আপনার বাড়ির ৮টি জীবাণুযুক্ত জায়গা এবং সেগুলো পরিষ্কার করার উপায়
আপনি হয়ত খালি চোখে দেখতে পাচ্ছেন না, তবে আপনার বাড়িতে এমন সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জীবাণু রয়েছে যা আপনার প্রিয়জনদের অসুস্থতা করে দিতে পারে। তাই বাড়ির জীবাণুযুক্ত স্থানগুলো কি কি এবং সেগুলো পরিষ্কার করার উপায় সম্পর্কে জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।
"এমনকি সবচেয়ে পরিষ্কার বাড়িতেও ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস থাকবে। তবে তাদের বেশিরভাগই আসলে আমাদের জন্য উপকারী।" - আর্নেস্টো অ্যাবেল-সান্তোস, লাস ভেগাসের নেভাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়নের অধ্যাপক ।
তবে আপনাকে ক্ষতিকারক জীবাণুদের থেকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। আসলে নিজেদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পাশাপাশি ঘরদোরও জীবাণুমুক্ত রাখা উচিত। কেননা বাড়ির ভিতরে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে জীবাণু বংশবিস্তার করতে পারে। সেক্ষেত্রে ঘরের কিছু জায়গা যেমন- বাথরুম, রান্নাঘর, বেডরুম, বসার ঘর, খাবার ঘর, জুতা রাখার স্থান, ফ্রিজ রাখার জায়গা, বারান্দা ইত্যাদি নিয়মিত পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন। আসুন আজকের প্রবন্ধে বাড়ির ভেতরের জীবাণুযুক্ত জায়গা এবং তা পরিষ্কারের উপায়-সমূহ জেনে নিই।
১. বাথরুম বা ওয়াশরুম
আপনার বাথরুম নিয়মিত পরিষ্কার করুন। কেননা ওয়াশরুমে অনেক জীবাণু জন্মে আর তা সবার জন্যই ক্ষতিকর। আপনার বাথরুমে রাখা টুথব্রাশ হোল্ডার দৈনিক ধুয়ে ফেলুন, কারণ এতে অনেকবেশি জীবাণু থাকতে পারে। প্রতিদিন ওয়াশরুমের বেসিন, কল, কমোড, ফ্লোর ইত্যাদি হারপিক, ডেটল বা স্যাভলন কিংবা যে কোন জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করুন। বাথরুমের লাইটের সুইচ, দরজার নক, বিভিন্ন হ্যান্ডেল পরিষ্কার করে নিন। প্রতি সপ্তাহে গরম পানি দিয়ে ওয়াশরুমে রাখা তোয়ালে এবং ম্যাট ধুয়ে রোদে শুকাতে দিন। এছাড়াও ওয়াশরুম পরিষ্কারক উপকরণ যেমন- ব্রাশ, নেট, হারপিক, মব ইত্যাদিও ক্লিন করে এক কর্নারে রেখে দিন।
২. কিচেন বা রান্নাঘর
প্রতিদিন রান্নাঘরে অনেক ময়লা জমে, ফলে তা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হয়। পাকঘরের সিংকে মাছ, মাংস, শাকসবজি, ফলমূল ধোয়ার পাশাপাশি থালা-বাটিও মাজা হয়, সেক্ষেত্রে সেখানে অনেক জীবাণু বাসা বাঁধে। আর তাই ডেইলি রান্নাঘরের সিংক, কেবিনেট, মেঝে, রান্নার বিভিন্ন অনুষঙ্গ এবং চারপাশটা ক্লিন করা উচিত। যে চপিং বোর্ডের ওপর সবজী এবং মাংস কাটা হয়, তাও নিয়মিত পরিষ্কার করা উচিত। খাবারের তৈজসপত্র যেমন: হাঁড়িপাতিল, থালাবাসন, গ্লাস, চামচ, কড়াই ইত্যাদি ব্যবহারের আগে এবং পরে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। এছাড়াও থালাবাসন মাজার মাজুনি, হাঁড়িপাতিল ধরার কাপড়, দা, বঁটি, ছুড়ি, চাকু, কাটিং বোর্ড ইত্যাদি নিয়মিত পরিস্কার করে শুকনো এবং জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
৩. বেডরুম বা শোবার ঘর
অনেকেই শোবার ঘরের বিছানায় বসে ল্যাপটপ চালান, মোবাইল ইউজ করেন, স্ন্যাকসজাতীয় খাওয়া-দাওয়া করেন, বই পড়েন কিংবা হালকা কাজকর্ম করে থাকেন। আর যার ফলে রুমটি একটু নোংরা হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে দৈনিক শোবার ঘরের বিছানার চাদর, বালিশ, লেপ, কম্বল, কাঁথা ইত্যাদি পরিষ্কার করা উচিত। আর তা না হলে এতে ব্যাকটেরিয়া তৈরি হতে পারে। মূলত প্রতি সপ্তাহে বিছানার চাদর এবং বালিশের কাভার পাল্টাতে ও ধুতে হবে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১ সপ্তাহ ধরে ব্যবহৃত বিছানার চাদরে ওয়াশরুমের দরজার চেয়েও বেশি জীবাণু সৃষ্টি হয়। আবার মাইক্রোবায়োম জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা যায় যে, সূর্যের আলো বহু ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে পারে। সেজন্য আপনার বেডরুমে সূর্যের আলো ঢুকতে দিন, কেননা তা ঘরটিকে আপনাআপনি জীবাণুমুক্ত করতে পারবে।
আপনার তোয়ালেটি জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়ার আঁতুড়ঘর নাতো?
