ঘরে থাকার দিন গুলোতে ভাল থাকুন, উপভোগ করুন
ছুটির দিনগুলিতে কি আমরা শুধু ঘুমিয়ে আর খেয়ে কাটাব? বাড়ি থাকার দিনগুলিতে আমরা কিভাবে সময় কাটাব? কোন কোন কাজ আমরা এই সময় করতে পারি? কী করলে আমাদের মন ও শরীর চনমনে থাকবে?
মুদ্রার একপিঠ যদি চিন্তা করি তাহলে করোনা ভাইরাস বা “SARS-COV-2” আমাদের জীবনকে এক কথায় স্থবির করে দিয়েছে, আর যদি অন্যপিঠ চিন্তা করি তাহলে বলা যায় এই স্থবিরতা আমাদের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার সময় করে দিয়েছে।
অনেকেই হয়ত ঘরবন্দী জীবনে ক্লান্ত হয়ে পরেছেন। এসময়টাকে সুন্দর ভাবে কাটিয়ে নিজেকে ও পরিবারের মানুষ গুলোকে কতটা পুনরুজ্জীবিত করতে পারি আমরা আসুন দেখে নেই।
দিনের শুরুটা যেন সুন্দর হয়
একটানা সাত থেকে আট ঘন্টা ঘুমিয়ে সকালটা শুরু করুন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। বারান্দা, ছাদ অথবা বাড়ির পেছনের উঠোনে হালকা শরীরচর্চা করুন। উদীয়মান সূর্য আর সকালের ঠান্ডা বাতাসে এমনিতেই আপনার দেহ–মন চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আপনি যদি সঙ্গীত প্রেমী হয়ে থাকেন তবে এসময় অল্প শব্দে প্রিয় কোন গান শুনতে পারেন পাশাপাশি। একটু বিশ্রাম নিয়ে প্রাতরাশ করুন। খাদ্য তালিকায় ফলমূল, শস্যদানা, প্রোটিন আর আঁশযুক্ত খাবার রাখার চেষ্টা করুন। পানি পান করুন দিনে দুই থেকে তিন লিটার।
বারান্দা বা ছাদে করতে পারেন শখের বাগান
ছোটবেলায় ফেলে আসা সবুজ শৈশব আমাদের অনেককেই আজও হাতছানি দিয়ে ডাকে। ব্যস্ত জীবনে সেই ডাকে হয়ত সাড়া দিতে পারেননি। তবে এই অখণ্ড অবসরকে কাজে লাগিয়ে বাসার ছোট বারান্দা অথবা ছাদে সৃষ্টি করতে পারেন প্রাকৃতিক আবহ। গাছ লাগানোর পাত্র হিসেবে রিসাইকেল (পুনরায় ব্যবহার) করতে পারেন অব্যবহারিত ভোজ্য তেলের কন্টেইনার অথবা যেকোন প্লাস্টিক কন্টেইনার। ভাবছেন এই সময় গাছের চারা কোথায় পাবেন? প্রতিনিয়ত যে সবজিগুলো বাসায় রান্না করছেন তা থেকেই বীজ তৈরি করে ফেলুন না। মিষ্টি কুমড়া, মরিচ বীজ গুলো শুকিয়ে রাখুন কিংবা সদ্য চারা গজিয়ে যাওয়া আলু, পেয়াজ বা রসুনগুলো আলাদা করে মাটিতে পুঁতে দিন। পুদিনা পাতা, ধনে পাতার শেকড় গুলো মাটিতে পুঁতে দিলেও সুন্দর গাছ গজাবে। এতে শুধু নির্মল আনন্দই পাবেন না প্রয়োজনের সময় কিছুটা খাদ্যের যোগানও পাবেন।
বাগানের যত্নে আপনার বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যটিকেও সাথে নিন। শিশুরা এতে আনন্দে থাকবে।
শখের রান্না করে পরিবারের সকলকে তাক লাগিয়ে দিন
অনেকেই সপ্তাহান্তে পরিবারের সকলকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে ভালবাসেন। বন্দী জীবনের বন্দিত্ব স্বীকার না করে বাড়িতেই তৈরি করে ফেলুন মজাদার কোন রেসিপি। সময়ের অভাবে এতদিন যেটা হয়ে উঠছিল না। পরিবারের সকলের তৃপ্ত মুখ আপনাকে একটু হলেও তৃপ্তি দেবে।
অনলাইনে করে নিতে পারেন প্রয়োজনীয় কোন কোর্স
ভাবছেন সময়টা থমকে আছে, পিছিয়ে পড়ছেন শিক্ষার দিক দিয়ে? মোটেই না। এসময়টা কাজে লাগাতে পারেন পেশা অথবা শিক্ষা ক্ষেত্রে নিজ বিষয় সম্পর্কিত বিভিন্ন অনলাইন কোর্স গুলো করে। দক্ষতা অর্জন করতে পারেন ফটোশপ, মাইক্রোসফট এক্সেল সহ এসপিএসএস (SPSS) এর মত সফটওয়্যার এর কাজ গুলোতে। যা পরবর্তীতে আপনার শিক্ষা অথবা পেশাগত জীবনে অনন্য ভূমিকা রাখবে।
