স্বপ্ন পূরণে চাই সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও পদক্ষেপ!
মানুষ স্বভাবত স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছাতে শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না, চাই কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ। স্বপ্নটাকে বাস্তবে রুপান্তর করতে গেলে আমাদের সামনে আসে কিছু চ্যালেঞ্জে ও বাধা-বিপত্তি। স্বপ্ন আকাশছোঁয়া হোক অথবা বাস্তবসম্মত, বাস্তবমুখী কিছু উপায় অবলম্বন করলে লক্ষ আর অসম্ভব থাকে না। তাই আসুন জেনে নিই লক্ষপুরনের সেই উপায়গুলো!
মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রেই লক্ষ্য নির্ধারণ করাটা খুব জরুরি। হোক সেটা ব্যক্তিগত বা কর্মক্ষেত্র বা পড়াশুনা নিয়ে। লক্ষ্যবিহীন মানুষ আর পাল ছাড়া নৌকা একই কথা, কেউই তীরের মুখ দেখে না। মানুষ হিসেবে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে পদার্পণের পিছনেও সৃষ্টিকর্তার নিগূঢ় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিহিত আছে। প্রতিটা মানুষ জীবনে ছোট ছোট বা বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকে। সেই অনুযায়ী অনেক কঠোর পরিশ্রমও করে থাকে, তবে সেই অনুযায়ী সফলতা আসে না। কারণ আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, বেশিরভাগ মানুষ জানেই না, তার ঠিক করা লক্ষ্য সে কীভাবে বাস্তবায়ন করবে। লক্ষ্য নির্ধারণের কিছু বাস্তবমুখী উপায় জানতে পুরো প্রবন্ধটি পড়ুন এবং আমাদের সাথেই থাকুন।
লক্ষ্য নির্ধারণ কী?
লক্ষ্য মানুষের জীবনের এক অন্যতম অনুপ্রেরণা। এই অনুপ্রেরণার জোরেই মানুষ অসাধ্যকে সাধন করে। লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যে ছাড়া কোনো কাজই ঠিকমত করা সম্ভব না। কোনো কাজ শুরুর আগে কাজের ফলাফল কি হবে তা ঠিক করে নেয়াই লক্ষ্য নির্ধারণ।
একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছানোর জন্যই মানুষ যাত্রা করে থাকে। এই নির্দিষ্ট গন্তব্যই হল লক্ষ্য।
লক্ষ্য নির্ধারণ কেন জরুরী?
লক্ষ্য নির্ধারণ করার ফলে কাজ বাস্তবায়ন করার জন্য সহজে পরিকল্পনা করা যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করলে কাজে সাফল্য অর্জন করা সহজ।
পৃথিবীর মানুষের জন্য দুর্গম এভারেস্ট জয় করা একদম অসম্ভব ছিল। কিন্তু বহু বছরের সাধনায় এই দুঃসাধ্য কাজও মানুষের আয়ত্তে চলে আসছে। এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করার ফলে। কিছু দুঃসাহসিক মানুষের দ্বারা নির্ধারিত এই লক্ষ্যই এক সময় বাস্তবায়িত হয়।
লক্ষ্য নির্ধারণের বাস্তব উপায়
লক্ষ্য নির্ধারণের গুরুত্ব সম্পর্কে তো জানলাম, এখন আসুন জেনে নিই নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাবার বাস্তব উপায়সমূহ।
চিন্তা করুন
যেকোনো কাজ করার আগে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই করা উচিত। তেমনি আমরা প্রায় প্রত্যেকেই জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকি। সেটা যদি এমন হয় যে কেউ ভাবলো- আমি পড়াশুনা করে 'বড়' কিছু হব। এভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করা আর না করা প্রায় সমান কথা।
