আউটডোর ব্যায়ামের ২০টি বিস্ময়কর উপকারিতা
মাটির সংস্পর্শ আপনার ফিটনেসকে কিভাবে রুপান্তর করতে পারে তা জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। প্রকৃতির মাঝে ব্যায়াম করে আপনার ব্যাক্তিগত ফিটনেসকে নতুন স্তরে নিয়ে যেতে পারেন। আসুন আউটডোর গেমস বা ব্যায়ামের বিস্ময়কর উপকারিতাসমূহ সম্পর্কে জেনে নেই।

কখনো কি ভেবে দেখেছেন গ্রামের একটা কিশোর ছেলেকে ২০ কেজির কোনো ভার দিলে তা সহজেই উঠিয়ে ফেলে। কিন্তু একই বয়সের কোনো শহরের ছেলেকে সেই কাজ দিলে তার অবস্থা খুব করুণ হয়ে যায় কেনো?
এটাই শহরের ও গ্রামের পার্থক্য। আরো নিখুতভাবে বলতে গেলে শহরের ও গ্রামের পরিবেশ ও প্রকৃতির মাঝে পার্থক্য। গ্রামের লোকজন সবসময় প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকে কিন্তু শহরে সে আবহাওয়া নেই।
আজকে আমরা জানবো আপনার ফিটনেস বাইরের পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর কিভাবে নির্ভরশীল। অর্থাৎ আউটডোর বা বাইরে ব্যায়াম করার সুফল কি? কিন্তু প্রথম প্রশ্ন হলো আউটডোর এক্সারসাইজ বলতে মূলত আমরা কি বুঝি? সহজ কথায় আউটডোর গেমস এবং এক্সারসাইজ বলতে বোঝানো হয় ঘরের বাইরে অর্থাৎ কোনো পার্কে, বিচে অথবা যেকোনো আউটডোর পরিবেশে ব্যায়াম এবং খেলা করা।
আউটডোর ব্যায়াম করার উপকারিতা
সকালবেলা নরম সূর্যের মিষ্টি রোদ আপনার ত্বকে চুমু দিচ্ছে, এদিকে আপনি কানের হেডফোনে আপনার প্রিয় গান শুনতে শুনতে দৌড়াচ্ছেন, গাছে গাছে নতুন ফুলের সুবাস আপনার নাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। না এটা কোনো স্বপ্ন না। এটা আউটডোর এক্সারসাইজের একটা বাস্তব চিত্র। টেকনোলজির এই যুগে আমরা প্রতিনিয়তই ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছি। চার দেয়ালের মাঝে আটকে রাখছি নিজেকে। তাই প্রকৃতির ছোয়া পাওয়া আমাদের কাছে হয়ে উঠছে দুর্লভ। আমাদের ফিটনেসের স্কোর কমতেই আছে।
কিন্তু প্রকৃতির ছোয়ায় বা সংস্পর্শে থেকে ব্যায়াম করার উপকারিতাসমূহ জানলে আপনি নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবেন। মানুষের স্বাস্থ্য প্রধানত দুই ধরণের– শারীরিক ও মানসিক। আউটডোর ব্যায়াম আমাদের এই ধরণের স্বাস্থ্যের উন্নতিতেই ভূমিকা রাখে। তো চলুন জেনে নেওয়া যাক আউটডোর এক্সারসাইজের মাধ্যমে কি কি শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা পাওয়া যেতে পারে।
আউটডোর ব্যায়ামের ৯টি শারীরিক উপকারিতা
১. হৃৎপিন্ডের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি
হৃৎপিন্ডের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে
রানিং, সাইকেলিং, জগিং এর মতো আউটডোর এক্সারসাইজসমূহ আপনার হার্ট রেট বৃদ্ধি করে এবং সময়ের সাথে সাথে কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তোলে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
নিয়মিত আউটডোর এক্সারসাইজের ফলে ব্লাড প্রেসার কমে আসে এবং এ সম্পর্কিত রোগের ঝুকি কমে যায়।
২. পেশির শক্তি বৃদ্ধি ও দীর্ঘস্থায়িত্ব
শরীরের পেশিসমূহকে কার্যকর করে
নরম বালি কিংবা পাথরের স্পর্শ শরীরের বিভিন্ন পেশীকে কার্যকর করে এবং সামগ্রিক শক্তি এবং সহনশীলতা বাড়ায়।
পেশি স্থিতিশীলকরণ
বাইরের অসমান্তরাল ভূমি শরীরের পেশিকে স্থিতিশীল করে তোলে।
৩. ওজনের ভারসাম্যতা
ক্যালোরি বার্ন
বাইরে শারীরিক কসরত করলে শরীরে যথেষ্ট ক্যালোরি বার্ন হয় যা ওজনের ভারসাম্য রক্ষা করতে জরুরী।
চর্বি ক্ষয়
আউটডোর এক্সারসাইজ শরীরের চর্বি ক্ষয় করতে সহায়তা করে। যা শ্বাস ও ঘামের মাধ্যমে দেহ থকে বের হয়ে যায়।
