আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক চাপ মোকাবেলার কৌশল!
আমাদের নানারকম মানসিক চাপ ও তার প্রভাব, ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে মানসিক চাপ থেকে মুক্তির উপায়
বনশ্রী এলাকার মোজাম্মেল সাহেব ব্যবসা করেন। ইদানীং তিনি বুকের ভেতর অস্বস্তিবোধ করেন। রাতে ঠিকমতো ঘুম আসে না। অল্পতেই রেগে যাচ্ছেন। ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন তাঁর কোনো সমস্যা নেই, পরামর্শ দিলেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোজাম্মেল সাহেব মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেন। সেখানে বিশদ সাক্ষাৎকারে জানা গেল তাঁর ব্যবসা বেশ কিছুদিন ধরেই খারাপ যাচ্ছে এবং একারণে তিনি তীব্র মানসিক চাপে আছেন। আর আসলে এই মানসিক চাপ থেকেই তাঁর নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
অনেক সময় জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে যা আমাদের জন্য একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। এরকম ঘটনা আমাদের মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি করে, পরিচয় করিয়ে দেয় প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে। আর এই পরিবর্তিত প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হলেই তৈরি হয় মানসিক চাপ, যাকে বলা হয় স্ট্রেস (Stress) ।
প্রাত্যহিক কর্ম ব্যস্ত জীবন এবং মানসিক চাপ অনেকটা খাদ্যতালিকার চর্বির মত, যা খুবই ন্যূনতম মাত্রায় গ্রহণযোগ্য, মাত্রার বাহিরে গেলেই চর্বি যেমন আপনার স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তেমনি অতিরিক্ত মানসিক চাপ আপনার জীবনকে করে তুলবে দূর্বিষহ। তবে মানসিক চাপ থেকে শতভাগ মুক্তি পাওয়া সম্ভব না হয়ে উঠলেও, কিছু সাধারণ কৌশল অনুসরণ করেই ব্যক্তিগত, সামাজিক ও কর্মজীবনে হতাশা ও দুর্ভাবনা মুক্ত সামঞ্জস্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এই আধুনিক কর্মব্যস্ত জীবনে মানসিক চাপ সামলে সমান তালে এগিয়ে যেতে পারাটাই কিন্তু সুখী ও সফল মানুষের বৈশিষ্ট্য। মানসিক চাপ জীবনযাত্রার গুনগত মান কমায়, বাড়ায় তিক্ততা যার প্রভাব নিজের সাথে সাথে গ্রাস করতে পারে প্রিয়জন বা পরিবারের জীবনকেও। তবে সব রকম মানসিক অসামঞ্জস্যতাই মানসিক চাপ নয়, সঠিকভাবে মোকাবিলার জন্য জানতে হবে মানসিক চাপ কি, এর কারণসমূহ। মানসিক চাপ সনাক্তকরণ, এর স্থায়িত্ব, প্রভাবসমূহ ও প্রতিকার সহ আর অনেক খুটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কেও আমাদের পরিষ্কার ধারনা থাকা জরুরী।
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কি?