পড়াশুনা করার সময়ই আপনাকে ভেবে নিতে হবে যে আপনার জীবনকে কোনদিকে গড়তে চান। সে অনুযায়ী আপনার পড়াশুনা করতে হবে। তাই লক্ষ্য নির্ধারণের পূর্বেই চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করে নিতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করুন
চিন্তা-ভাবনা করে যখন আপনার কোনো কাজের পরিকল্পনা করে ফেলেছেন, তার পরবর্তী কাজ হবে সেই কাজ বা উদ্দেশ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য স্থির করা। যেকোন কাজ করার আগে তার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল কি হবে সেটা অনুমান করে আগানো বুদ্ধিমানের কাজ।
পেশাগত জীবনে আপনি কোন দিকে যেতে চান সেটা আপনাকে স্কুল বা কলেজ জীবনে নির্ধারণ করে নিতে হবে। এটাই দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য।
লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলোকে ছোট ছোট ভাগে বিভাজন করে নিন
জীবনের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করার পরে ভাবতে হবে তা কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য ভিশনকে ছোট ছোট মিশনে বিভাজন করে নিতে হবে।
আপনার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হলো ভিশন আর তা বাস্তবে রূপ দিতে ছোট ছোট পদক্ষেপ নেয়া হল মিশন।
মনে করেন যে, আপনি একজন ছাত্র, পরবর্তীতে আপনি ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চান। সেক্ষেত্রে আপনাকে কিন্তু স্কুল লাইফেই ভালোভাবে গণিতসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে তুখোড় হতে হবে। এখানে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পরিকল্পনা হলো দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। আর তার প্রস্তুতি হিসেবে আপনাকে বিজ্ঞানের বিষয়ে ভালো করা হলো দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের ধাপ।
আবার ধরে নেন, আপনি ব্যবসায়ী হতে চান; এইজন্য যে ব্যবসায় করতে চান সেটা নিয়ে ভালো করে জেনে নিতে হবে। যারা এই ব্যবসায় করছে তাদের থেকে জানতে হবে।
যে যেই কাজ বা লক্ষ্য নির্ধারণ করেন না কেনো সেখানে পৌঁছানোর জন্য পুরো পরিকল্পনাকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিলে তা বাস্তবে রূপ দেয়া সহজ হয়।
সহনীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করুন
ছোট ছোট পদপক্ষেপগুলোকে লক্ষ্য হিসেব করে নিতে হবে। নিজেকেই নিজের লক্ষ্য দিতে হবে। তবে লক্ষ্য এমন হতে হবে যাতে সেটা পূরণ করা সহজ হয়। লক্ষ্য যদি বেশী পরিমাণে নির্ধারণ করা হয় তবে তা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এতে লক্ষ্য বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, আরও হতাশা ঝেঁকে বসবে।
যেমন কেউ হয়তো তার ওজন কমানোর জন্য হাঁটার পরিকল্পনা করলেন একদিনে ২ ঘন্টা। প্রথমদিন হাঁটতে যেয়েই তার অবস্থা শোচনীয় হয়ে যাবে। পরের দিন সে আর হাঁটার মত শক্তি পাবেন না। এভাবে না করে যদি ১ম দিন ২০মিনিট হাঁটার পরে আস্তে আস্তে সময় বাড়ানো যেতে পারে। এতে ১ম দিনের টার্গেট পূরণ হলে তার মধ্যেও আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন
একজন মানুষ যদি তার নিজের কাজের জন্য নিজের কাছেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় তবে অনেক অসাধ্য কাজও করে ফেলা সম্ভব। একমাত্র নিজের কাছ থেকেই মানুষ পালাতে পারে না। তাই আপনার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন কাজটা ঠিকঠাকভাবে করার জন্য নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকা একান্ত জরুরী।
