শরীর কমানোর উপায় কোনটি? ডায়েট নাকি ব্যায়াম করবেন!
যখনই ওজন কমাতে চাই, তখনি ডায়েট শুরু করি। কেও কেও আবার দৌড়ে জিমে চলে যাই! যখন ওজন কমানোর কথা আসে তখন কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ব্যায়াম বা শরীরচর্চা নাকি ডায়েট? সঠিকভাবে ডায়েট করবেন কিভাবে? শরীরচর্চা কি আপনাকে অনেক ওজন হ্রাস করতে সাহায্য করবে?
অনেকেই দুঃখ করে বলেন 'কিছু না খাওয়া সত্ত্বেও মোটা হয়েই চলেছি' অথবা 'আমি বোধহয় বাতাস খেলেও মোটা হই'। স্থূলকায় শরীর আমাদের কারোই কাম্য নয়। তাই ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয়াম করে অথবা খাদ্যতালিকা থেকে প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় সব খাবার ছেটে ফেলে আমরা ওজনকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে চাই।
শরীর চর্চা বা ডায়েটিং দুটোর যেকোন একটির দিকে বেশি যত্নবান হয়েও ওজন মাপার যন্ত্রটি যখন কিছুতেই আমাদের খুশি করতে পারেনা, শরীরকে সুস্থ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তখন একটি প্রশ্ন আমাদের মনে প্রায়শই ঘুরে ফিরে আসে, শরীরচর্চা না ডায়েট, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? আসুন দেখা যাক এই লেখাটি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে কিনা।
ব্যায়াম কি খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব কাটাতে পারে?
অনেক সময় ক্যালরিসমৃদ্ধ কোন খাবার গ্রহণের সময় আমরা নিজেদের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দেই যে পরে জিমন্যাশিয়ামে ব্যায়াম করে আমি এই ক্ষতি পুষিয়ে নেব। কিন্তু আসলে এই ধারণা ভ্রান্তিকর এবং শুধুমাত্র ব্যায়াম করে 'যা ইচ্ছা তাই' খাবার প্রভাব কাটিয়ে ফেলা খুব কঠিন এবং বাস্তবসম্মত নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ২ স্লাইস পিজ্জা খাবার পর এই পরিমাণ ক্যালরি বার্ন আউট করার জন্য এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সাইক্লিং করা প্রয়োজন। একইভাবে এক ঘণ্টা ধরে ভারোত্তোলন করলে যে ক্যালোরি খরচ হয় মাত্র চারটা জনপ্রিয় ক্যাডবেরির ওরিও বিস্কুট খাওয়া তার জন্য যথেষ্ট। এত ভারী ব্যায়াম করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়, এজন্য খাদ্যাভ্যাসের দিকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
৮০/২০ নীতি
'৮০/২০ নীতি' হল সেই নীতিমালা যা বলে আমাদের অনেক কাজের ৮০ ভাগ ফলাফল নির্ভর করে মাত্র ২০ ভাগ কারণ এর উপর।
যেমন অনেক ব্যবসায় ৮০ ভাগ লাভ আসে ২০ ভাগ কাস্টমারের পকেট থেকে, অনেক দেশেরই ৮০ ভাগেরও বেশি সম্পদ সেই দেশের ২০ ভাগেরও কম নাগরিকের অধীনে থাকে। একজন মানুষ যখন ওজন কমানোর চেষ্টা করে তখনো এই নীতিমালা কাজ করে। এই প্রচেষ্টার ৮০ পারসেন্ট ফলাফল নির্ভর করে তার ২০ পারসেন্ট অভ্যাস এর ওপর। এবং মানুষের ক্ষেত্রে এই '২০ পার্সেন্ট' সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে সে কি খাবার খাচ্ছে তার ওপর।
সঠিক খাদ্য নির্বাচনের গুরুত্ব কেন ব্যায়ামের চেয়ে বেশি?