৪. শ্বসনতন্ত্র সুস্থ রাখ
ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়ায়
বাইরের সতেজ বাতাসে ব্যায়াম করলে তা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
হাপানির লক্ষণ দূর হয়
বাইরের সতেজ বাতাসে ব্যায়াম করার ফলে অনেক হাপানি রোগী খানিকটা লাভবান হয়।
৫. হাড়ের স্বাস্থ্য
ভিটামিন ডি উৎপাদন
সকালের মিষ্টি রোদে ব্যায়াম দেহে ভিটামিন ডি উৎপন্ন করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
হাড়ের শক্তি বৃদ্ধি
হাটা ও হাইকিং এর মতো ব্যায়ামগুলো দেহে হাড়ের ঘনত্ব বাড়ায় এবং অস্টিওপেরেসিস এর ঝুকি কমায়।
৬. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
রোগ প্রতিরোধ সিস্টেমের শক্তি বাড়ায়
নিয়মিত আউটডোর এক্সারসাইজ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
শারীরিক প্রদাহ থেকে বাচায়
আউটডোর ব্যায়াম শারীরিক প্রদাহ থেকে শরীরকে রক্ষা করে এবং এ সম্পর্কিত রোগের ঝুকি কমায়।
৭. মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে
মেটাবলিজমের হরমোনসমূহকে সক্রিয় করে
আউটডোর এক্সারসাইজ মেটাবলিজমের হরমোনসমূকে সক্রিয় করে তোলে।
ইনুসিলিন সেনসেটিভিটি
আউটডোর ব্যায়াম ইনুসিলিন সেনসেটিভিট বাড়ায় যা দুই ধরণের ডায়বেটিস থেকে আমাদের রক্ষা করে।
৮. সন্ধি স্বাস্থ্য
সাতার ও সাইকেলিং এর মতো আউটডোর এক্সারসাইজ শরীরের সন্ধিসমূকে কার্যকর করে তোলে। ফলে সন্ধি ব্যাথা বা বাত ব্যাথার ঝুকি অনেকটা কমে যায়।
এছাড়াও আউটডো এক্সারসাইজের ফলে সন্ধিতে প্রাকৃতিক লুব্রিকেন্ট উৎপন্ন হয় যা সন্ধিকে ভালো রাখে।
৯. দেহের নমনীয়তা বৃদ্ধি
ন্যাচারাল স্ট্রেচিং
আউটডোর ইয়োগা ও স্ট্রেচিং এর মতো ব্যায়াম দেহের ফ্লেক্সিবিলিটি বৃদ্ধি করে।
পেশির জড়তা দূর করে
সতেজ বাতাস ও প্রাকৃতিক পরিবেশে ব্যায়াম শরীরের পেশিসমূহকে শিথিল করতে ও পেশির জড়তা দূর করতে সাহায্য করে।
নিয়মিত আউটডোর ব্যায়াম আপনাকে এমন এমন শারীরিক উপকারিতা দিবে যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। তাই বাইরে পা রাখুন, প্রকৃতিকে নিজের জিম বানিয়ে নিন, নিজেকে আরো সুখী, স্বাস্থ্যবান এবং শক্তিশালী করে তুলুন।
আউটডোর ব্যায়ামের ১১টি মানসিক উপকারিতা
আউটডোর এক্সারসাইজ শুধু শারীরিকভাবেই উপকার দেয় তা নয়। মানসিকভাবেও আপনাকে আরো উন্নত করে তোলে। চলুন জেনে নেওয়া যাক আউটডোর ব্যায়ামের মানসিক উপকারিতাসমূহ।
১. দুশ্চিন্তা দূর করে
প্রকৃতির নির্মল বাতাস ও আওয়াজ দুশ্চিন্তা দূর করতে সাহায্য করে এবং মনকে প্রশান্তি দেয়।
২. মন ভালো রাখে
আউটডোর এক্সারসাইজের ফলে দেহে এন্ডোরফিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন মন ভালো করার হরমোন নামে পরিচিত। এই হরমোনের ফলে ডিপ্রেশন ও মন খারাপ দূর হয়ে যায়।
৩. মানসিক স্পষ্টতা ঠিক রাখে
বাইরের পরিবেশ মনের ফোকাস ধরে রাখতে সাহায্য করে যার ফলে মানসিক স্পষ্টতা বজায় থাকে।
৪ ভালো ঘুম উপহার দেয়
শারীরিক পরিশ্রম ও কসরতের ফলে রাতে ভালো ঘুম হয় যা একটি সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যর গুরুত্বপূর্ণ অংশ
৫. টেকনোলজির ওপর নির্ভরশীলতা কমায়
আউটডোর এক্সারসাইজ এ নিজেকে ব্যাস্ত রাখলে টেকনোলজির ওপর নিজের নির্ভরশীলতা কমে আসে। যা মানসিকভাবে নিজেকে ঠিক রাখার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
৬.. প্রকৃতির সাথে মেলবন্ধন
নিয়মিত আউটডোর এক্সারসাইজের ফলে প্রকৃতির সাথে আত্নার একটা মেলবন্ধন তৈরি হয়। যা মানসিক জোর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৭. আবেগের সহনশীলতা