৪. বসার ঘর বা ড্রয়িং রুম
সাধারণত বসার ঘর বা ড্রয়িং রুমটি সবসময় ব্যস্ত থাকে। মূলত এখানে পরিবারের সব সদস্যরা বসে গল্প করে, টেলিভিশন দেখে, বাচ্চারা গেমস খেলে থাকে। এমনকি অতিথি আসলেও এই কক্ষেই বসতে দেয়া হয়। আবার এই রুমেই হেডফোন, টিভির রিমোর্ট, কিবোর্ড, ফোন ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এসব ইলেকট্রনিকসে জিনিসে জীবাণু, ধুলাবালি, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি থাকে, তাই এগুলোও ভালোভাবে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এছাড়াও ড্রয়িং রুমের আসবাবপত্র যেমন সোফা, টি টেবিল, কুশন, শোকেস, টিভি, কার্পেট, শোপিস, ফুলদানি ইত্যাদি নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে।
৫. ডাইনিং রুম বা খাবার ঘর
আপনার খাবারের রুমটি সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত। যেহেতু এখানে বসে সবাই ৩ বেলা খাবার খায়, সেহেতু এখানে একটু বাড়তি পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজন আছে বৈকি। আপনার খাবারের টেবিল, চেয়ার এবং টেবিলে রাখা আসবাবপত্র ডেইলি ক্লিন করুন। আপনার খাবারের প্লেট, গ্লাস, চামচ, ঢাকনা-বাটি ইত্যাদি ভালো করে মেজে পরিষ্কার কাপড় কিংবা ন্যাপকিন টিস্যু দিয়ে মুছে গুছিয়ে রাখতে পারেন। আবার আপনার খাবার ঘরের টেবিল ক্লথটি নিয়মিত পরিষ্কার করতে ভুলবেন না। এছাড়াও আপনার বাসায় যদি পোষা প্রাণী থাকে, তবে তা যেন ডাইনিং রুমটি নোংরা না করে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
৬. জুতা রাখার স্থান
সাধারণত বাইরে থেকে আসলে জুতার সাথে ধুলা-ময়লা, ছত্রাক, বিষাক্ত উপাদান, অ্যালার্জি সৃষ্টির জীবাণু মাইট ইত্যাদি ঘরে প্রবেশ করতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার জুতা খুলে ঘরে ঢোকার অভ্যাস করতে হবে। মূলত বাইরে পরার জুতা থেকে বিভিন্ন রকমের দূষণ সৃষ্টি হয়। সেজন্য সপ্তাহে ১ দিন জুতার বক্স, জুতা রাখার স্থান এবং জুতার র্যাক পরিষ্কার করা উচিত। এতে আপনার ঘরে জীবাণু এবং ব্যাকটিরিয়া প্রবেশ করতে পারবে না। এছাড়াও এসব পরিষ্কাররের পর আপনার হাতদুটো সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ধুয়ে নিতে ভুলবেন না।
৭. ফ্রিজ এবং ফ্রিজ রাখার জায়গা
আমরা সাধারণত খাবার ভালো রাখতে ফ্রিজ ব্যবহার করি। সেক্ষেত্রে ফ্রিজ খাবার ঠিকই ভালো রাখে, কিন্তু এতে রাখা খাবার থেকে অন্য খাবারে কিংবা ফ্রিজের দেয়ালে বিভিন্ন রকমের ব্যাকটেরিয়া যেমন- নরোভাইরাস, সেলমোনেলা, কম্পিলোব্যাক্টর ইত্যাদি সংক্রমিত হতে পারে। আবার অনেকসময় ফ্রিজ কিংবা ফ্রিজ রাখার জায়গায় পানি জমে জীবাণু সৃষ্টি হতে পারে। আর তাইতো নিয়মিত ফ্রিজ এবং এর আশে-পাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। এছাড়াও ফ্রিজ থেকে কোন ফলমূল নিয়ে খাওয়ার আগে তা ভালো করে ধুয়ে নিবেন।
৮. বারান্দা বা ব্যালকনি
আপনার বাসার বারান্দা বা ব্যালকনিতেও অনেক জীবাণু সৃষ্টি হতে পারে। মূলত ব্যালকনিতে উড়ে আসা ধুলোবালি, ছত্রাক, ময়লার কারণে ব্যাকটেরিয়া তৈরি হতে পারে। আর এক্ষেত্রে আপনার ছোট্ট বারান্দাটাকে রোগজীবাণুর আশ্রয়স্থল হওয়া থেকে বাঁচাতে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে নিয়মিত ভালো করে বারান্দা ঝাড়ু দিয়ে, ডেটল মিশ্রিত পানি দিয়ে ধুয়ে এবং টবগুলো পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়াও বারান্দায় রাখা ফুলের টবে পানি জমে তা যেন এডিস মশার জন্মস্থান না হয়, সেদিকেও বাড়তি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
সবশেষ
আমাদের সুস্থ-স্বাভাবিক থাকার জন্য নিজেদের যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, তেমনি বাসাবাড়িও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। মূলত ক্ষতিকারক জীবাণু, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতি থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত ঘরদোর পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন। আর তাইতো আপনার পরিবারের সদস্যদের সুস্থ ও নিরাপদ রাখতে বাসার রুমগুলো, ফার্নিচার, আসবাবপত্র ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত রাখতে চেষ্টা করুন।