সাধারণভাবে বলা যায়, ওজন কমাতে হলে খাওয়ার ভূমিকা ৭৫% আর ব্যায়াম এর ভূমিকা ২৫%। সাতশোরও বেশি ওজন কমা সংক্রান্ত গবেষণা বিবেচনা করা একটি বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে দ্রুত ওজন কমানোর ব্যাপারে বিবেচনার সাথে খাদ্যাভ্যাস নির্ধারণ করা সবচেয়ে বেশি সুফল দেয়। গড়ে দেখা যায়, যারা ব্যায়াম না করে শুধু খাবার ঠিক রেখেছিল তারা ১৫ সপ্তাহে প্রায় ২৩ পাউন্ড ওজন কমিয়েছে, অন্যদিকে যারা শুধু ব্যায়াম করেছে তারা ২১ সপ্তাহে মাত্র ১৫ পাউন্ড ওজন কমিয়েছে। এটা সব সময় মনে রাখতে হবে যে অতিরিক্ত খেয়ে তা ব্যায়াম করে ঝরিয়ে ফেলার চেয়ে খাদ্যাভ্যাসে সংযমের পরিচয় দেয়া সহজতর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কেউ যদি ৫০০ ক্যালোরির সমতুল্য একটি ফাস্টফুড আইটেম খেয়ে থাকে, তাহলে এর প্রভাব কাটানোর জন্য তার প্রায় চার মাইল দৌড়ানো প্রয়োজন! অর্থাৎ এক ঘণ্টা দৌড়ে শরীর ঘামে ভিজিয়ে দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব না হলে প্রথমেই ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবারটির লোভ সংবরণ করা শ্রেয়।
আদর্শ ডায়েট কেমন হওয়া উচিত?
এক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো কার্বোহাইড্রেট বর্জিত ডায়েট কারণ এতে সবচেয়ে দ্রুত রেজাল্ট পাওয়া যায়। কিন্তু এরকম ডায়েট দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া অনেকের পক্ষেই কঠিন হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে ডায়েটের বিভিন্ন উপাদান নির্ধারনে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি যেখানে আমরা গুরুত্ব দিতে পারি সবজি-ফল, চর্বিমুক্ত মাছ-মাংস (লিন প্রোটিন) এবং হোল গ্রেইন শর্করার প্রতি। এবং একই সাথে ক্যালরির পরিমাণ কখনো খুব বেশি কমিয়ে দেওয়া উচিত নয়, কারণ এর ফলে আমাদের দেহের মেটাবলিজম প্রভাবিত হতে পারে যাতে পেশী ভর বা 'মাসল ম্যাস' কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে একটি সাধারণ নিয়ম হতে পারে প্রতি পাউন্ড দৈহিক ওজনের জন্য ১০ ক্যালরি গণনা করা। অর্থাৎ কারো ওজন ১৬০ পাউন্ড হলে সে যদি ১৬০০ ক্যালোরির ডায়েট টার্গেট হিসেবে নেয়, তাহলে এর সাথে সাথে সাধারণ ব্যায়াম করেই সে ওজন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবে।
আদর্শ ডায়েট নির্বাচনে কোন জিনিসগুলোর গুরুত্ব বেশি?
বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন আমাদের খাদ্য তালিকায় যে অস্বাস্থ্যকর উপাদানগুলো আছে (ভাজা খাবার, প্রসেসড ফুড, অতিরিক্ত চিনি বা লবণযুক্ত খাদ্য) সেগুলোকে যথাসম্ভব বদলে ফেলার ওপর। অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে তা খুব সহজেই শরীরচর্চার ভালো প্রভাবগুলো মুছে দেয়। অনেকে মনে করেন দিনে দুই হাজার ক্যালোরি খেয়ে তারা এমন ভাবে ব্যায়াম করবেন যেন আড়াই হাজার ক্যালোরি খরচ হয়। কিন্তু ব্যায়ামের মাধ্যমে ক্যালরি খরচ করা খুব পরিশ্রমসাধ্য এবং অনেক ক্ষেত্রে দিনে দুবার জিমে গিয়েও তা সম্ভব নয়।
শরীরচর্চার গুরুত্ব কতখানি?