মানসিক চাপ বা স্ট্রেস হলো সেই মানসিক পরিস্থিতি যখন অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা মানুষের মনে বিরুপ অনুভুতি সৃষ্টি করে সাধারণ জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে তোলে। দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কোনও না কোনও ভাবে মানসিক চাপের জন্ম হয় এবং তা যে কোনও পরিস্থিতি বা অবস্থার কারণে হতে পারে। যেমন- ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রের ক্যাম্পাস পলিটিক্সের ফাঁদে পড়ে মানসিক চাপ দেখা দিতে পারে; অথবা হতে পারে প্রেমের সম্পর্কে টানাপোড়েন থেকে আবার কর্মক্ষেত্রের অবমূল্যায়ন মানুষের মনে হতাশা সৃষ্টি করতে পারে।
আমাদের আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি সবসময় সহজ হয় না। সামাজিক বা ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী আমাদের মাঝে মাঝেই বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করা লাগে। এমন কোনও বিশেষ পরিস্থিতির কারণে আমাদের মধ্যে উত্তেজনা এবং অস্বস্তি বোধ কাজ করাটাই হচ্ছে মানসিক চাপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানসিক চাপ এর সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে- “মানুষের দক্ষতা ও জ্ঞানের সাথে চাহিদা ও চাপের সামঞ্জস্য না হলে যেসব প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে এবং যা মানুষের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার ক্ষমতাকে প্রতিহত করে।” যার সহজ অর্থ হল মানুষ যা করতে বা ভাবতে ভালবাসে, জীবনের কোন এক ধাপে যদি সেই বৃত্তের বাহিরে যেতে হয় সেই পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে বেগ পেতে হয়, অধিকাংশ মানুষের জীবনে তা পরিণত হয় মানসিক চাপে।
ডাক্তার ‘উইলিয়াম আর লোভাল্লো’ তাঁর 'Stress and Health' বইতে স্ট্রেস সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন এটা এমন একটা অবস্থা বা বিষয় যার দুটো উপাদান রয়েছে- একটা হল বাহ্যিক উপাদান, যা আমাদের দৈহিক পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত; আরেকটা হল মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক উপাদান, যার সঙ্গে মানবজীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তি বা মানুষ কীভাবে তার করণীয় কাজ বা আচরণ করবে তা যুক্ত থাকে।
মানসিক চাপ এর প্রভাব
মানসিক চাপ এর প্রভাবকে আমাদের জীবনে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়- মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক।
১. মানসিক চাপ আমাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, অল্পতেই রাগ উঠে যায়, কাজে উৎসাহ পাওয়া যায় না, কাজ করতে গেলে ভুল হয়, কোনও দায়িত্ব নিতে ইচ্ছা করে না, কেমন যেন সবসময় একটা মানসিক অশান্তি কাজ করে। সব কিছু থেকে হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে এমনকি নিজেকে আঘাত করা বা আত্মহত্যার চিন্তাও আসতে পারে।
২. বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় মানসিক চাপ এর কারণে। যেমন ঘুম না হওয়া, দুর্বল বা অবসন্ন লাগা, খিদে কমে যাওয়া, সহজে হজম না হওয়া ইত্যাদি। এছাড়া স্ট্রেস থেকে শারীরিক বিভিন্ন রোগ যেমন অ্যাজমা, গ্রন্থিতে ব্যাথা হতে পারে।
৩. সামাজিক ভাবে মানসিক চাপ এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তার সম্পর্কে ফাটল ধরে, পারিবারিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক তৈরি হয়, নেশার অভ্যাস তৈরি হয়। আজকের সমাজে এগুলো খুবই পরিচিত ব্যাপার।
কিভাবে বুঝবেন আপনি মানসিক চাপে ভুগছেন ?
আমরা সবাই কম বেশি মানসিক চাপে ভুগছি যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা তা অনুধাবন করতে পারি না। মানসিক চাপের লক্ষণগুলোকে প্রধানত ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়-
১. মানসিক লক্ষণঃ বিষণ্ণতা, মেজাজি হওয়া, খিটখিটে ভাব, সহজেই ধৈর্য হারানো, বেশিরভাগ সময় আতঙ্কিত থাকা , সবকিছুতেই দোষ খুঁজা, দুশ্চিন্তা।
২. ব্যবহারগত লক্ষণঃ ধূমপান এবং মদ্যপান বেড়ে যাওয়া, সবসময় একা একা থাকা, ঘুম খুব কম বা অতিরিক্ত বেশী হওয়া, কোনো কিছুতে আগ্রহ না পাওয়া, দায়িত্ব এড়িয়ে চলা যাওয়া।
