ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার - একটি মানসিক রোগ

অল্প অসুস্থতায় দুশ্চিন্তা করছেন? অস্থিরতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা সব একসাথে আপনার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে? তাহলে আপনি ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার নামক মানসিক রোগ আক্রান্ত।

মাঝে মাঝে এমন হয় না? ছোট একটা উপসর্গ কোন বড় রোগের সাথে মিলে যায়। সন্দেহ, উদ্বেগ আর আতঙ্ক বাড়ে, মনে হয় সত্যিই বোধয় মরণব্যাধি কামড়ে ধরলো। ফলে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা এসে ভর করে। এমন কোন মানুষ বোধয় খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার একবারো এমনটা মনে হয় নি। এই প্রবণতাই যখন ভয়াবহ আকার ধারণ করে তাকেই ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার বা বানোয়াট রোগের আতঙ্ক বলা হয়। চিকিৎসা শাস্ত্র মতে যাকে হাইপোকন্ড্রিয়াসিস বা হাইপোকন্ড্রিয়া বলে। এটি আসলে একটি মানসিক সমস্যা বা মানসিক রোগ। এই সমস্যা এতো গুরুতর ও পীড়াদায়ক হয়ে যেতে পারে অনেক সময় সত্যিকারের রোগও যেন এরচেয়ে ভালো।

“ফয়সাল সাহেব (ছদ্মনাম) কোন এক সকালে খেয়াল করলেন তার মলের রং কালচে। কোথায় যেন শুনেছিলেন ক্যান্সার হলে মল কালো হয়ে থাকে। তিনি বেশ দুশ্চিন্তা পড়ে গেলেন। বয়সটাও বেড়েছে আর স্বাস্থ্যও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। সারাদিন তিনি অফিসের কাজে মন দিতে পারলেন না। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলেন আসলে ও এটা পাকস্থলির ক্যান্সারের উপসর্গ। তার চিন্তা জুড়ে শুধুই আজেবাজে চিন্তা ঘুরতে থাকলো। একটা সময় দেখা গেলো সত্যি সত্যি পেটের দিকে ব্যথা করছে। তার আতঙ্ক যেন দ্বীগুন হয়ে গেল। এদিকে বুক ধড়ফড় শুরু করেছে, আর শ্বাসকষ্টও দেখা যাচ্ছে। তিনি একদম ভেঙে পড়লেন, ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা কাবু করে ফেলল। পরদিনই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ডাক্তার দেখানোর পর সব টেস্ট করেও কিছু ধরা পড়লো না। ডাক্তার জানালেন, ফয়সাল সাহেব ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার বা Hypochondria তে ভুগছেন। ডাক্তার ওনাকে একজন সাইকোলোজিস্ট বা মনোবিদ এর স্বরণাপন্ন হতে বললেন। যদিও তার প্রয়োজন পড়ে নি, দেখা যায় ফয়সাল সাহেবের ডাক্তারের নিশ্চয়তা পাওয়ার পর সকল উপসর্গ নিমিষে উধাউ হয়ে গেছে।”

এটি একটি কল্পিত গল্প, কিন্তু ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার যে কোন মানুষের ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধিই এর সর্বত্তম প্রতিরোধ। চলুন জেনে নেওয়া যাক এ রোগের ইতিবৃত্তান্ত ও বের হওয়ার উপায়।

ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার কিভাবে হয়?

মানুষের ভাবনার একটা প্যাটার্ণ আছে। সাধারণত খুব বেশি সময় আমরা কোন কিছু নিয়ে ভাবি না। একের পর এক ভাবনা আসে এবং চলে যায়। কিন্তু যখন কোন একটা বিষয় নিয়ে অনেকটা সময় ভাবা হয়, সেই ভাবনার বিস্তৃতি আর গভীরতা বাড়তে থাকে। 

সমস্যাটা হয় যখন কোন নেগেটিভ চিন্তা আপনার মাথায় আসে। ধরুন কারো উপর একটু রেগে আছেন। এই ব্যপারটা নিয়ে যদি ভাবতে শুরু করেন, ঐ ব্যক্তির আরো অনেক খারাপ বৈশিষ্ট ধরা পড়বে, আপনার রাগ আরো অনেক বাড়তে থাকবে। যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারেন সেই ভাবনা থেকে একটা অপরাধ ঘটে যাওয়াও বিস্ময়কর না।

ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার আরো ভয়াবহ কারণ এর শিকার ও শিকারী দুটোই আপনি নিজে। মানুষের ভেতর যখন জটিল কোন রোগের চিন্তা আসে, তার সাথে জড়িয়ে থাকে মৃত্যুভয়, অর্থচিন্তা, নানাবিধ আবেগ, অভিমান সবকিছু। ঠিক সেই কারণেই এই সমস্যাটি একজনকে বিপর্যস্ত করে দিতে যথেষ্ট।

আর মানুষের মস্তিষ্ক এতো শক্তিশালি যে, আপনি যদি এই মুহুর্তে দু মিনিট ভাবেন, আপনার কব্জিতে ব্যথা হচ্ছে, ঠিকই দেখবেন কব্জিতে কিছু না কিছু অনুভূত হচ্ছে। 

ব্যথার উৎপত্তি হলো মস্তিষ্কে, তাই যখন আপনি বিশ্বাস করেন কোন ব্যথা বা অস্বস্তি হচ্ছে, আপনার মস্তিষ্কেও সেই ব্যথার অনুভূতি হতে শুরু করে।

আমার কি ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার রয়েছে?

এ রোগে সাধারণত যে লক্ষণ ও উপসর্গ গুলো দেখা যায়-

  • অনিয়মিত উপসর্গ, ও কোন উপসর্গই একেবারে শারীরিকভাবে কাতর করে দিচ্ছে না বরং ভাবনাই কাতর করছে।

  • অস্থিরতা বিরাজ করে।

  • অসুস্থ্য ভেবে মানুষজন ও নিজের কাজ  এড়িয়ে চলা।

  • প্রতিনিয়ত অসুখ নিয়ে ভাবা, গুগলে সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা।

  • অন্য মানুষকে রোগের কথা বলা।

  • আতঙ্ক, বিষণ্ণতা ও হতাশা কাজ করে।

  • হার্টরেট বেড়ে যাওয়া, ক্ষেত্র বিশেষে শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া (আতঙ্কের কারণে)

  • ডাক্তার দেখাতে চাওয়া কিন্তু তাতেও উদ্বেগ কাজ করা।

  • অনেক ক্ষেত্রে রিপোর্ট নেগেটিভ আসলেও বিশ্বাস করতে না চাওয়া, অন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া।

  • রাতে ঘুমাতে না পারা ও সুইসাইডাল ভাবনা আসা।

  • সমাজ, পরিবার ও চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা।

অর্থাৎ দেখতেই পারছেন, একদম বিনা কারণে শুধু নেতিবাচক ভাবনার কারণে কি পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে। 

ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার কেন হয়?

এর সুস্পষ্ট কারণ সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। কিন্তু গবেষকদের অনুমান মতে-

  • ডিপ্রেশন ও ট্রমা থাকলে এ সমস্যাটি হবার সম্ভাবনা বাড়ে।

  • পরিবারের কারো জটিল রোগ ও সেই রোগে ভুগতে দেখা মানুষের মনে আতঙ্কের জন্ম দেয়, সেটি পরবর্তিতে নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে অতি দুশ্চিন্তা এর কারণ হতে পারে।

  • মানসিক ভাবে দুর্বল ও একা থাকলে।

  • অন্য কোন মানসিক রোগ থাকলে।

  • বেশিরভাগ সময় অলস কাটালেও ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার এর সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আমি কিভাবে ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধ করতে পারি?