বাইরের পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং সেই শক্তি জীবনের চ্যালেঞ্জে কাজে লাগানোতে আউটডোর এক্সারসাইজ বড় ভূমিকা রাখে।
৮. সামাজিক সম্পর্ক বাড়ায়
আউটডোর বিভিন্ন গ্রুপের কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারলে সামাজিক সম্পর্ক ভালো হয়ে ওঠে যা পরে অনেক কাজে দেয়।
৯. সৃজনশীলতা বাড়ে
প্রকৃতির সংস্পর্শে নিজেকে রাখলে আপনাআপনি তা নিজের সৃজনশীল আইডিয়া বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
১০. পজিটিভ চিন্তাভাবনা
নিয়মিত আউটডোর এক্সারসাইজ নিজের চিন্তাভাবনাকে আরো পজিটিভ করে তোলে। নেগেটিভ বিষয় থেকে নিজেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে।
১১. আত্নবিশ্বাস বাড়ায়
পরীক্ষায় প্রমাণিত আউটডোর এক্সারসাইজ নিজের আত্নবিশ্বাস ও আত্নসম্মান বৃদ্ধিতে অনেক সহায়তা করে।
বিভিন্ন ধরণের আউটডোর এক্সারসাইজ
আউটডোর এক্সারসাইজের বিভিন্ন প্রকার ও অপশন আছে। যার প্রত্যেকটার লক্ষ্য ও প্রক্রিয়া আলাদা। তাই সঠিক আউটডোর এক্সারসাইজ নির্বাচন করুন যেটা আপনার জন্য উপযুক্ত। চলুন জেনে নেওয়া বিভিন্ন এক্সারসাইজের নামঃ
-
রানিং ও জগিং
-
সাইকেলিং
-
হাইকিং
-
ওয়াকিং
-
সুইমিং
-
কায়াকিং
-
ক্লাইম্বিং
-
ইয়োগা
-
দলগত খেলা
-
পার্কর
-
বিচ ভলিবল
-
এরিয়েল ইয়োগা
-
টেনিস
-
গলফ
-
সার্ফিং
-
দেশীয় খেলা যেমন- কাবাডি, খো-খো, হ্যান্ডবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি
আউটডোর ব্যায়ামের ক্ষেত্রে বাধাসমূহ
টেকনোলজির এই যুগে আউটডোর এক্সারসাইজের ক্ষেত্রে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তবে সেই বাধাগুলো গ্রামের চেয়ে শহরে অনেক বেশি। যেমন-
১. খোলা জায়গার অভাব
শহরের ঘন ঘন দালান, বিল্ডিং সেখানে একরকম সূর্যের রোদ পাওয়ায় কষ্টের বিষয় তার উপরে আউটডোর ব্যায়াম করার জন্য খোলা জায়গা পাওয়া আরো দুর্লভ। একারনে অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও আউটডোর এক্সারসাইজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
২. বিরুপ আবহাওয়া
অনেক সময় বিরুপ ও প্রতিকুল আবহাওয়ার ফলে বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না এবং আউটডোর ব্যায়াম করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
৩. ব্যাস্ততা
দৈনন্দিন ব্যাস্ততা ও কাজকর্মের ফলে আউটডোর এক্সারসাইজের জন্য আলাদা করে সময় বের করা অনেকটা কষ্টসাধ্য।
৪. অলসতা
অনেকের ক্ষেত্রে আউটডোর এক্সারসাইজের ইচ্ছা থাকলেও সেটা করার উপায় হয় না। কারন একটাই অলসতা। অলসতার জন্য মানুষ পরিশ্রম ও ব্যায়াম থেকে দূরে থাকতে চায়।
৫. আউটডোর এক্সারসাইজের উপকরণ
অনেক আউটডোর এক্সারসাইজের ক্ষেত্রে অনেক দামি দামি যন্ত্র ও উপকরণের প্রয়োজন হয়। যা অনেকের সাধ্যের বাইরে।
শেষকথা
আউটডোর এক্সারসাইজের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যর উন্নতি করা সম্ভব। বাইরে খোলা আকাশের নিচে ব্যায়াম শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে এবং মানসিক চিন্তা দূর করতে সাহায্য করে। সতেজ বাতাসের ছোয়ায় এক্সারসাইজ করা, খোলা আকাশে বা প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটানো শারীরিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে এবং মানসিক স্বাস্থ্যর স্থিতিশীলতা ঘটায়।
আউটডোর এক্সারসাইজ করার মাধ্যমে আমরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি এবং ভালো স্বাস্থ্যের সাথে সাথে একটি সুন্দর সম্মিলিত সমাজকে নির্মাণ করতে পারি।