৩. শারীরিক লক্ষণঃ বুকব্যথা, হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাওয়া, ব্রণ উঠা এবং ত্বকের অন্যান্য সমস্যা, বদহজম, উচ্চ রক্তচাপ, মাথা ব্যাথা, খাবারে অরুচি ইত্যাদি।
মানসিক চাপ এর প্রধান কারণ সমূহ
বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কাজ করতে পারে । বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে কর্মজীবন সংক্রান্ত মানসিক চাপের নজির সবচেয়ে বেশি। উন্নত দেশগুলোতেই প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষেরা স্বীকার করে যে তারা কর্মক্ষেত্রের স্ট্রেসে ভুগে থাকেন, যার চিত্র বাংলাদেশেও ভিন্ন কিছু নয়।
১. কর্মক্ষেত্রের মানসিক চাপ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে
-
চাকুরী নিয়ে অসন্তুষ্টি
-
অতিরিক্ত কাজের চাপ বা দায়িত্ব ধারণ
-
নিয়মিত দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা
-
প্রত্যাশার অভাব, অসন্তোষজনক ব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুযোগ না পাওয়া
-
অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করা
-
অনিশ্চিত অগ্রগতি বা চাকুরিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি
-
কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যতা বা হয়রানির স্বীকার হওয়া
২. পারিবারিক কারণ হিসেবে বলা যায়
-
বিবাহ-বিচ্ছেদ
-
নতুন দাম্পত্য জীবন
-
পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব নেয়া
-
পারিবারিক ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকা
-
পরিবারের কারো দুর্ঘটনায় এবং মৃত্যুতে
৩. মানসিক চাপের ব্যাক্তিগত কারণ
-
আবেগ প্রবণতা
-
বেদনাদায়ক বা ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতিতে পতিত হওয়া যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গুজব, ধর্ষণ, দুর্ঘটনা , ডাকাতির শিকার হওয়া ইত্যাদি।
-
ব্যবসায় লোকসান
-
পরীক্ষায় অপ্রত্যাশিত ফলাফল
-
নিজেকে সময় কম দেয়া
-
দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা
-
দিনের বেশিরভাগ সময় মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও নানা ডিভাইস ব্যাবহার করা।
৪. সামাজিক কারণসমূহ
-
কোন প্রিয় মানুষের মৃত্যু
-
আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি
-
নতুন পরিবেশ
-
অপরিছন্ন ও কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ
এসব কারণে সৃষ্ট মানসিক অসামঞ্জস্যতা একটি নির্দিষ্ট সীমা পার করলেই মানসিক চাপ বলে ধরা যাবে এবং সে অনুযায়ী এর প্রভাব কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাই মানসিক চাপ সঠিকভাবে নির্ণয় করা এবং বিভিন্ন ধরণেরমানসিক চাপ সম্পর্কে সার্বিক ধারণা রাখা জরুরী।
মানসিক চাপ কত প্রকার ও কি কি?
আমাদের জীবনে মানসিক চাপ কীভাবে প্রভাব ফেলছে, তার বৈশিষ্ঠ্য, লক্ষণ, স্থায়ীত্ব ও চিকিৎসা পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে আমেরিকান ফিজিওলজিক্যাল এসোসিয়েশন মূলত তিনভাগে ভাগ করেছে-
১. সূক্ষ্ণ মানসিক চাপ বা একিউট স্ট্রেস
২. ধারাবাহিক মানিসিক চাপ বা ইপিসোডিক একিউট স্ট্রেস
৩. দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ বা ক্রনিক স্ট্রেস
১. সূক্ষ মানসিক চাপ বা একিউট স্ট্রেসঃ সহজ করে বললে একিউট স্ট্রেস মানে হলো এক ধরণের সূক্ষ মানসিক চাপ যা কোন একটি নির্দিষ্ট ঘটনা বা সমস্যাকে কেন্দ্র করে অনুভূত হয় এবং সেই ঘটনা বা সমস্যার অবসান হলে সাধারণত এই চাপ স্থায়ী হয় না। এর পরিসীমা অনেক বেশি, যা সাধারণত প্রায়ই প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা ভাবনার উদয় ঘটায়। সদ্য ঘটা বা ঘটতে যাওয়া কোন ঘটনা, উপলক্ষ, হঠাৎ কোন কিছুর চাহিদা সৃষ্টি হওয়া থেকে এ ধরণের মানসিক চাপ আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি হঠাৎ কোন তর্কা-তর্কিতে জড়িয়ে পড়েন আপনার মধ্যে এ নিয়ে নেতিবাচক ভাবোদয় হতে থাকে এবং আপনি মানসিকভাবে চাপ এ ভুগেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যা বেশীর ভাগ সময়ই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অথবা, সামনে আপনার অফিসে কোন অডিট আসার খবরে আপনি তার রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব থেকেও একিউট স্ট্রেস অনুভব করতে পারেন, যা শুধুই আপনার মনে তৈরী হওয়া দুশ্চিন্তার ফল।
সূক্ষ মানসিক চাপ এর লক্ষণসমূহ,
-
