কিভাবে আমরা সামাজিক ভাবে সুস্থ থাকতে পারি?
জীবনে উন্নতি ও সফলতার জন্য পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সুস্থ থাকাটা খুব জরুরী। আমরা সামাজিকভাবে কি সুস্থ? স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সামাজিকতা বা সামাজিক সম্পর্ক কী ভূমিকা পালন করে? কিভাবে সামাজিক ভাবে সুস্থ থাকতে পারি?
শেষ পর্যন্ত বাসার ইন্টারনেট সংযোগটা কেটেই দিলেন মিসেস করিম (কাল্পনিক চরিত্র)। পেশায় মিসেস করিম ব্যাংকার। তার স্বামীও কর্মরত আছেন একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে। কিন্তু মূল ঝামেলা তাদের এক মাত্র ছেলে অরিত্রকে নিয়ে। বয়স সবে তের তে পরল। সারাদিন কম্পিউটারে কি পায় ছেলেটা তাদের মাথায় ধরে না। কখন বাসায় কে আসলো গেল তা নিয়েও যেন কোন মাথা ব্যাথা নাই অরিত্রের। কিছু দিন আগেও অফিস থেকে বাসায় ফিরলে মায়ের পিছ ছাড়ত না এই ছেলে। তার কথা বলার মানুষটাই বা কই। স্কুল থেকে ফিরে ছেলে সারাদিন ফ্লাটে একা থাকে। আর করবেই বা কি। ঢাকা শহরের খেলার মাঠগুলাও যেন বেমালুম উবে গেছে। আর বাইরে বের হলে ছেলে কার না কার সাথে মিশে তার নাই কোন ঠিক ঠিকানা। বাবা তো ফিরতে ফিরতে সেই রাত এগারটা। এই সব সাতপাঁচ চিন্তা ভাবনা করেই ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দেয়া। আর ওতেই যত বিপত্তির শুরু। প্রথম দিকে ছেলেকে বাক্সবন্দী করে বেশ খুশিই ছিল মিসেস করিম। কিন্তু দিনকে দিন তা পরিবর্তিত হয়ে দুশ্চিন্তায়। প্রথম দিকে অল্প বিস্তর অনালাইন গেম খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন যেন অরিত্রের জীবনটাই কম্পিউটারের মনিটরের মধ্যে। গোঁদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে এ নিয়ে করিম সাহেব ও তার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া ।
সামাজিক ভাবে আমরা কি সুস্থ?
উপরে উল্লিখিত করিম সাহেব ও তার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়ার জন্য দায় কার? সমাজ, পরিবার নাকি অরিত্রের নিজের! আমরা কি আমাদের বাচ্চাদের একটি সুন্দর শৈশব দিতে পারছি! মিসেস করিম তার বাচ্চাকে যে সময়টুকু দিচ্ছে তা যথেষ্ট! তিনি কি তাঁর বাচ্চার মানসিক বিকাশের জন্য সামাজিক ও পারিবারিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পেরেছেন! ছেলের একাকীত্ব কি ঘুচাতে পেড়েছেন একটা যন্ত্রদানব দিয়ে! কিংবা ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিলেই কি সব কিছুর সমাধান করে ফেলতে পারবেন মিসেস করিম! তিনি কি এর মাধ্যমে ছেলেকে তথ্য প্রযুক্তি থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন না বা অনুপযোগী করে তুলছেন না আধুনিক বিশ্বের তুলনায়!
কম্পিউটার বা মোবাইলের রঙ্গিন ছবি বা গ্রাফিক্স ক্লান্ত মস্তিস্কে যে উদ্দিপনা সৃষ্টি করে বা মেলাটানিন ও ডোপামিন হরমোনের ক্ষরণের ফলে যে অনুভুতি দিচ্ছে তা কি একটি কগুজে বই দিতে পারছে! বা উলটো যদি বলি অনলাইন চ্যাট কি তা দিচ্ছে যা বন্ধুদের লাগামহীন আড্ডায় এক কাপ চা দিতে পারত! সারা দিনের পরিশ্রমের পর যখন পরিবারকে সময় দেয়ার কথা বা নিজেকে বিশ্রাম দেয়ার কথা সে সময় কেড়ে নিচ্ছে কম্পিউটার বা মোবাইলের নীল আলো। পারিবারিক বন্ধনগুলাও কি চাপা পড়ে যাচ্ছে না এই নীল আলোর ধুপছায়ায়!
