কেন সোজাসুজিভাবে চলাচল করবেন?
আপনার কথা বলার ভঙ্গীতেই আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠতে পারে, আর সে জন্য একদম সোজা হয়ে কথা বলাটা প্রয়োজন। অবশ্য এভাবে কথা বললে যে শুধু আপনাকে আত্মবিশ্বাসীই মনে হবে তা নয় বরং এর রয়েছে অনেক স্বাস্থ্যগত উপকারিতা। আজকে আমরা কথা বলতে যাচ্ছি মেরুদণ্ড সোজা রেখে এমন দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে চলাফেরা করার বেশ কিছু উপকারিতা নিয়ে। আশাকরি আপনি এর পর থেকে সবসময় চেষ্টা করবেন একদম সোজা হয়ে চলাফেরা এবং কথা বলার জন্য।
আপনি কি কুঁজো হয়ে চলাফেরা করছেন নাকি একদম সোজা হয়ে চলাফেরা করছেন তার উপর অনেকটাই নির্ভর করছে আপনার সুস্থ থাকা এবং আরামদায়ক জীবনের নিশ্চয়তা। এই বিষয়ে কানাডিয়ান স্পাইন সোসাইটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডঃ হ্যামিলটন বলেন, “এভাবে সোজা হয়ে চলার মূল উদ্দেশ্য হল আপনার মেরুদণ্ডে যাতে কোন ধরণের বাড়তি চাপ না পরে”।
আদতে শরীরের দুই ধরণের ভঙ্গী হয়ে থাকে। প্রথমত আপনি যখন হাঁটাচলা করেন তখন আপনার শরীরের অবস্থানকে ডায়নামিক বলা হয়। দ্বিতীয়ত আপনি যখন দাঁড়িয়ে, শুয়ে অথবা বসে অর্থাৎ শরীর স্থির থাকে তখনকার ভঙ্গীকে বলা হয় “স্ট্যাটিক”। ঝুঁকে চলাফেরা করা, ঝুঁকে ফোন চালানো, হাই হিলের জুতো পরিধান করা ইত্যাদি অনেক কাজের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়তই মেরুদণ্ডের উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকি।
প্রথমতই আমরা বুঝতে পারি যে, সোজা হয়ে চলাফেরা করার মাধ্যমে মেরুদণ্ডে স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব। সোজা হয়ে থাকলে মেরুদণ্ডের এলাইনমেন্ট ঠিক থাকে এবং আপনি আরামে থাকেন। আর এই বিষয়টা মেনে চলা কিন্তু যে কোন বয়সের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই সোজা ভঙ্গির কারণে যে আপনি কেবল মাত্র শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকবে তা নয় বরং মানসিক ভাবেও আপনি অনেক দৃঢ় প্রত্যয়ী থাকবেন।
আসুন তাহলে দেখে নেই ঋজু ভঙ্গী নয় বরং সোজা হয়ে দৃঢ় ভাবে চলাফেরা করার কি কি উপকারিতা রয়েছে-
আপনি হয়ে উঠবেন আত্মবিশ্বাসী
এ সম্পর্কে ডঃ হ্যামিলটন বলেন, “এটা কিন্তু আদতেই একদম সত্য যে আপনি যখন একদম সোজা হয়ে দাঁড়াবেন, তখন আপনাকে দেখতেও বেশ ভালো লাগবে”। এছাড়াও তিনি সোজা হয়ে থাকার সাথে মানসিক ভাবে দৃঢ় থাকার বিষয়টি নিয়েও বলেন যে, আমাদের শরীরের সঠিক এই বিন্যাসের সাথে আত্মবিশ্বাস এবং সুস্থ মনের অধিকারী হওয়ার যে সংযোগ রয়েছে এই বিষয়টি আমাদের অনেকেরই জানা নেই একদম।
শারীরিক ভারসাম্য বজায় থাকে
আমরা যদি দৃঢ় ভাবে সোজা হয়ে দাঁড়াই তাহলে আমরা বেশ চমৎকার ভাবে নিজেদের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারব। এ সম্পর্কে ডঃ ডেবি চং বলেন, দৃঢ় হয়ে চলাফেরা করার মাধ্যমে আমরা ভারসাম্য হারিয়ে পরে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারি। এছাড়া ডঃ ডেবি আরো বলেন যে, মেরুদণ্ড যখন সোজা হয়ে থাকে তখন শরীরের অন্যান্য অঙ্গের নড়াচড়াও স্বাভাবিক ভাবে হয়ে থাকে। এছাড়াও আপনি লক্ষ্য করে অবাক হবেন যে শরীরের মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলাচল করলে আপনি অনেক উঁচু পর্যন্ত নিজের হাত উঁচু করতে পারবেন।
কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে
আপনার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো যখন খুব চমৎকার ও স্বাভাবিক ভাবে নড়াচড়া করবে তখন আপনি নিজের কর্মক্ষমতা এবং প্রাণবন্ত চলাফেরা দেখে নিজেই অবাক হবেন। এর কারণ হল মেরুদণ্ডের সাথে আদতে শরীরের সবগুলো অঙ্গ প্রগাড় ভাবে জড়িত আর আপনার মেরুদণ্ড যখন সুস্থ ও স্বাভাবিক ভঙ্গীতে থাকবে তখন বাকি অঙ্গগুলোও সুস্থ ও স্বাভাবিক ভাবে নড়াচড়া করবে। এর পাশাপাশি অবসাদ গ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকাংশে কমে যায়।
হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়
ব্যাপারটা সত্যই খুব অবাক হওয়ার মত একটি বিষয় যে, আপনার মেরুদণ্ড স্বাভাবিক ও সোজা থাকার কারণে শরীরের হজম শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এই সম্পর্কে ডঃ ডেবি বলেন, আমাদের শরীরের ভঙ্গী যখন সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে না তখন সেটা স্বাভাবিক ভাবে কর্মক্ষমও হয় না।
যেহেতু শরীরের অঙ্গগুলোর অবস্থান সঠিক থাকে না তাই তখন আমাদের শরীর খাবারগুলো ভালোভাবে হজমও করতে পারে না। এমনকি ২০১৯ সালে সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের শরীরের ভঙ্গীর উপর হজম শক্তি তো নির্ভর করছেই, এমনকি খাবার আপনার কাছে বেশি সুস্বাদু লাগবে, যদি আপনি আরাম করে কোথায় বসে এরপর খাবার গ্রহণ করেন।
হাড় ও জয়েন্টের ব্যথা
আপনি যদি সোজা হয়ে না বসেন তাহলে মেরুদণ্ডের উপর একটা প্রেশার সৃষ্টি হয় আর দীর্ঘদিন ধরে এভাবে থাকার ফলে হাড় ও জয়েন্টের ব্যথা শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
শ্বাস প্রশ্বাস প্রক্রিয়া
হজম শক্তি ঠিক যেভাবে শরীরের ভঙ্গীর উপর নির্ভর করে ঠিক একই ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার সাথেও এর সরাসরি সংযোগ রয়েছে। কেননা শরীরের ভঙ্গী সোজা থাকার মানে হল আদতে অভ্যন্তরীণ অঙ্গের পাশাপাশি শ্বাসনালীও সোজা থাকা।
এছাড়াও আমাদের মস্তিষ্ক সঠিক ভাবে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন পরে। আর শারীরিক ভঙ্গী যখন সোজা ও দৃঢ় থাকে তখন অক্সিজেনের জোগানেও কোন প্রকার ঘাটতি দেখা যায় না।
রক্ত সঞ্চালনের উপর প্রভাব
ঠিক যেভাবে হজম ও শ্বাস প্রশ্বাসের উপর আপনার শরীরের ভঙ্গী প্রভাব বিস্তার করে ঠিক সেভাবেই আপনি কীভাবে বসছেন অথবা হাঁটছেন সেটার উপরেও শরীরের রক্ত চলাচলের স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি নির্ভর করে থাকে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে শরীরের দৃঢ় ভঙ্গী আদতে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
মেরুদণ্ড স্বাভাবিক ও সোজা রেখে বসতে পারছেন কি না সেটা কীভাবে বুঝবেন?
