বুক জ্বালাপোড়া রোধে ১০টি খাদ্য থেকে সাবধান!

বুক জ্বালা-পোড়া, অম্বল, অ্যাসিডিটি অথবা হার্টবার্ন যে নামেই ডাকা হোক, এটি সারা বিশ্বে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের আতংকের নাম! অতি সাধারণ হলেও মানুষকে ভালোই ভুগিয়ে থাকে এই রোগটি। আমরা যদি আমাদের খাদ্যাভাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তবেই আমরা বুক জ্বালা-পোড়া বা হার্টবার্ন থেকে মুক্তি পেতে পারি।

হার্টবার্ন বা অ্যাসিডিটি কী?

আপনার কি কখনো বুকে হঠাত জ্বালা পোড়ার কারণে রাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে? সেই ব্যাথা কি এতটাই তীব্র ছিল যে আপনি ভেবেছিলেন আপনার হয়ত হার্ট অ্যাটাক অথবা স্ট্রোক হচ্ছে? আসলে সেটি হল হার্টবার্ন বা অম্বল। খাদ্যনালীর (ইসোফেগাস) শেষ এবং পাকস্থলীর শুরুর মধ্যবর্তী একটি পেশী (নিম্ন খাদ্যনালী স্পিঙ্কটার পেশী বা এলইএস) সাধারণত পেটে অ্যাসিড ধরে রাখে, অর্থাৎ পাকস্থলী থেকে অ্যাসিডকে খাদ্যনালীতে আসতে দেয় না। তবে ঘন ঘন অম্বলযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই অঞ্চলটি পেটের অ্যাসিডকে খাদ্যনালীতে ছড়িয়ে পড়া থেকে আটকাতে পারে না। এই কারণেই সাধারণত হার্টবার্ন বা অম্বল অনুভূত হয়ে থাকে।

অ্যাসিড রিফ্লাক্স কী?

হার্টবার্ন বা অম্বলের প্রধান কারণ অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স। অ্যাসিড রিফ্লাক্স মূলত ঘটে যখন আপনার পেট থেকে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী আপনার খাদ্যনালীতে চলে আসে। গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স আপনার বুকে অস্বস্তিকর জ্বলন্ত অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। এই অনুভূতিই প্রায়শ বুক জ্বালা-পোড়া বা হার্টবার্ন হিসাবে পরিচিত। আপনি যদি অ্যাসিড রিফ্লাক্স এর ভুক্তভোগী হোন তবে সাধারণত আপনার মুখের পিছনে টক বা তেতো স্বাদ অনুভূত হতে পারে।

তবে কি আপনি ভাবছেন এই সমস্যার কোন অন্ত নেই? বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে তা সম্ভব। এইরকম কিছু খাদ্য আছে যা আপনার হার্টবার্ন এর মূল কারণ। যদিও এই ব্যাপারে চিকিৎসকদের মধ্যে মতভেদ তাক্তে পারে তবে কিছু খাদ্যগ্রহণের ফলে অনেক মানুষেরই এই হার্টবার্ন এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা দেখা দেয়। এইরকম ১০টা খাদ্য হল-

১) উচ্চ চর্বিযুক্ত এবং ভাজা খাবার

দুর্ভাগ্যক্রমে, অ্যাভোকাডো, বিভিন্ন ধরণের পনির এবং বাদামের মতো অনেক স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর কিন্তু উচ্চ-চর্বিযুক্ত খাবারগুলি হার্টবার্ন এর কারণ বলে বিভিন্ন গবেষণায় খোঁজ পাওয়া গিয়েছে।

উচ্চ চর্বিযুক্ত এবং ভাজা খাবারগুলি দুটি উপায়ে অ্যাসিডিটির কারণ হতে পারে। 

প্রথমত, সেগুলি খাদ্যনালীর স্পিঙ্কটার পেশীকে শিথিল করে দেয়। যার ফলে, পাকস্থলির অ্যাসিড পাকস্থলি থেকে খাদ্যনালীতে চলে যেতে পারে এবং এর ফলে আমাদের বুক জ্বালা-পোড়া দেখে দেয়।