সব কিছুর মাঝেও যেন কিছুই নেই। একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা যেন জেঁকে ধরেছে সবাইকে! সবার সাথে প্রচুর সময় ব্যয় করেও কাটছে না একাকীত্ব। কিন্তু একাকীত্ব ঘোচানর জন্য কি কাছের কাউকে নিয়ে আপনি ছুটির দিনে দুই ঘণ্টার একটি সিনেমা দেখতে বের হচ্ছেন বা দু-তিন দিনের সময় নিয়ে প্রিয়জনকে নিয়ে পাহাড় বা সমুদ্র দেখতে! নাকি তা শুধুই ফেসবুক বা টুইটারে একটা সুখি সুখি ইমেজ শেয়ারের জন্য! নিজেকে অন্যদের চেয়ে সুখি প্রমান করতে? অফিসের একটি প্রোজেক্ট রান করার জন্য আপনার যে প্রচেষ্টা তাঁর সিকিভাগও কি আপনি আপনার পরিবারে ছোট্ট শিশুটির মানসিক বিকাশে খরচ করছেন!
কিভাবে সামাজিক ভাবে সুস্থ থাকতে পারি?
যদি উপরের সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই আপনার জন্য নেতিবাচক হয়ে থাকে তাহলে বলব পরিবর্তনের সময় এখনই । আর তা আপনার নিজের হাতেই। শুরুটা করতে পারেন একদম সাদামাটাভাবেই। কথা বলুন। পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া তৈরি করুন। সকালে হাঁটতে বের হলে পাশের ফ্লাটের লোকটার দেখা হলে তাকে এড়িয়ে যাবেন না। প্রয়োজনে আপনার প্রিয় টিভি শো বা আপনার অতীতের কোন সুখের স্মৃতি নিয়েই শুরু করুন। দেখবেন হয়ত কাল রাতের খাবারের মেনুতে লবন কম ছিল কি না তা দিয়ে শেষ হচ্ছে আলোচনা। আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সপ্তাহে বা মাসে অন্তত একবার দেখা করুন। বন্ধুদের সাথে সন্ধায় বা রাতে এক কাপ চায়ের সাথে কিছু সময় পার করুন। নিজের সন্তানদের পড়ালেখার খোঁজটা কাল থেকে নিজেই রাখুন। বাসায় ফেরার পর মাকে জিজ্ঞেস করুন আজকের খাবারের মেনু কি। বাবার স্বাস্থ্যর খবর নিন। খাবার টেবিলে আজকের দিন বা খাবারের স্বাদ নিয়ে কথা বলুন। সন্তানের স্কুল কলেজ, বন্ধুবান্ধবের ব্যপারে খোঁজ নিন। রাতে ঘুমনোর আগে স্ত্রীর সাথে দিনের কিছু মুহূর্ত শেয়ার করুন। সাংসারিক পরিকল্পনাগুলো সবাইকে জানিয়ে মতামত নিন। এক সাথে কিছু সময় টিভি দেখুন। আবারো বলছি কথা বলুন, নিজের সমস্যা পরিবারকে জানান। পরিবারের সমস্যা আপনি জানুন। তবেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনার পরিবারের স্বাস্থ্য কেমন।
সন্তানদের নিয়ে মাঠে যান। প্রয়োজনে এক দু দিন না হয় তাদের সাথে আপনিও ক্রিকেটের ব্যাটটা হাতে নিয়ে নিন বা ফুটবলে একটি কিক দিন। মনে রাখবেন আপনার সন্তানের কাছে আপনিই সচিন, আপনিই ম্যারাডোনা। সন্তানের বন্ধুদের দাওয়াত দিন। তাদের বাবা মাকেও নিয়ে বসুন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলুন। সুসম্পর্ক তৈরি করুন। আপনার সন্তানকে একটি সুন্দর পরিবেশ দিন। পরীক্ষার ছুটিতে তাদের নিয়ে সাধ্যের মধ্যে ঘুরে আসুন কোথাও হতে।
তবে সব চেয়ে যা জরুরি নিজের দিকে খেয়াল রাখুন। নিজের ইচ্ছার মুল্য দিন। কাজের চাপে ও পারিবারিক দায়িত্বের বেড়াজালে যেন নিজের ইচ্ছাগুলো হারিয়ে না যায়। একজন ব্যক্তির সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাপকাঠি সে কীভাবে অন্যান্য ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, অন্যান্য লোকেরা তার প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংযোজনগুলির সাথে তিনি কীভাবে মিথস্ক্রিয়া করেন। ধীরে ধীরে সময়ের পরিক্রমায় বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের চারপাশের স্কুল, কলেজ,অফিস বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আমাদের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই আমরা গড়ে তুলি একটি সুন্দর সামাজিক সম্পর্ক।
সামাজিকতার সাথে সুস্থতার সম্পর্ক