মুভি ম্যারাথন
ছাত্রজীবন অথবা কর্মজীবন কোথাও হয়ত নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ পাননি। অথচ মনীষীদের উপদেশে অনেকবারই হয়ত শুনেছেন বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্র গুলো না দেখলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাহলে আর দেরি কেন, এই অবসরে বসে যান মুভি দেখতে। পরিবারের সকলকে নিয়ে উপভোগ করুন তামাম দুনিয়ার সেরা চলচ্চিত্র গুলো। ঘরের কচিকাঁচাদের নিয়ে দেখুন বিখ্যাত শিশুতোষ চলচ্চিত্র। এতে ওদের সময়টাও ভাল কাটবে শিখতেও পারবে অনেক কিছু।
হারিয়ে যেতে পারেন বইয়ের জগতে
কিছুদিন আগেই শেষ হল অমর একুশে গ্রন্থ মেলা। ভাবছিলেন বইগুলো শুধুই তাকের শোভাবর্ধন করে, পড়ার সময় সুযোগ কখনওই হয়ে উঠেনা। ব্যস! পেয়ে গেলেন তো সময়। অবসরের বিকেল গুলোতে বারান্দায় এক কাপ চা হাতে ডুব দিন না বইয়ের জগতে। দেখবেন নিজের দেহ মন অনেকটাই হালকা লাগছে। আপনার শিশুটির হাতেও ধরিয়ে দিন ঠাকুরমার ঝুলি, গালিভারস ট্রাভেলস অথবা প্রফেসর শঙ্কুর কোন এক পর্ব। দেখবেন সে ও কেমন মশগুল হয়ে থাকে। পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার এমন মোক্ষম সুযোগ আর কোথায় পাবেন?
ঘরের ছোটখাট কাজ গুলো নিজেই করুন
আপনার বারান্দার বাতিটি হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে বেশ কিছু দিন, লাগানো হচ্ছে না সময়ের অভাবে। লাগিয়ে ফেলুন। অথবা বারান্দার টব গুলো বিবর্ণ হয়ে আছে, রঙ তুলি হাতে নিজেই বনে যান শিল্পী, সাথে নিন আপনার ছোট সোনামণিকে। দেখুন সে কতটা উপভোগ করে এই কাজটি। এছাড়াও ধুলোবালি ঝাড়া, বিছানা গোছানোর মত কাজ গুলো করুন প্রতিদিন।
ইনডোর গেমস
একটা সময় ছিল যখন বৃষ্টির দিনে বাইরে যাবার সুযোগ না থাকায় ভাইবোনরা মিলে বাড়িতেই খেলতাম লুডু, ক্যারাম, দাবা, নাম-দেশ-ফুল-ফল, চোরপুলিশ ইত্যাদি। এতে সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক মধুর হত। এখন এই নাগরিক জীবনে সে পরিবেশ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলা যায়। পরিবারের সব সদস্য মিলে ফিরিয়ে আনতে পারেন আবার সেই শৈশবকে। সময়টা যেহেতু নিজেকে ফিরে পাবার, আসুন হেলায় সেটা না হারাই।
সৃষ্টিশীল কাজের চর্চা করুন
ইউটিউব দেখে বাসায় চর্চা করতে পারেন অরিগ্যামি অথবা সূচিকর্মের মত সৃষ্টিশীল কাজের। কাপড়ে সুতোর কাজটি ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঠাই দিতে পারেন আপনার বসার ঘরে। রঙ্গিন কাগজ দিয়ে বানাতে পারেন ফুল, পাখি, লতা।মাটি দিয়ে তৈরি করতে পারেন ছোটখাট কোন খেলনা। আপনার এসব কাজ শুধু সময়টিকেই সুন্দর করবে না আপনার শিশুটির মনে ফেলবে সৃজনশীলতার ছাপ।
গানকে সঙ্গী করুন
সঙ্গীত মন কে প্রফুল্ল করে।তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুনুন পছন্দের কোন গান। নিজের কণ্ঠেও গুনগুন করতে পারেন প্রিয় কোন সুর। এই কাজটি শুধু আপনাকে নয় আপনার আশেপাশে থাকা মানুষের মনেও ছড়িয়ে দেবে সজীবতা।
ভার্চুয়াল ট্যুর
আপনি খুব ভ্রমণ প্রিয় কিন্তু বের হতে পারছেন না বাড়ির বাইরে? পৃথিবীর তাবৎ দর্শনীয় স্থান গুলো দেখে নিন না ভার্চুয়াল ট্যুরের মাধ্যমে। এতে দুধের স্বাদ না পেলেও ঘোলের স্বাদ তো পাবেনই সাথে বোনাস হিসেবে করে নিতে পারবেন পরবর্তীতে ভ্রমণের তালিকাটিও।