এ রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসা বেশ কষ্টসাধ্য, কারণ রোগীর শারিরীক কোন সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সব ধরণের টেস্ট করেও কিছু ধরা পড়ছে না।

  • ডাক্তার যদি বুঝতে পারেন রোগী ইলনেস এনজাইটিতে ভুগছেন, তাহলে তিনি সাইকোলজিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সাজেস্ট করতে পারেন। কিন্তু তার আগেই বিভিন্ন টেস্ট ও চিকিৎসার কারণে বেশ খরচ ও ঝামেলা পোহাতে হয়। 

  • অনেক রোগী এতো দৃঢ়ভাবে তাদের অসুখের কথা বিশ্বাস করে ফেলে যে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়াটা তাদের কাছে অবান্তর মনে হয়। অনেক সময় তারা বারবার ডাক্তার পরিবর্তন করে তাদের রোগের হদিস খুঁজতে থাকেন। 

  • অথচ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে মিনিট দশেকের কনসাল্টই এ রোগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমূলে সারিয়ে তুলতে পারে।

  • মনোরোগ বিশেষজ্ঞের যদি মনে হয় আপনার এ রোগের সাথে ডিপ্রেশন বা অন্য কোন রোগের সম্পর্ক আছে তাহলে তিনি মুড ভালো করা সংক্রান্ত ঔষধ দিতে পারেন।

  • এ রোগের আরেক ধরণের চিকিৎসা হলো আপনার যে উপসর্গ বা শারিরীক অনুভূতি হচ্ছে সেই অনুভূতিই আপনাকে দেওয়া। যেমন ধরুন আপনার মনে হয় আপনার শুধু মাথা ঘোরে, সেক্ষেত্রে আপনাকে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে মাথা ঘোরার আসল অনুভূতি দেওয়া হয়, যেন আপনি আসল ও নকল অনুভূতির পার্থক্য করতে পারেন।

  • এটি কোন সংক্রমক বা ক্রোনিক রোগ না যে ঠিকমতো পুষ্টিকর খাবার খেলে বা টিকা নিলে এই রোগটি প্রতিরোধ করা যাবে। বরং সঠিক জ্ঞান থাকলেই আপনি আপনার মনের পাতা ফাঁদ থেকে সহজেই বের হতে পারবেন।

আশা করি  প্রবন্ধটি সে ক্ষেত্রে অনেকাংশেই সহায়ক হবে। 

ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার ও অনলাইন চিকিৎসা এর কুফল

চিকিৎসা দুনিয়ায় বারবার একটি কথা বলা হয়, যেকোন রোগের উপসর্গ হলে কখনোই তা অনলাইন বা ইন্টারনেটে সার্চ দেওয়া উচিত নয়। দেখা গেল সামান্য ফোঁড়ার জন্য আপনি ইন্টারনেটে গবেষণা করতে বসলেন, গবেষণা শেষে দেখা যাবে আপনার দৃঢ় বিশ্বাস যে আপনার টিউমার হয়েছে। যদিও বর্তমানে বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য ব্লগ রয়েছে যা সচেতনতা ও জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে পড়া যেতে পারে।

ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার ও মুঞ্চাসেন সিনড্রম কি একই?

ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার ও মুঞ্চাসেন সিনড্রমের কিছু মিল রয়েছে। মুঞ্চাসেন ডিনড্রমে রোগী বানোয়াট রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ও চিকিৎসা নেন। এটি এমন নয় যে তিনি তার স্বাস্থ্য নিয়ে সঙ্কিত। বরং মুঞ্চাসেন সিডঅর্ডার এমন এক মানসিক রোগ যাতে রোগীর চিকিৎসা নিতে ভালো লাগে। সার্জারি, ঔষধ, ও রোগী হিসেবে মানুষের সহানুভূতি পেতে ভালো লাগে। 

অন্যদিকে ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডারে রোগী সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন তার রোগ হয়েছে ও সেই ভয়েই কুপকাত হয়ে চিকিৎসকের স্বরনাপন্ন হন। 

শেষ কথা

শুধু ইলনেস এনজাইটি ডিসঅর্ডার নয়, এমন অনেক ধরণের সমস্যার উৎপত্তি আমাদের মস্তিষ্কে। নিজের ভাবনা ও তার শক্তি সম্পর্কে সচেতনতা, সুস্থ্য সামাজিক সম্পর্ক, কর্মঠ থাকা ও সন্তোষজনক চিত্ত বিনোদন এ ধরণের সমস্যা এড়িয়ে চলতে সাহায্য করবে। পাঠকের সর্বাঙ্গিক সুস্থ্যতা কামনা করে শেষ করছি।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles