মেডিটেশন কীভাবে করবেন?
সুস্বাস্থ্য ও আত্মিক প্রশান্তির জন্য মেডিটেশন। জানুন কিভাবে করবেন, উপকারিতা ও খুঁটিনাটি।
মানব মস্তিষ্কের কোটি কোটি নিউরনের মাঝে এমন ক্ষমতা লুকিয়ে আছে যা কিনা পার্থিব অপার্থিব, সময় ও শূন্যের মাঝে যত রহস্য বিদ্যমান, সবকিছুর সমাধান দেবার সামর্থ্য রাখে। আর এই ক্ষমতা কে মুক্ত করে মেডিটেশন। চিন্তা করুন, পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা সমাধান ও উদ্ভাবন হয়েছে এই মেডিটেশনের মাধ্যমে, সেখানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা গুলো কত এর শক্তির তুলনায় সামান্য ই নয় কি! আমাদের মস্তিষ্ক ই আমাদের শরীর নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থাৎ মেডিটেশনের মাধ্যমে শারীরিক সুফল ও পাওয়া যায়। এই প্রবন্ধটিতে মেডিটেশন কিভাবে অনুশীলন করবেন ও এর মাধ্যমে আপনি কি কি সুফল লাভ করতে পারেন তার একটি পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।
আপনি জানেন কি, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, যেমন নামাজ, পুজা বা অন্যান্য অনেক ধর্মীয় রীতি এক ধরণের মেডিটেশন। প্রার্থনার সময় মনকে স্থির করে শুধু সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠত্বে মনোনিবেশ করতে হয়। নামাজ বা প্রার্থনা মনকে শান্ত করে, মানসিক শক্তি যোগায় ও তার সাথে সুস্বাস্থ্যেও ভুমিকা রাখে।
মেডিটেশনের বিভিন্ন প্রকার ভেদ রয়েছে। একেক ধরণের মেডিটেশনের মাধ্যমে একেক ধরণের উপকার পাওয়া যায়। উপলব্ধি করতে পারছি, পাঠক মেডিটেশন করার উপায় ও এর আধ্যাত্মিক উপকারিতা জানার জন্য অধীর হয়ে পড়ছেন। চলুন প্রথমেই এর অবিশ্বাস্য ক্ষমতা নিয়ে আলাপ করা যাক।
মেডিটেশন এর মাধ্যমে কি করা সম্ভব?
অনেক সময় আমরা নানা রকম মানসিক অস্বস্তি তে ভুগে থাকি। এমন কোন মানুষ নেই যার জীবনে কোন মানসিক যন্ত্রণা নেই। অনেকসময় এই যন্ত্রণা গুলো বাড়তে বাড়তে আমাদের নিথর করে দেয়, আমাদের জীবনের উদ্দেশে ও অর্থময়তা নিয়ে না না রকম দ্বিধায় পড়ি। মেডিটেশন আপনার মানসিক যন্ত্রনা ও যে কোন সমস্যায় শান্ত থাকতে সাহায্য করে, সমস্যা সমাধানের উপায়ের কাছে পৌঁছাতে দেয়।
অপনি নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন, সুখের উৎপত্তি আমাদের মস্তিষ্কে। আমাদের যে কোন অনুভূতি আমাদের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ছাড়া কিছুই না। মেডিটেশনের মাধ্যমে আপনি মস্তিষ্ক কে নিয়ন্ত্রণ করে মানসিক প্রশান্তি অর্জন করতে পারেন।
ধরুন আপনি আপনার কাজে সম্পুর্ন মনোযোগ কিছুতেই দিতে পারছেন না। কিছুদিন মেডিটেশন চর্চা করলে আপনি সহজেই যে কোন কাজে মনোযোগ দিতে পারবেন। আজকের অনলাইন আর ডিসট্রাশনের দুনিয়ায় মনোযোগ ই হলো সবচেয়ে বড় সুপার পাওয়ার।