আবেগের নিয়ন্ত্রণহীণতা, রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ থেকে দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা ও হতাশা অনুভব করা
-
শারীরিক উপসর্গ সমূহ যেমন দুশ্চিন্তা, মাথাব্যথা, কোমর ও ঘাড়ের ব্যথা, চোয়াল ব্যথা এবং আর অনেক ধরণের পেশী, টেনডন ও লিগামেন্ট এর অস্থিতিশীলতাজনিত সমস্যা।
-
পাকস্থলী, অন্ত্রের পীড়া, বুক জ্বালাপোড়া, এসিডিটি, পেট ফাঁপা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি।
-
উচ্চ উত্তেজনা মূলক প্রভাব যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ও পালস, হাতের তালু ঘেমে যাওয়া, বুক ধড়ফড়, ঝিমুনী, মাইগ্রেইন বা মাথা ব্যথা, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসা, ঘন ঘন শ্বাস ফেলা, ঘুমের সমস্যা ও বুকে ব্যথা।
২. ধারাবাহিক মানসিক চাপ বা ইপিসোডিক একিউট স্ট্রেসঃ যারা সাধারণত ঘন ঘন একিউট স্ট্রেস এ ভুগে থাকে অথবা যারা প্রায় সবসময়ই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত জীবন যাপন করে থাকে তারাই মূলত ইপিসোডিক স্ট্রেস এর শিকার। উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করলে আরও পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাবে। মনে করুন, একজন মানুষ সবসময় কোলাহল, ঝুট-ঝামেলা ও নানা রকম সংকটের মধ্য দিয়ে নিত্য জীবন পার করেন, নানান ধরণের বোঝা তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। প্রচুর দায়িত্ব ও কর্তব্যের মাঝে সময় এর সাথে তাল মিলাতে গিয়ে সে কোন কিছুই গুছিয়ে নিতে পারেনা, চিরস্থায়ীভাবে তিনি হয়ে যান ইপিসোডিক ধারাবাহিক মানিসিক চাপ এর শিকার। উপর্যুপরি মানসিক চাপ সামলাতে এরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
এ পর্যায়ের মানুষ আবার দু ধরণের হয়ে থাকে- ১) “টাইপ এ”(type-A) পার্সোনালিটি এবং ২) “দ্য ওরিয়ার” (worrier) বা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ।
টাইপ এ পার্সোনালিটির ব্যক্তিদের বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে তারা মানসিক চাপ জনিত কারণে অত্যাধিক আক্রমণাত্মক, অসহনশীল, অসংলগ্ন আচরণ করে থাকে, সব কিছুতেই তাদের অস্বাভাবিক অস্থিরতা কাজ করে যা আশপাশের মানুষের মাঝেও বিরূপ প্রভাব ফেলে থাকে।
অপরদিকে, দ্য ওরিয়ার বা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ব্যক্তিরা ক্রমাগত নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা ধারণ করার ফলে তাদের শরীর ও মন উভয়ের উপর ধারাবাহিক মানিসিক চাপ এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। তারা ভাবে এই জীবনে পদে পদে বিপদ, এখানে সৎ বা ভালো থাকার কোন প্রতিদান নেই, কোন কিছুতেই তাদের উৎসাহ জাগে না, পৃথিবী তাদের কাছে সব চেয়ে নিকৃষ্ট জায়গা বলে মনে হতে শুরু করে যেখানে প্রতিনিয়ত শুধু অপ্রীতিকর ঘটনা ই ঘটবে। এ ধরণের চিন্তা তাদের কে আরো বেশী হতাশ করে তোলে, নিয়ন্ত্রণহীন আচরণ ও আরও অনেক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে। তাদের মধ্যে বেশীর ভাগেরই পরবর্তীতে দুশ্চিন্তা জনিত ব্যাধি তথা জেনারেলাইজড এনজাইটি ডিজওর্ডার এ আক্রান্ত হয়ে থাকে।
ধারাবাহিক মানসিক চাপ এর লক্ষণ মোটামুটি সূক্ষ্ম মানসিক চাপ এর মত হওয়ায় আলাদা করে সনাক্তকরণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এক্ষেত্রে মানসিক চাপের মাত্রা ও স্থায়ীত্ব বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ বা ক্রনিক স্ট্রেসঃ সবচেয়ে মারাত্মক ও জটিল ধরণের মানসিক চাপ হল ক্রনিক স্ট্রেস। যদি দীর্ঘসময় ধরে এর চিকিৎসা না করা হয় এটি প্রকোপ আকার ধারণ করে যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক হানি ঘটায়। বেকারত্ব, অলাঘবযোগ্য দারিদ্র্য, পারিবারিক অশান্তি, দাম্পত্য কলহ যা নিয়মিত ও অসহনীয় মাত্রায় চলে যায়, অনিরাময়যোগ্য রোগে আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি কারণে মানুষের ক্রনিক স্ট্রেসে ভোগার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও, ক্রমাগত কোন কিছু হতে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, চাহিদা বেড়ে যাওয়া, চাপ সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়া থেকেও এ চাপে ভুগে থাকে। আবার কেউ কেউ ছোটবেলায় ঘটা কোন দূর্ঘটনা বা দূর্বিষহ স্মৃতির কারণে জীবনের পুরো সময়ে এর প্রভাব বয়ে বেড়ায়।