আমাদের মেরুদণ্ডের তিনটি বাঁকা অংশ রয়েছে। প্রথমটি হল ঘাড়ের ঠিক নিচের অংশ, দ্বিতীয় মেরুদণ্ডের উপরের ভাগের অংশ এবং তৃতীয় অংশটি হল মেরুদণ্ডের একদম নিচের দিকে যেখানে কোমর এবং মেরুদণ্ডের সংযোগ হয়েছে তার ঠিক উপরে।
আমরা যখনই বসি অথবা হাঁটাচলা করি তখন আসলে এই তিনটি বাঁকা অংশের উপরেই আমাদের ভর পরে। আর তাই আমাদের এমন ভাবে সোজা হয়ে বসা এবং চলাফেরা করা উচিৎ যাতে করে এই বাঁকা অংশগুলোর উপরে কোন অতিরিক্ত ভার না পরে।
দাঁড়ানো অবস্থায় শরীরের ভঙ্গী কি হবে?
দাঁড়ানো অবস্থায় শরীরের ভঙ্গী স্বাভাবিক রাখার জন্য যে বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের নজর রাখতে হবে সেগুলো নিম্নরূপঃ
-
মাথা সবসময় ঘাড়ের উপরে সোজা করে রাখতে হবে।
-
দুই বাহু কোমরের দুই পাশ বরাবর সোজা করে রাখতে হবে
-
পা ও ঠিক সমতল অবস্থায় ফ্লোরে রাখতে হবে।
-
এছাড়াও লক্ষ্য রাখতে হবে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের উপর যাতে ভর থাকে।
বসা অবস্থায় শরীরের ভঙ্গী কীরূপ হবে?
বসা অবস্থাতে আপনার শরীরের ভঙ্গী কেমন হওয়া উচিৎ সেগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলঃ
-
বসা অবস্থাতেও মাথা সবসময় ঘাড়ের উপরে সোজা করে রাখতে হবে।
-
চোখের দৃষ্টি যতটা সম্ভব সোজা সামনের দিকে রাখতে হবে।
-
সামনে যদি কম্পিউটার স্ক্রিন থাকে, তাহলে স্ক্রিন সেভাবে এডজাস্ট করে নিতে হবে যাতে দৃষ্টি সরাসরি স্ক্রিন থাকে।
-
চেয়ারের একদম শেষ মাথায় চেপে বসতে হবে যাতে করে মেরুদণ্ড সোজা থাকে।
-
চেয়ারের উচ্চতা এডজাস্ট করে নিন যাতে করে দুই পায়ের পাতা সমতল ভাবে ফ্লোরের উপর রাখতে পারেন।
-
বেশীক্ষণ একটানা বসে থাকবেন না। কিছুক্ষণ পরপর একটু উঠে হাঁটাহাঁটি করুন।
হাঁটাচলা করার সময় শরীরের ভঙ্গী কীরূপ হবে?
-
আপনি যখন হাটাহাটি করবেন তখন খেয়াল রাখবেন যাতে কোন ভাবেই ঋজু না হয়ে হাঁটা হয়।
-
বাহু কোমর বরাবর সোজা করে রেখে দুই হাত ঝুলিয়ে রাখুন।
-
পা রাখার সময় প্রথমে গোড়ালি রাখার চেষ্টা করবেন।
সোজাসুজিভাবে চলাচল করলে আপনার জয়েন্ট, লিগামেন্ট এবং পেশীর উপর চাপ অনেকাংশে কমে যাবে যা আপনাকে সুস্থ্য রাখতে দারুণভাবে সাহায্য করে। তাই আপনি যখন যাতায়াত করবেন অথবা অফিসে বসে কাজ করবেন তখন আপনার বসার জায়গাটি সামঞ্জস্য করে নিন যাতে আপনি সোজা হয়ে থাকতে পারেন।
এবং অবশ্যই, দীর্ঘ সময় ধরে না বসে থাকার চেষ্টা করুন। প্রতি ৩০-৪৫ মিনিট পর উঠে ঘোরাফেরা করুন। এই সমস্ত অভ্যাসগুলি আপনার জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন তৈরি করতে পারে এবং ব্যথা উপশম করতে পারে।