাকে সময় করে বিশেষজ্ঞ মনোবিদের স্বরনাপন্য হতে উদ্বুদ্ধ করুন।
আত্মহত্যা সম্পর্কিত সংস্থ্যা গুলোকে জানান
স্থানীয় আত্মহত্য নির্মুল সংস্থা গুলোর ঠিকানা গুগলে খুব সহজেই পাওয়া। সেখানে যোগাযোগ করে খুব সহজেই বন্ধুর জন্য সাহায্য পেতে পারেন, বা আপনার নিজেরও আত্মহত্যা প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য চাইতে পারেন। পরিস্থিতি খারাপ বুঝতে পারলে ৯৯৯ বা স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করতে পারেন। মনে রাখবেন সম্মানের চাইতে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। আত্মহত্যা প্রবণ ব্যক্তির পরিবারকে বাসা থেকে সবরকম ব্লেড, বিষ, দড়ি, হারপিক সরিয়ে নিতে বলুন যাতে হঠকারীতায় কিছু একটা ঘটিয়ে না বসে।
রিপোর্ট করুন
যদি কোন পোস্ট আত্মহত্যার নির্দেশ করে ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে রিপোর্ট করে জানিয়ে দিতে পারেন, সেক্ষেত্রে ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামের নিজস্ব সুইসাইড প্রিভেনশন স্কোয়াড ঐ ব্যক্তিকে সাহায্য করার চেষ্টা করবেন।
শেষ কথা
সমস্যাটা হলো আমাদের দেশে বেশিরভাগ লোক ডিপ্রেশনকে কোন অসুস্থতা বলে মানতে-ই চান না। অত্মহত্যা নির্দেশক পোস্টে অনেক মানুষ এমন মন্তব্য করে যাতে সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়তে বাধ্য! আত্মহত্যার হার কমানোর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা। সরকারী আর বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগ ছাড়া এত বিপুল পরিমাণ মানুষকে সচেতন করা সম্ভব নয়।