কাজগুলোকে লিখে রাখুন
লক্ষ্য নির্ধারণ করার পর একটা ছোট ডায়েরি বা নোটপ্যাডে লিখে রাখুন। এই কাজটা অতি অবশ্যই করতে হবে। লিখে ফেলা মানেই আপনার মাথায় জিনিসটা গেঁথে গেল। এতে লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আপনার ভেতর থেকে এক ধরণেরর তাড়া অনুভব করবেন।
লক্ষ্য কিছুটা পূরণ হলে তাও লিখে ফেলুন। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে, আপনার অর্জন দেখে। ছোট অর্জন হলেও তা লিখে রাখবেন।
বর্তমান সময়ে স্মার্টফোনেও এই লেখার কাজটা করে ফেলতে পারেন। তবে লেখার মাধ্যম যেটাই হোক লেখাটা মাঝেমাঝে পড়তে হবে। এর ফলে একদিকে প্রেরণা পাবেন অন্যদিকে লক্ষ্য পূরণের জন্য নতুন নতুন পরিকল্পনাও করতে পারবেন৷
নিয়মিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিরূপণ করুন
লক্ষ্য অর্জনের পথটা যেকোনো মানুষের জন্যই খুব সুগম হয় না। লক্ষ্য নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিতভাবে লক্ষ্য বাস্তবায়নের অগ্রগতি বা ধীরগতি নিরূপণ করতে হবে। সে অনুযায়ী পরবর্তী পরিকল্পনা করতে হবে।
কয়েকটি পরিকল্পনা নির্ধারণ করে রাখুন
দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সম্ভব হলে একসাথে ২/৩ টি পরিকল্পনা নির্ধারণ করে লিখে ফেলুন। একে প্ল্যান 'এ/বি/সি' নামে লিখে রাখুন।
পরিকল্পনা ২/৩ টি নির্ধারণ করা হলেও, লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে দিন। কোনো কারণে যদি প্রথম বা প্ল্যান 'এ' অনুযায়ী আশানুরূপ ফল না পাওয়া যায় তবে প্ল্যান 'বি' অনুযায়ী কাজ শুরু করবেন৷ এভাবে আগেই কয়েকটি প্ল্যান করাতে কোনো পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ না হলেও হতাশাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে ন।
বন্ধু ও প্রিয়জনকে জানিয়ে রাখুন
আপনার কাছের মানুষ/ প্রিয়জন/ শুভাকাঙ্ক্ষীকে আপনার লক্ষ্যের কথা জানিয়ে রাখুন। এতে তারা আপনাকে নানা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন৷ মাঝে মাঝে তারা আপনার লক্ষ্য বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেও নিজের ভেতর স্পৃহা পাবেন।
তবে এক্ষেত্রে যাদের আপনি সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে যাদের মনে করেন, তাদের জানাতে পারেন৷ না হলে হিতে বিপরীতও হতে পারে।
নিজেকে উপহার দিন
নিজের ছোট বড় অর্জনে নিজেই নিজেকে উপহার প্রদান করুন। কোনো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার পেলে কাজের স্পৃহা বেড়ে যায় বহুগুণ। কারও আশায় না থেকে নিজের অর্জনে নিজেই উদযাপন করুন।
নেতিবাচক কথা থেকে দূরে থাকুন
নেতিবাচক কথা মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে দিতে পারে। কিছু মানুষ থাকে যারা সবসময় খারাপটাই ভাবতেই ভালোবাসেন। এদের সঙ্গ ত্যাগ করাই মঙ্গলজনক। নিজে নেতিবাচক চিন্তা ও কাজ থেকে দূরে থাকুন, তবেই লক্ষ্য অর্জনের পথটা সহজ হবে।
সৃস্টির সেরা জীব 'মানুষ' হিসেবে পৃথিবীতে আমাদের আগমন ঘটেছে। এই আগমন যাতে বৃথা না যায় তার জন্য আমাদের প্রাণপন চেস্টা করতে হবে। প্রতিটি মানুষ যদি নিজের নিজের ক্ষেত্রে উন্নতি করে তবেই দেশের উন্নতি হবে তথা পৃথিবীও সুন্দর হবে।