আমরা সবসময় কিছু না কিছু করছি, জীবিকা, পড়ালেখার বাইরে যা সময় আমাদের বিনোদন ও বাড়তি কাজের উপরে ই আমাদের সব সময় চলে যায়। এর সমস্যাটা হলো আমাদের আত্মসচেনতা কমে আসছে, আমরা সহজে বুঝতে পারছি না আমাদের দায়িত্ব, সহানুভূতি, ভুল ঠিক ইত্যাদি। এই নিজ ও পরিপার্শ্ব সচেতনতার অভাবে আমরা অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি, অনেক সময় ও জীবনের অপচয় করে ফেলি, যা বয়ে আনে দুর্দশা ও দুঃসময়। মেডিটেশন এর মাধ্যমে আপনি সচেতন হওয়ার সময় টুকু নিজেকে দিতে পারবেন।
জটিল ভাবনা ও জ্ঞান চর্চার জন্য মেডিটেশনের জুরি নেই। পরবর্তী অংশে মেডিটেশন করার উপায় আলোচনা করার সময় এটি নিয়ে বিস্তারিত বলব। তাছাড়া মেডিটেশনের মাধ্যমে মনে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি, এন্জাইটি ডিসঅর্ডার, অ্যাজমা, ক্যান্সার, ব্যথা, ডিপ্রেশন, হার্ট ডিজিজ, উচ্চ রক্ত চাপ, পরিপাকে সমস্যা, ঘুমের সমস্যা সহ অনেক ধরণের রোগের ক্ষেত্রে ভালো উপকার পাওয়া যায়। পরবর্তী অংশে এগুলো নিয়ে ও আলোচনা থাকবে।
মেডিটেশন কিভাবে করবেন?
নিজে নিজে মেডিটেশন করার সবচেয়ে বড় সমস্যা টি হলো মেডিটেশনের সময় কি নিয়ে ভাবতে হবে, বা কি করতে হবে কিবা ঠিক করছি কিনা এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া একটু কষ্টসাধ্যই বটে, যদি আপনি না জানেন কোথায় খুঁজতে হবে। তবে আজকাল প্রতি শহরেই মেডিটেশন হেল্প সংস্থা ও ভালো প্রবন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তবে আপনি নিজেই একটু গাইড ফলো করে নিজে নিজেই অনুশীলন শুরু করতে পারেন।
-
মেডিটেশনের ভালো ব্যাপার টি হলো এর জন্য কোন কিছুই প্রয়োজন হয় না, আপনি যেকোনো জায়গায়, যে কোন অবস্থাতেই আপনার মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারেন। আসুন মেডিটেশন করার সঠিক উপায় এর দিকে যাওয়া যাক।
-
প্রথমত মেডিটেশনের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, কিন্তু অবশ্যই আপনাকে এর ভিত্তি টা আগে বুঝতে হবে। চলুন প্রথমেই সবচেয়ে জনপ্রিয় মেডিটেশনটা দিয়েই শুরু করা যাক। আপনি একটা শান্ত জায়গায় সোজা হয়ে বসে চোখ বুঁজলেন। এখানে সবগুলো শর্ত ই নতুন মেডিটেশন করার জন্য প্রয়োজন। আপনি চর্চা চালিয়ে গেলে মাছের বাজারে, এমনকি চোখ খুলে দাঁড়িয়ে ও মেডিটেশন করতে পারবেন। তবে সবসময় নীরব জায়গাই আরামদায়ক।
-
এখন আপনি আপনার নিঃশ্বাসে মনোযোগ দিতে থাকুন। নিশ্বাস কিভাবে নিচ্ছেন, ও নেওয়ার ফলে কি কি উপলব্ধি করছেন এসব। সমস্ত চিন্তাভাবনা মাথা থেকে খালি করে শুধুই আপনার নিশ্বাস নেওয়ার অনুভূতির উপর মনোযোগ দিন। আপনার চিন্তা ভাবনা অনেক দিকে ঘুরে যেতে চাইবে, অনেক বিষয় মাথায় আসবে যা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু মেডিটেশনের মূল বিষয়টাই হলো আপনার ভাবনা আবার নিঃশ্বাসে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। চর্চা করতে করতে আপনি একটা সময় খুব ভালোভাবে এটি করতে পারবেন।