ভাবনা গুলো হোক ইতিবাচক
বিশ্বের নেতিবাচক খবর গুলো আপনার মনকে ক্রমশই বিষণ্ণ করে তুলছে? কিছুদিন দূরে থাকুন মিডিয়া গুলো থেকে। ছুটি নিন ফেসবুক এর মত সামাজিক মাধ্যম গুলো থেকেও। ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা লালনের অনুশীলন করুন। পরিবারের সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন। কারও কোন কাজ যদি আপনার মন খারাপের কারণ হয়ে থাকে তাকে চিৎকার চেঁচামেচি না করে তাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করুন। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে নিজের মন কে মুক্ত করে দিন, বিষয়টি নিয়ে ভাবা থেকে বিরত থাকুন। ভুলের ক্ষমা করুন। মন শান্ত থাকলে দেহের সুস্থতা আসবে। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষকে সাহায্য করুন। মানসিক তৃপ্তি পাবেন।
সম্পর্ক গুলোকে সজীব করে তুলুন
সময়ের অভাবে হয়ত স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুটির সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেননি অনেকদিন। এই অবসরে ঝালিয়ে নিন পুরনো সম্পর্কটি। মুঠোফোন কিংবা মেসেঞ্জারে প্রাণ খুলে আড্ডা দিন প্রিয় বন্ধুদের সাথে। ভাবের আদান প্রদান মনকে শান্ত করে। আপনি একা নন এই অনূভুতি আপনার কষ্টকে লাঘব করে। কুশল বিনিময় করুন স্বজনদের সঙ্গে। দুঃসময়ে আপনার কোন আশা জাগানিয়া কথা হয়ত তাদের মন ভাল করে দিতে পারে। আর অন্যকে ভাল রাখার সে তৃপ্তি ছুঁয়ে যাবে আপনাকেও।
দিনলিপিতে লিপিবদ্ধ করুন দৈনন্দিন ভাবনাগুলো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডের ছোট্ট মেয়ে এনি ফ্রাঙ্কের দিনলিপিটির কথা আমরা সবাই জানি। নাৎসি বাহীনির আগ্রাসনের দিনগুলো সে লিপিবদ্ধ করেছিল তার দিনলিপিতে, পরবর্তীতে যেটা “Anne Frank: The Diary of a young girl” নামে পুরো বিশ্বের নজর কাড়ে। তাই রাতে ঘুমাতে যাবার আগে কিংবা যেকোন অবসরে আপনিও আপনার দিনের ভাবনাগুলো লিখে রাখতে পারেন দিনলিপির পাতায়। এতে মন যেমন ভারমুক্ত হবে, গুছিয়ে লেখার অভ্যাসও গড়ে উঠবে। আপনার সন্তানকেও এই অভ্যাসের সাথে পরিচিত করে তুলতে পারেন।
মেডিটেশন বা ধ্যান মন শান্ত করার উপায়
ধ্যান মন কে স্থির করা, মনোযোগকে একীভূত করে আত্মনিমগ্ন থাকার প্রক্রিয়া। একে মনের ব্যয়াম বললেও ভুল হবে না। ধ্যান মনকে স্বেচ্ছা নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ইতিবাচক চিন্তার জাগরণ ঘটায় ও আত্মউপলব্ধির দ্বার উন্মোচন করে। এর মাধ্যমে মনের দুশিন্তা, বিষণ্ণতা কে ঝেটিয়ে বিদায় করতে পারেন। মনকে পরিপূর্ণ করতে পারেন অনাবিল আনন্দ আর ইতিবাচক চিন্তায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে ধ্যান শুধু আপনার মনকেই প্রফুল্ল করেনা শরীরের উপরও আছে এর ইতিবাচক প্রভাব। মানসিক, স্নায়বিক আর হৃদরোগ এর রোগীদের জন্য ধ্যান শারীরিক সুস্থতাও বয়ে আনে।
সর্বোপরি আপনার চারপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন, নিজে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন, স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করুন আর বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে ভুলবেন না যেন। পরিচ্ছন্নতা আপনার দেহ ও মনের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।