এই সব সাত পাঁচ ছেড়ে একটু তথ্য উপাত্তের দিকে তাকালে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা মোতাবেক আর্থ- সামাজিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবা এগুলি সবই প্রভাব ফেলে আপনার সামাজিক স্বাস্থ্যে। কারণ সামাজিক নীতি, আচার ও অনুষ্ঠানাদি নির্ধারিত হয় এর মাধ্যমেই। আর তা প্রভাব ফেলে মানুষের গড় আয়ুতে। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায় জাপানে গড় আয়ু ৮০ এর উপর, ব্রাজিলে ৭২, ভারতে ৬৩। আবার আফ্রিকান দেশগুলোর অনেকেরই গড় আয়ু ৫০ এরও নিচে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে চিত্রটা আরও চমকপ্রদ। গবেষণায় দেখা গেছে যাদের সামাজিক সম্পৃক্ততা যত বেশি তাদের প্রত্যাশিত জীবনকাল তত বেশি (উৎসঃ House, Landis and Umberson,1988)। অন্যদিকে “Berkman and Syme(1979)” গবেষণার মতে সংখ্যাটি প্রায় দ্বিগুণ। আর্থ- সামাজিক অবস্থান, স্বাস্থ্য বা মৃত্যুর উপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন অন্যান্য নিয়ামকগুলোও বিবেচনায় নিয়েছিলেন তিনি এই গবেষণায়। এছাড়া “Brumemett and Colleagues (2001)” এর মতে যাদের হৃদরোগের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি ২.৪ গুন বা তারও বেশি। তাছাড়া দেখা যায় হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, এমনকি ক্যান্সারের মত রোগের নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে পারস্পরিক সম্পর্কগুলো।
কীভাবে সামাজিক প্রক্রিয়াগুলি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলিকে প্রভাবিত করে যা সামাজিক বন্ধন এবং স্বাস্থ্যের মধ্যে যোগসূত্রটি ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে তা বোঝার জন্য মনোবিজ্ঞানী, রোগতত্ত্ববিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীদের অবদান ছিল বিস্তর। উদাহরণস্বরূপ, অন্যের সাথে সহায়ক আলাপচারিতা হরমোন (এন্ডোক্রাইন) এবং হার্টের (কার্ডিওভাসকুলার) স্বাভাবিক ক্রিয়াকে উপকৃত করে এবং অ্যালোস্ট্যাটিক লোড হ্রাস করে, যা মানসিক চাপের সময় নিযুক্ত হরমোন নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদী কাজ করে (উৎসঃ McEwen 1998; Seeman et al. 2002; Uchino 2004)। শৈশবে সহযোগিতামূলক পরিবেশ নিয়মিত স্বাস্থ্যকর বিকাশে সাহায্য করে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বিপাকীয় এবং স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হরমোন নিয়ন্ত্রণ সহ প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদী সুস্থতা নিয়ন্ত্রণ করে (উৎসঃ Taylor, Repetti & Seeman 1997) । যৌবনে সামাজিক সমর্থন মানসিক চাপের সময় কার্ডিওভাসকুলার প্রতিক্রিয়া হ্রাস করে (উৎসঃ Glynn,Christenfeld & Gerin1999) । অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায় বিবাহিত প্রাপ্তবয়স্করা বিবাহের দ্বারা প্রাপ্ত মনোসামাজিক সহায়তার কারণে অবিবাহিতদের তুলনায় হৃদরোগের ঝুঁকি কম বলে মনে করেন (উৎসঃ Zhang & Hayward 2006)।ন
সম্পর্ক ও শৃঙ্খলা নিয়ে মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সামাজিক নিয়ামকগুলোর একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এর মধ্যে অন্যতম সামাজিক সমর্থন, ব্যাক্তিগত নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক মর্যাদা, অর্থ-বিত্ত এবং মানসিক স্বাস্থ্য। সামাজিক সমর্থনের মাধ্যামেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনার প্রতি অন্যদের ভালবাসা, যত্ন, প্রত্যাশা বা আবেগ। আর এর উপরই আপনার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা অনেকাংশেই নির্ভর করে। আর তা মানসিক উন্নতির মাধ্যমে ক্লান্তি হ্রাস করে বা অনেক ক্ষেত্রে আপনার জীবনের অর্থ আর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয় যা আপনার কর্মের মধ্যে প্রভাব ফেলে এবং আপনার ব্যাক্তিগত নিয়ন্ত্রণকে বাড়িয়ে তুলতে পারে যার প্রভাব পরোক্ষভাবে পড়ছে স্বাস্থ্যের উপর।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের শারীরিক সুস্থতার সাথে সামাজিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সামাজিকতা ঠিকমত পালন না করতে পারলে তা কোন না কোনভাবে শরীরের উপর প্রভাব ফেলে। নিজেকে সুস্থ রাখতে তাই আমাদের সবার উচিত সামাজিক হওয়া; পরিবারের সাথে, আত্নীয়ের সাথে, প্রতিবেশীর সাথে আমাদের সুসম্পর্ক রাখতে হবে।