দ্বিতীয়ত, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবারগুলি কোলিসিসটোকাইনিন (সিসিকে) নামক হরমোন নিঃসরণে উদ্দীপনা জাগায়। এই হরমোনটি খাদ্যনালীর স্পিঙ্কটার পেশীকে শিথিল করে এবং খাবারকে আরও বেশিক্ষণ ধরে পেটে ধরে রাখে, যার ফলে আমাদের হার্টবার্ন হয়। 

তাই আমাদের খাদ্যাভাস থেকে যে খাবারগুলি পরিহার করা উচিত-

  • ভাজা পোড়া জাতীয় খাবার

  • ফাস্ট ফুড, যেমন বার্গার, স্যান্ডউইচ

  • ভারী বা ক্রিমযুক্ত সস, যেমন মেয়োনিজ

  • ভাজা মুরগী এবং সসেজ

  • আলুর চিপস

  • ডোনাটস

  • প্যাস্ট্রি

২) ভারী দুগ্ধ বা দুগ্ধজাতীয় খাদ্য

ভারী দুগ্ধ বা দুগ্ধজাতীয় খাদ্য যেমন ক্রিম, মিল্ক শেক, আইসক্রিম এবং কয়েক ধরণের পনির যেগুলিতে অধিক পরিমাণ ফ্যাট থাকে, তার সবই হার্টবার্নের জন্য দায়ী।

সাধারণত অ্যাসিডিটি নিরাময়ের জন্য দুধ সেবন করে থাকেন অনেকেই। তবে, হোল মিল্ক বা পূর্ণ ফ্যাটযুক্ত দুধ পান করার ফলে অনেকের হার্টবার্ন হতে পারে। তাই যাদের এই সমস্যা দেখে দেয় তাদের এটি এড়ানোই ভালো।

৩) অ্যাসিডিক খাবার (টমেটো ও সাইট্রাস জাতীয় ফলমূল)

আমেরিকান কলেজ অব গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির মতে, টমেটো এবং সাইট্রাস জাতীয় ফল অ্যাসিডযুক্ত খাবারগুলি খাদ্যনালীর আস্তরণকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

তাই, অ্যাসিডিটিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা লেবু, কমলা জাতীয় ফল এবং আঙ্গুর এড়িয়ে অন্যান্য ফল, যেমন বেরি এবং মেলন জাতীয় ফল (যেমন, বাঙ্গি, তরমুজ, স্ট্রবেরি) বেছে নিতে পারেন। এছাড়াও আমাদের কমলার রস এবং অন্যান্য সাইট্রাস জুস খাওয়া সীমাবদ্ধ করা উচিত।

আর টমেটো সসের পরিবর্তে আমরা জলপাই তেল এবং টাটকা গুল্ম (যেমন, ধনেপাতা) দিয়ে খাবার পরিবেশন করতে পারি। বিকল্পভাবে, টমেটো সসের মধ্যে সামান্য বেকিং সোডা দিয়ে  অ্যাসিডের প্রভাবকে কিছুটা প্রশমিত করতে পারি।

৪) ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার

অ্যাসিডিটি অথবা হার্টবার্নের অন্যতম একটি প্রধান কারণ হচ্ছে ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার। একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে লাল মরিচের মধ্যে উচ্চ পরিমাণে ক্যাপসাইসিন থাকে, যা হজমকে ধীর করে দেয় এবং এইভাবে অ্যাসিড রিফ্লাক্স বাড়িয়ে তুলতে পারে।

সাধারণত বাইরের রেস্তোঁরাগুলিতে মশলাদার খাবারগুলিতে পেঁয়াজ এবং চর্বির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, যা থেকে আমাদের বুক জ্বালা পোড়া হয়।

তাই বাড়িতেই এইসব খাবারগুলি প্রস্তুত করা শ্রেয় এবং এর পরিবর্তে হালকা মশলা বা টাটকা গুল্ম ব্যবহার করা ভাল।

৫) সোডা বা কার্বোনেটেড পানীয়

যদিও মনে করা হয় সোডা বা কার্বোনেটেডজাতীয় পানীয় আমাদের হার্টবার্নের অনুভূতি থেকে রেহাই দেয়, আসলে তারাও দোষী।

সোডার মধ্যে এমন গ্যাস রয়েছে যা জোর করে খাদ্যনালীর স্পিঙ্কটার পেশীকে শিথিল করে দেয় এবং ব্যক্তিটির ঢেঁকুর শুরু হয়ে যায়। এছাড়া সোডাতে থাকা চিনি পাকস্থলীতে সক্রিয় হতে থাকে এবং আরও বেশি গ্যাস উৎপাদন শুরু করে।