-
এখানে নিঃশ্বাসের উদাহরণ দেওয়া হলো কারণ নতুন হিসেবে নিজের নিঃশ্বাসের উপর মনোযোগ দেওয়াই সবচেয়ে সহজ। পরবর্তীতে আপনি শরীরের যে কোন অনুভূতিকে কেন্দ্র করেই মেডিটেশন করতে পারেন।
-
এর ফলে আপনার মস্তিষ্কের মনোযোগের সক্ষমতা প্রচণ্ড বৃদ্ধি পাবে, মাথা খালি খালি ও ফুরফুরে অনুভূত হবে। মেডিটেশন হলো আপনার মস্তিষ্কের পুশ আপের মত। যত নিয়মিত আর বেশি সময় করবেন, আপনার মস্তিষ্কের পেশি বৃদ্ধি হবে।
-
মেডিটেশনের প্রচণ্ড শক্তিশালি হয়ে ওঠে যখন আপনি মেডিটেশনে মনোযোগের বিষয় প্রয়োজন মত ব্যবহার করতে পারেন। যেমন, ধরুন আপনি যদি আপনার ভালোবাসার মানুষ, দয়া ও মহানুভবতার উপর মেডিটেশন করেন আপনি অনেকটাই সুখি ও দয়ালু হতে পারবেন। আপনি যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার উপরে নিয়মিত মেডিটেশন করেন, আপনি ঐ সমস্যার এত গভীরে যেতে পারবেন, যা অকল্পনীয়। আমি উদাহরণের মাধ্যমে মেডিটেশনের অপার সম্ভাবনার কথাই বোঝাতে চাচ্ছি। যদিও এই আলোচনা গুলো কোন মেডিটিশিয়ানের বিকল্প নয়। সেই সাথে এও মাথায় রাখা দরকার যে, কিছু কিছু মানসিক রোগের ক্ষেত্রে মেডিটেশন ক্ষতিকর হতে পারে, সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ গুরুত্বপূর্ণ।
মেডিটেশন করার উপকারিতা সমূহ
মেডিটেশন করার মাধ্যমে অসংখ্য স্বাস্থগত ও আত্মিক উন্নয়ন সম্ভব হয়। চলুন একটা তালিকা করা যাক।
-
মেডিটেশনের মাধ্যমে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ও মানসিক স্থিরতা লাভ করা যায়।
-
আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করে।
-
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমিয়ে আনে।
-
হাঁপানি জনিত সমস্যায় সহায়ক।
-
ক্যান্সারের রোগীদের জন্য মেডিটেশন উপকারী।
-
অনিদ্রা রোগের জন্য উপকারী।
-
ধৈর্য ও সহনশীলতা বৃদ্ধি করে।
-
হৃদ গতি কমিয়ে আনে।
-
সৃজনশীল কাজের জন্য উপকারী।
-
ডিপ্রেশন নিয়ন্ত্রণে রাখতে উপকারী।
-
ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজে লাগে।
-
এ্যাজমা, পাকস্থলীতে গোলযোগ, টেনশনের কারণে মাথাব্যথায় কার্যকরী।
পরিশেষ
মেডিটেশন করা শেখার বিষয় নয়, বরং মেডিটেশনকে নিজের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মানিয়ে নেওয়া শেখা টাই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি মেডিটেশনের সময় নিজের মনকে স্থির রাখা শিখছেন, আর সেই স্থিরতা টা কাজে লাগছে আপনার সমস্ত কাজে। এই বিষয়টা একবার অনুধাবন ও নিজের ভেতর বপন করতে পারলে আপনি সমস্ত দিনই আত্ম সচেতনতা, ধীরতা ও উচ্চতর বোধের সুফল লাভ করতে পারেন।
“You have a treasure within you that is infinitely greater than anything the world can offer” – Eckhart Tolle.