পর্যাপ্ত ঘুম পেতে মেনে চলুন এই ৮টি উপায়
সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম সব বয়সের মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আপনার ঘুম পর্যাপ্ত হচ্ছে কিনা তা কীভাবে বুঝবেন? ঘুম ঠিকমতো না হওয়ার ক্ষতিকর প্রভাবগুলি কী? ঘুমের ঘাঢতি দূর করার উপায়গুলি কী? এই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে এই প্রবন্ধটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন।

আজকের এই ব্যস্ত পৃথিবীতে কাজ, বিনোদন, পরিবার সবকিছু সামলে রাখতে গিয়ে শেষমেশ ঘুমটাই চলে যায় প্রায়োরিটি লিস্টে সবার নিচে। দুর্বলতা, ক্লান্তি, অবসাদ বোধ করলেও আমরা অনেক সময় বুঝতেও পারি না অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে এমনটা হতে পারে। আসুন এই প্রবন্ধে জেনে নেই, অপর্যাপ্ত ঘুম আসলে কী এবং তা দূর করার উপায়।
পর্যাপ্ত ঘুম হচ্ছে কি না তা কীভাবে বুঝবেন?
আপনি যদি প্রতি রাতে আট ঘণ্টারও কম ঘুমিয়ে থাকেন তাও আপনার পর্যাপ্ত না ঘুমানোর সম্ভাবনা রয়েছে। অবাক হচ্ছেন? ঘুমের অভাব আপনাকে কীভাবে প্রভাবিত করছে তা সম্ভবত আপনার কোনও ধারণা নেই। আপনি যতটুকু ভাবছেন, ঘুম না হওয়ার বেশিরভাগ লক্ষণ তার চেয়েও অনেক বেশি সূক্ষ্ম।
-
সময়মতো ঘুম থেকে ওঠার জন্য অ্যালার্ম ঘড়ির উপর নির্ভর করা,
-
স্নুজ (রিপিট) অ্যালার্ম এর উপর নির্ভর করা,
-
সকালে বিছানা থেকে উঠতে বেশ কষ্ট করা,
-
কাজের মাঝে ঘুমের ভাব এবং বিরক্তি আসা,
-
দুপুরে অলস লাগা,
-
কোন কাজে মনোযোগে দিতে কষ্ট হওয়া,
-
সভা বা বক্তৃতার সময় ঘুম আসা,
-
সারাদিনের স্বাভাবিক রুটিনের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হওয়া,
-
ভারী খাবারের পরে বা ড্রাইভিং করার পরে ক্লান্ত হয়ে পড়া,
-
টিভি দেখার সময় বা সন্ধ্যায় আরামের সময় ঘুমিয়ে পড়া,
-
ছুটির দিনে ঘুমানোর প্রয়োজন বোধ করা,
-
বিছানায় যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়া,
-
দিনে জেগে থাকতে কষ্ট হওয়া।
ঘুম ঠিকমতো না হওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব
যদিও মনে হচ্ছে ঘুম কম হওয়া কোন বড় কথা নয়, তবে এর অনেক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ঘুমের অভাব আপনার সিদ্ধান্ত, বিবেচনা, সমন্বয় এবং চিন্তা করার সময় প্রভাব ফেলে। আসলে ঘুমের অভাব আপনাকে মাতাল হওয়ার মতোই প্রভাবিত করতে পারে।
আসুন জেনে নেই, ঘুমের অভাবে আমাদের কি হতে পারে?
-
ক্লান্তি ও অলসতা,
-
প্রেরণার অভাব,
-
বিরক্তি ভাব,
-
হতাশা বৃদ্ধি পাওয়া,
-
যৌন আকাঙ্ক্ষা হ্রাস,
-
সম্পর্কে সমস্যা,
-
মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক আচরণ,
-
স্মৃতি সমস্যা,
-
সৃজনশীলতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা হ্রাস,
-
সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা,
-
মানসিক চাপ মোকাবেলা করতে অক্ষমতা,
-
আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা,
-
অকালে ত্বকের কার্যকারিতা কমে যায়,
-
দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা,
-
ঘন ঘন সর্দি এবং সংক্রমণ,
-
ওজন বৃদ্ধি পাওয়া,
-
অস্বাভাবিক গাড়ী চালানো এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি,
-
হ্যালুসিনেশন এবং প্রলাপ,
-
স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, আলঝাইমার রোগ এবং নির্দিষ্ট ক্যান্সার সহ গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি।
ঘুমের স্বল্পতা কীভাবে আপনার ওজন বৃদ্ধি করে?
