রমজানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি: কিভাবে সুস্থ্য থাকবেন?

রমজানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্ব গতির ভেতর কিভাবে সুস্থ্য ও ভালো থাকবেন? এই লেখাটি আপনি এখন পড়ছেন, অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় আপনিও উত্তরটি জানতে চান। এই দুঃসময়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীনতার ভেতরেও, যদি আমার জানা জ্ঞান থেকে রোজাদার মানুষের সামান্য কষ্ট লাঘব হয় সেটাই পরম প্রাপ্য। চলুন আর কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক।

অর্থনীতির এই নিরব দূর্ভিক্ষের ভেতরে ক্রয়ক্ষমতা না থাকলে সবই অর্থহীন। তবু আমি কেন এই লেখাটি লিখছি? প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ এই ঘোর অমানিশার মধ্যে ভালো থাকার কোন জাদুমন্ত্র আমার জানা নাই। যেভাবে বাজার প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা সত্যিই ট্রাজিক, বেশিরভাগ নতুন প্রজন্ম জীবনকালে এমন অর্থনৈতিক টানাপোড়ন দেখেন নি।

রমজানে আমাদের সবার জন্যই সবচেয়ে দুর্বল সময় বলা চলে। সুস্থ্যভাবে রোজা রাখতে গেলে যথেষ্ট খাবারের প্রয়োজন। আর ব্যবসাহীরা আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিতে কখনো ভুল করেন না। ভাবছেন মোড়ের রাস্তার মুদির দোকানদার আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন? অবশ্যই না। এর পেছনে অনেক বড়-বড় ব্যবসাহীরা জড়িত। যদিও একতরফা ব্যবসাহীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বৈশ্বিক মন্দা, দুর্নীতি, অসাধু ব্যবসাহী সঙ্গে মানুষের অতিরিক্ত চাহিদা সব মিলিয়ে রমজানের দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতি যেন লাগামহীন ঘোড়া। আসুন ঘোড়ায় চড়ে এখন অর্থনীতি ক্লাস থেকে বের হয়ে আমাদের মূল উদ্দ্যেশ্যতে ফিরি।

প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য

উদ্দেশ্য হলো, এই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে কিভাবে একটু সুস্থ্য থেকে আর আরামে পার করা যায় তা জানা। সবচেয়ে সহজ কথাটা হলো, রোজায় একটু আরামে কাটাতে হলে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, এবং সেই খাবার আপনার অর্থনৈতিক অবস্থার ভেতরে এঁটে যেতে হবে। সত্যি বলতে সবার অর্থনৈতিক অবস্থা সমান নয়, আর সবার জন্য আলাদা আলাদা করে প্রবন্ধ লেখাও সম্ভব নয়।

আমি যা করতে পারি তা হলো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস জানাতে পারি যা জানলে আপনি নিজেই বুদ্ধি করে আপনার পুষ্টি ও অর্থ পরিকল্পনা করে একটু আরামে রোজার সময়টা কাটাতে পারবেন।

যা যা জানব

বেশ অনেকটা কথা বলা হয়ে গেছে, তবু মূল পয়েন্টে এখনো ফেরা হয়নি। তাই বিরক্ত বোধ করার আগেই চলুন কি কি জানব তা একটু আগাম জানা যাক।

  • ভাত খেয়ে কি লাভ হচ্ছে?

  • কার্বহাইড্রেটের প্রকারভেদ ও এটা যেভাবে কাজে লাগাতে পারেন

  • প্রোটিনের অভাব পূরণ করবেন কিভাবে?

  • স্বল্পমূল্যের পুষ্টিকর খাবারের তালিকা

  • জীবন ব্যাবস্থার পরিবর্তন ইত্যাদি।

ভাত খাবার লাভ কি হচ্ছে?

ভাত আমাদের প্রধান খাবার, এবং মোট জনগোষ্ঠির প্রায় সম্পুর্ণটুকুই ভাতের উপর নির্ভরশীল। অর্থনীতি যতই উঁচুতে যাক বা নিচুতে নামুক, রমজান হোক বা বৈশাখ ভাত খাওয়ার সাথে আমাদের কোন আপস নেই। ব্যপারটা অভ্যাসগতও বটে। তবে চলুন ভাত খাবার স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগত দিকটা জানে নেওয়া যাক।

ভাত একটি কার্বহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য ও এটি এমন ধরণের কার্বহাইড্রেট যা খুব দ্রুত শরীর ব্যাবহার করতে পারে। ভাত হজম শুরু হয় আমাদের মুখে এবং পেটে যাওয়ার পর থেকেই শক্তি যোগায়। ভাত খেয়ে অভ্যাস থাকার কারণেই খাবার পর দ্রুত শক্তি পাওয়াটা আমাদের অভ্যাসই বলা চলে। বাঙালীরা ভাত খেয়ে যতটা আরাম পায় অন্য দামী খাবারও তাদের কাছে ততটা স্যাটিসফাইং না। এর কারণ বলতে গেলে ভাত হজম হওয়ার ধরণকেই দায়ী করা যায়।