তাই হার্টবার্ন থেকে বাঁচতে আমাদের কার্বনেটেড এবং মিষ্টিজাতীয় পানীয় এড়াতে হবে।

৬) মাংস

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং প্রাণীজ প্রোটিনগুলি হজমের অ্যাসিড ও হরমোনগুলিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারেে, যার ফলে অ্যাসিডিটি হয়।

চর্বিযুক্ত মাংস বা মাংস ভাজা খাওয়ার সময় (বিশেষ করে গরু ও খাসীর মাংস) হার্টবার্নের সমস্যা দেখা যায়। তবে এর পরিবর্তে টার্কি এবং মুরগির মত চর্বিহীন মাংস আপনারা খেতে পারেন।

৭) অ্যালকোহল

অ্যালকোহল খাদ্যনালীর স্পিঙ্কটার পেশীকে শিথিল করতে পারে, যা পাকস্থলীর অ্যাসিডকে খাদ্যনালীতে চলে যেতে সুযোগ করে দেয় এবং যার দরুন অস্থির জ্বালা পোড়া অনুভূতি হয়। তাই অ্যালকোহল পরিহার করা অত্যাবশ্যক। 

৮) চকোলেট ও মিন্ট

চকোলেট অম্বলের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাবারের মত চকোলেটও খাদ্যনালীর স্পিঙ্কটার পেশীকে শিথিল করতে পারে। এতে পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালীতে প্রবেশ করে এবং অম্বল সৃষ্ট হয়।

পেপারমিন্ট এবং স্পেয়ারমিন্টের মতো মিন্টগুলিও প্রায়শই খাদ্যনালীতে ছড়িয়ে পড়া টানটান অনুভূতি হ্রাস করতে পারে বলে মনে করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা পেটের অ্যাসিডগুলির চলাচল করা আরো সহজ করে তোলে।  তাই পেপারমিন্ট ব্যবহারে আমাদের সতর্ক থাকা উচিৎ।

৯) ক্যাফেইন

আমাদের বর্তমান জীবনের সাথে ক্যাফেইনের সখ্যতা দৈনন্দিনের। তবে এটি  বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা হার্টবার্নের কারণ হিসাবে কাজ করে। প্রতিদিনের ক্যাফেইনর পরিমাণ কমালেই হার্টবার্নের জ্বালা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে চিকিৎসকেরা বলে থাকেন।

১০) অতি পরিমাণে লবণ জাতীয় খাদ্য

টেবিল লবণ বা লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ অ্যাসিড রিফ্লাক্স বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা অম্বল হওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কারণের একটি। যারা বেশি ভাজাপোড়া এবং চর্বিযুক্ত খাবার খান তারাই খাবারে অতিমাত্রায় লবণ খেতে চান। যার দরুণ তাদের জন্য হার্টবার্ন একটি সাধারণ ব্যাপার।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে লোকেরা তাদের খাবারে অতিরিক্ত লবণ যুক্ত করেছেন তাদের অ্যাসিড রিফ্লাক্স হওয়ার সম্ভাবনা ৭০% বেশি তাদের থেকে যারা কখনও খাবারে আলাদা লবণ যুক্ত করেন নি।

 

পরিশেষে, হার্টবার্ন এখন আমাদের কমবেশি সকলেরই পীড়ার কারণ।  তবে খাদ্যাভ্যাস এবং লাইফস্টাইলের সাধারণ পরিবর্তন হার্টবার্ন থেকে মুক্তি দিতে পারে। যে খাবারগুলি খেলে আমাদের অ্যাসিডিটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সে খাবারগুলি গ্রহণে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর অবস্থা জটিল হতে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

Default user image

নুসফাক মাহমুদ, লেখক, আস্থা লাইফ

বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে অধ্যায়নরত। ভালোবাসেন সিরিজ দেখতে, বই পড়তে, লেখালেখি করতে আর সময় পেলেই সমুদ্র-পাহাড় কিংবা এদিক সেদিক বেড়াতে। বয়সের সাথে আবিষ্কার করছেন এক নতুন অজানা বিশ্ব- স্বপ্ন দেখেন নিজের সামর্থ্য থেকে মানুষকে আলোকিত করতে।

Related Articles