একথা ঠিক যে শুধু ডায়েট করেও ওজন কমানো সম্ভব, কিন্তু একই সাথে পরিমিত শরীরচর্চার গুরুত্ব কখনো ভুললে হবে না। এক্ষেত্রে শরীরচর্চার উদ্দেশ্য হবে ক্যালরি খরচ করা নয় বরং হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের সাথে সাথে শরীরের সকল পেশীকে সবল রাখা। শুধু ডায়েট এর ওপর নির্ভর করলে শুধু মানুষের দেহে সঞ্চিত চর্বি কমে না, বরং একইসাথে পেশি এবং হাড়ের ঘনত্বও হ্রাস পায়। উল্টোদিকে একইসাথে শরীরচর্চা করলে বিভিন্ন মেটাবোলিক টিস্যু উজ্জীবিত হয় যার ফলে পেশি বা হাড়ের স্বাস্থ্য ঠিক থাকে এবং ওজন কমা মূলত সঞ্চিত চর্বি থেকে হয়ে থাকে।
কতটুকু ব্যায়াম আমাদের করা দরকার?
মনে রাখতে হবে শরীরচর্চার মাধ্যমে দেহকে ঠিক রাখতে হলে আমাদের প্রতিদিন ম্যারাথন দৌড়াবার প্রয়োজন নেই। এর জন্য প্রতি সপ্তাহে ৫ থেকে ৭ দিন মধ্যম তীব্রতর ব্যায়াম ৫০ মিনিটের জন্য করাই যথেষ্ট। এমনকি দ্রুত হাঁটাও একটা ভালো ব্যায়াম হতে পারে। হাঁটা, দৌড়ানো বা সাইক্লিং এর মত 'কার্ডিওভাসকুলার (হৃদপিণ্ড এবং ফুসফুসের) ব্যায়ামের' সাথে সাথে 'রেজিস্টেন্স ট্রেনিং' এর কথা মনে রাখতে হবে যার মধ্যে পড়ে ওয়েট লিফটিং, স্কোয়াট, লানয, পুশ আপ এবং প্ল্যাংক। এই দ্বিতীয় ক্যাটাগরির ব্যায়ামগুলোকে শরীরচর্চাবিদরা 'স্ট্রেস এক্সারসাইজ' বলে অভিহিত করে থাকেন এবং এদের উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ এবং নিম্নাঙ্গের বিভিন্ন পেশীকে সুস্থ-সবল রাখা। অনেক সময় আমরা ওজন কমানোকে ব্যায়াম এর একমাত্র লক্ষ্য বলে মনে করি কিন্তু নিয়মিত শরীরচর্চা যে কেবল ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে তা নয়, এর ফলে ঘুমের উন্নতি হয়, কোলেস্টেরল এবং স্ট্রেস হরমোনের পরিমাণও কমে আসে।
'ডায়েটিং বেশি গুরুত্বপূর্ণ' এর মানে এই নয় যে আমরা খেতে ভয় পাব
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখতে গিয়ে আমরা যদি আবার ক্যালরির পরিমাণ বেশি কমিয়ে দেই তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কাজেই খাবারকে ভয় না পেয়ে আমরা তার বদলে কিছু শর্ত মাথায় রাখতে পারি। যতটা সম্ভব প্যাকেটজাত বা প্রসেসড খাদ্য বর্জন করা, প্রতিবেলার খাবারের সাথে সবজির পরিমাণ বেশি রাখা। সর্বোপরি কারো পক্ষেই খাদ্য নির্বাচনের বেলায় নিখুঁত হওয়া সম্ভব নয়! কাজেই মাঝেমধ্যে আমরা যদিও প্রিয় কোন ক্যালরিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করে থাকি আমরা চেষ্টা করব এটা যেন কোন নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত না হয়।
তাহলে বলা যায় দীর্ঘ মেয়াদে ওজন কমাতে হলে ডায়েট আর শরীরচর্চা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু খাদ্যাভ্যাস যদি ঠিক না থাকে তাহলে যতই ব্যায়াম করা হোক তা কাজে আসবে না।
বাড়তি ওজন কমানোর প্রমাণিত ৮ টি উপায়!