এই ধরণেরমানসিক চাপের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করা ব্যক্তির আচার ব্যবহার অনেকটা অসামঞ্জস্য জনক ও অনিয়ন্ত্রিত হওয়া স্বাভাবিক, তবে সেগুলো অনিরাময়যোগ্য নয়।
দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এর লক্ষণ গুলোও পূর্বে আলোচিত একিউট স্ট্রেস এর মতই, তবে পার্থক্য হচ্ছে এর কারণে শরীর ও মন এমন ভাবে ভেঙ্গে যায় যা মানুষ আত্মঘাতী, আক্রমণাত্মক, নরঘাতক করে তোলে এবং হার্ট এট্যাক, স্ট্রোক এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
এই ধরণের মানসিক চাপে মানুষ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ভোগে। ফলস্বরূপ যদি সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তবে তা প্রকট আকার ধারণ করে।
এই তিন ধরণের স্ট্রেস একক ভাবে, পুনরাবৃত্তিক, জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী ভাবে দেখা দিতে পারে বলে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কষ্ট সাপেক্ষ। অতএব, মানুষের চারপাশের পরিবেশ, জীবনধারা, খাপ-খাওয়ানোর অভ্যাস এবং ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধাপের চিকিৎসা পদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা ও শারীরবৃত্তীয় চিকিৎসার সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
মানসিক চাপের মাত্রা ও ধরণ নির্ণয়ের পর প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা ও কার্যকরী ব্যবস্থাপনা। তাই জেনে নেয়া যাক এই চাপ কিভাবে আমাদের শরীর ও মনের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও তার চিকিৎসা সম্পর্কে।
মানসিক চাপের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া
অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম (Autonomic Nervous System) এবং এন্ডোক্রাইন সিস্টেম (Endocrine System) আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে দুটি বড় যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ দুটি যোগাযোগ মাধ্যম মানসিক চাপের সময় আমাদের শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। আসুন জেনে নেয়া যাক এর শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া।
১. অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের কাজ
হাইপোথ্যালামাস (আমাদের মস্তিষ্কের একটি অংশ) অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্ট্রেসের সময়ে অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমকে সক্রিয় করে দেয়। ফলশ্রুতিতে অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম শরীরের যে অংশগুলো মানসিক চাপের সময়ে কাজ করে তাদেরকে উদ্দীপিত করে তুলে। এর প্রতিক্রিয়ার প্রতিরক্ষামূলক ধাপ হিসেবে তখন শরীরের সেসব অংশের কার্যক্ষমতা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়।
এ সময় অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম তার দুটি শাখার মাধ্যমে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকে। একটি সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (sympathetic nervous system) এবং অপরটি প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (parasympathetic nervous system )।
সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম শরীরে অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ডকে উদ্দীপিত করে যা অ্যাডরেনালিন হরমোন নিঃসরণ করে। এর ফলে হৃদপিন্ডের রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়, শরীরে অক্সিজেন ঘাটতি হয় যার ফলে নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে যায় এবং জোরে জোরে নেয়া লাগে, পেশী শক্ত হয়ে ওঠে। এমতবস্থায় শারীরিক উত্তেজনা কমানোর জন্যে হয় প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে অথবা মেনে নিতে হবে তথা অবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। ইংরেজিতে যাকে বলে “ফ্লাইট কিংবা ফাইট (flight or fight) ” কৌশল।
অপরদিকে প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম কিছু সংখ্যক অঙ্গের কার্যক্রমের হ্রাস ঘটায় এবং কিছু অঙ্গের কার্যক্রম বৃদ্ধি করে। যেমন হৃদপিন্ডের কাজের গতি কিছুটা হ্রাস করে, রক্তনালীগুলো প্রসারিত করে এবং মুখের লালা নিঃস্বরণ ত্বরান্বিত করে। এতে করে শারীরিকভাবে মানসিক চাপ নিরাময় সম্ভব হয়।
২. এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের কাজ
হাইপোথ্যালামাস এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের পিটুইটারি গ্ল্যান্ডকে সক্রিয় করে। পিটুইটারি গ্ল্যান্ড তখন এ.সি.টি.এইচ (ACTH) নামক হরমোন নিঃসরণ করে এবং অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ডকে সক্রিয় করে তুলে। অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ড তখন ‘কর্টিসোল’ নামক স্ট্রেস হরমোন উৎপাদন করে। ‘কর্টিসোল’ হরমোন নার্ভাস সিস্টেমের ইমারজেন্সি ব্রাঞ্চকে সচল রাখে এবং মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের কিছু কার্যকরী পদ্ধতি
সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য এই চাপ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কর্মব্যস্ত জীবনে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাটাই স্বাভাবিক। সুতরাং মানসিক চাপকে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয় বরং একে সঠিক উপায়ে মোকাবেলা করতে পারাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের কিছু পদক্ষেপ জেনে নেয়া যাক-
-
কারণগুলো চিহ্নিত করা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের প্রথম পদক্ষেপ। কারণগুলো সনাক্তকরনের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে কারণগুলোকে ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করে এগুলো থেকে বের হয়ে আসার উপায় নির্ধারণ করা।
-
সম্ভব হলে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এমন ঘটনা গুলো এড়িয়ে চলা। কোনও ব্যক্তি অথবা কোনও পরিবেশ যদি এর কারণ হয় তবে সেটাও এড়িয়ে চলা।
-
কর্মক্ষেত্র যদি মানসিক চাপের কারণ হয় তবে কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
-
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের এর সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হচ্ছে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানো। পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব না হলে, নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা। নিজের মানসিক অবস্থার নিয়ন্ত্রণ আনার মাধ্যমে আশেপাশের সবকিছুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা যায়। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং ধৈর্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
-
কিছু কিছু সময় পরিস্থিতি এমন হয় যে প্রতিকূলতাকে স্বীকার করে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না যেমনঃ কোনও প্রাকিতিক দুর্যোগ অথবা দুর্ঘটনা। এক্ষেত্রে পরিস্থিতিকে স্বীকার করে নিতে পারলে মানসিক শান্তি অক্ষুন্ন রাখা যায়।
-
নিজের দৈনন্দিন কাজ নিয়মমাফিক করা। সম্ভব হলে কাজের চাপ কমাতে কিছু কাজ কমিয়ে ফেলা।
-
ব্যায়াম করা, গান শোনা, বই পড়া, যেসব কাজ করে আনন্দ পাওয়া যায় সেগুলো করা।
-
বন্ধুদের সাথে গল্প করা, মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া, পরিবারকে সময় দেয়া, একসাথে বাইরে খেতে যাওয়া।
-
নিজের জন্য সময় খুঁজে বের করা এবং জীবনকে উপভোগ করা।
-
সঠিক খাদ্যাভ্যাস যেমন পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, চা-কফি কম পান করা, ধূমপান না করা, নেশা জাতীয় দ্রব্য পরিহার করা।
-
পরিমিত ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
-
সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা।
-
নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা, অহেতুক হিংসা বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকা, কুটিল মনের মানুষের সংস্পর্শে না থাকা।
-
স্ট্রেসের ভুক্তভুগি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা এবং সে অনুযায়ী জীবন যাপন করা।
আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা মানসিক চাপে ভোগী। অনেকদিন ধরে মানসিক চাপ বিদ্যমান থাকলে থাকলে তা উচ্চ রক্তচাপ বাড়ায়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়, এমনকি স্ট্রোকের কারণ হয়ে দাড়ায়। অতএব মানসিক চাপ জনিত সমস্যা হলে বিষয়টিকে এড়িয়ে না গিয়ে, লুকিয়ে না রেখে সঠিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