কখনও খেয়াল করেছেন, আপনার যখন ঘুম কম হয় তখন আপনি মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি আসক্ত হয়ে যান যা আপনাকে দ্রুত শক্তি যোগান দেয়। ঘুম স্বল্পতার সাথে অত্যধিক খাদ্য গ্রহণ ও ওজন বৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
আপনার শরীরে দুটি হরমোন রয়েছে যা ক্ষুধা এবং পেট ভরার স্বাভাবিক অনুভূতিগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। ঘেরলিন (Ghrelin) হরমোন ক্ষুধা জাগ্রত করে, আর লেপটিন (leptin) হরমোন মস্তিষ্কে সংকেত প্রেরণ করে যখন আপনার পেট পূর্ণ হয়। যাইহোক, আপনি যখন নিজের মতো ঘুমাতে পারেন না তখন আপনার শরীরে ঘেরলিনের মাত্রা বাড়তে থাকে যা আপনার ক্ষুধা জাগ্রত করে এবং আপনি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাবার খেয়ে ফেলেন। আর আপনার লেপটিনের মাত্রা হ্রাস পায় যার অর্থ আপনি সন্তুষ্ট বোধ করেন না এবং শুধু খেতে চান। সুতরাং, আপনি যত কম ঘুমোবেন, আপনার শরীর তত বেশি খাবার খেতে চাইবে।
পেটের মেদ কমানোর ১৩টি সহজ উপায়
পর্যাপ্ত ঘুম পেতে আপনার যা করতে হবে
আপনি যদি আপনার ঘুমের নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধান করতে চান বা দিনের বেলায় আরও উৎপাদনশীল, মানসিকভাবে তীক্ষ্ণ ও ভারসাম্য বোধ করতে চান তবে আপনার জন্য কোন উপায়টি সবচেয়ে ভাল কাজ করে তা দেখার জন্য নীচের ঘুমের পরামর্শগুলি মেনে চলতে পারেন-
১. আপনার ঘুমের ব্যাঘাতের জন্য স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলি চিহ্নিত করুন
শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার কারণে বা নির্দিষ্ট ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থেকে আপনার ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। তাই ঠিক কোন কারণে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে তা চিহ্নিত করুন এবং সে মোতাবেক চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
২. নিয়মিত ঘুমের সময়সূচীতে মেনে চলুন
আপনার হেলথ ক্লক বা জৈবিক ঘড়িকে ঠিক রাখতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন সহ প্রতিদিন একই সময়ে বিছানায় যেতে হবে এবং ঘুম থেকে উঠতে হবে।
স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস তৈরি করবেন যেভাবে
৩. নিয়মিত ব্যায়াম করুন
নিয়মিত ব্যায়াম আপনাকে ঘুমের অনেক রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। তাই প্রতিদিন ৩০ মিনিট বা তার বেশি হাটা বা ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন, তবে ঘুমাতে যাওয়ার কাছাকাছি সময়ে না।
৪. খাদ্যাভ্যাসে যত্নবান হতে হবে
ক্যাফেইন, অ্যালকোহল এবং মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলি আপনার ঘুমকে ব্যাহত করতে পারে। এছাড়া ঘুমানোর আগে ভারী খাবার খাওয়া বা খুব বেশি পরিমাণে পানি পান করলেও আপনার ঘুমকে ব্যাহত হবে। তাই চেষ্টা করুন সুষম খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে।
৫. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টে করতে শিখুন
কাজ, পরিবার বা পড়াশুনার চাপ যদি আপনাকে রাতে জাগ্রত করে রাখে তবে কীভাবে গঠনশীল উপায়ে স্ট্রেস পরিচালনা করতে হয় তা শিখতে পারেন। কারণ স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টে আপনাকে রাতে আরও ভাল ঘুমাতে সহায়তা করে।
আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক চাপ মোকাবেলার কৌশল!
৬. আপনার ঘুমের পরিবেশ উন্নত করুন
আপনার শোবার ঘরটি আলো থেকে দূরে, নিস্তব্ধ এবং শীতল রাখুন এবং আপনার বিছানাটি কেবলমাত্র ঘুমানোর জন্যই সংরক্ষণ করুন।
৭. একটি আরামদায়ক ঘুমের অভ্যাস করুন
রাতে শোবার সময় কোন কাজ, মোবাইল ফোন এবং চাপযুক্ত কথোপকথন এড়িয়ে চলুন। এগুলোর পরিবর্তে আপনি নিজের মনকে শান্ত রাখতে হালকা গরম পানিতে গোসল করে নিতে পারেন অথবা ঘুমের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য অন্যান্য কৌশল অবলম্বন করতে পারেন যা আপনার জন্য আরামদায়ক।
৮. দুশ্চিন্তা বাদ দিন
আপনি যদি কোনও বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে রাতে ঘুমাতে না পারেন তবে কাগজে একটি সংক্ষিপ্ত নোট লিখে রাখুন এবং পরের দিন সেটি নিয়ে আপনি চিন্তা করুন। এতে কাজটি সমাধান করা সহজ হবে আর আপান্র ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটবে না।
ইউস্ট্রেস বনাম ডিস্ট্রেস: যখন আপনার স্ট্রেস-ই আপনাকে ভাল করতে পারে
তাই বুঝতেই পারছেন ঘুম আমাদের জীবনের কত অপরিহার্য একটি বিষয়। শুধুমাত্র ঘুম ঠিক না থাকলে শরীর ও মন কোনটাই ঠিক থাকবে না। তাই আমাদের এখনি উচিত এই ব্যাপারে সচেতন হওয়া। আপনার লাইফ স্টাইলের উপর ভিত্তি করে এখনি একটি কার্যকরী রুটিন করে ফেলুন যেখানে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা যাবে। চলুন নিজে সচেতন হই আমাদের পরিবারকেও সচেতন করি।
পরিশেষ
ঘুম আমাদের শরীরের “Restart” Button এর মতো। ঘুমের মাধ্যমেই শরীর পুরনো জরা জীর্ণতা ক্লান্তি মেরামত করে আমাদের শতভাগ সুস্থ বোধ করায়, কর্মদক্ষতা বাড়ায় ও প্রশান্তি এনে দেয়। ভালো ঘুমের অভ্যাস মেনে চলাই হতে পারে দীর্ঘ সুখী ও সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি।
আরও পড়ুন:
-
অনিদ্রা, ঘুমের ওষুধ এবং কিছু কথা
-
মানসিক রোগ থেকে দ্রুত মুক্তির ৯ টি উপায়!
-
স্বপ্ন পূরণে চাই সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও পদক্ষেপ!