কিন্তু দুঃখজনক ভাবে ভাত রোজা রাখার জন্য আদর্শ খাবার নয়। সেহরীর সময় ভাতের সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অন্য খাবার গ্রহণ না করলে আপনি সারাদিন ক্ষুধায় কষ্ট করতে হতে পারে। যদিও রোজা ভাঙার জন্য অল্প ভাত খাওয়া যেতে পারে। সেই সাথে ভাত খেলে শরীরে কার্বহাইড্রেট শোষনের জন্য প্রচুর ইনসুলিনের দরকার হয়। দীর্ঘদীন সেই ইনসুলিন উৎপাদন করতে গিয়ে, একসময় তা উৎপাদনে গোলযোগ সৃষ্টি হয়। যার কারণে ডায়বেটিস হতে পারে। তাই অতিরিক্ত ভাত খাওয়া স্বাস্থ্যকরও নয়।

কার্বহাইড্রেটের প্রকারভেদ 

হজম হওয়া বা শক্তি দেওয়ার উপর নির্ভর করে কার্বহাইড্রেট তির ধরণের হয়ে থাকে। এই ভাগ গুলোর মূল ভিত্তি হচ্ছো Glycemic index. এটি একটি স্কেল যাতে ১-১০০ পর্যন্ত রেটিং আছে এবং এর কাজ হচ্ছে কোন শর্করা কত দ্রুত বা আস্তে শক্তি দেয় তার উপর নির্ভর করে একটি নম্বর দেওয়া। এই স্কেলে-

  • কম নম্বরের শর্করা হওয়ার অর্থ হলো খাবারটি অনেক্ষন ধরে শক্তি প্রদান করে, এবং বেশি নম্বর মানে দ্রুত শক্তি প্রদান করে ও ফুরিয়ে যায়।

  • এই স্কেলে কম রেটিং এর শর্কারা জাতীয় খাবার সাধারণত স্বাস্থ্যসম্মত হয়ে থাকে।

শর্করার ভাগ গুলি হচ্ছে Glycemic index এর ১-৫০, ৫১-৭০ ও ৭১-১০০ রেটিং, যা যথাক্রমে নিন্ম, মাঝারি ও দ্রুত হজম হওয়া শর্করাকে নির্দেশ করে। 

এখন এই তথ্যটি জেনে আপনি কি করবেন? এই তথ্য আপনাকে সেহরী ও ইফতারের খাবার নির্বাচনে সাহায্য করবে। যে সব কার্বহাইড্রেট খাবার কম দ্রুত হজম হয়, সেগুলো সেহরীর জন্য আদর্শ, অন্যদিকে যে শর্করা দ্রুত পুষ্টি দেয় তা ইফতারির জন্য আদর্শ। 

  • সেহরীর সময় খেতে হলে লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি খান। ভাতের চেয়ে রুটির Glycemic index অনেক কম। আবার আটায় তা আরো কম হয়ে থাকে। সাদা ভাতের চেয়ে লাল ভাত দীর্ঘসময় শক্তি দেয়। সবচেয়ে ভালো হয় হোল গ্রেইন ওট খেতে পারলে। ওটে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও উন্নতমানের শর্করা আছে যা সারাদিন শক্তি যোগাতে পারে। যদিও সবজায়গায় সুলভ মূল্যে এটি পাওয়া একটু কষ্টকর। 

  • সবজির কার্বহাইড্রেটের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। যদিও সবজির মূল্যও এখন আর সবজির মত নেই। তবু সুস্বাস্থ্যের জন্য নিয়মিত সবজি খাওয়ার বিকল্প নেই। তাই কষ্ট করে হলেও সবসময় কিছু না কিছু সবজি খাবারের লস্টে রাখার চেষ্টা করুন। কম দামে পেলে মৌসুমী ফলও কিনতে পারেন।

  • ইফতারির সময় খেজুর, কলা বা ভাতও খেতে পারেন। তবে একবারে বেশি খাবেন না। অল্প খেয়ে নামাজের বিরতি দিয়ে, তারপর খাবেন। ইফতার থেকে সেহরী পর্যন্ত অন্তত ৮ গ্লাস পানি পান করা জরুরী।

প্রোটিনের অভাব পূরণ করবেন কিভাবে?

সত্যি বলতে বাংলাদেশে মানুষের যতই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আসুক না কেন, কিছু কিছু অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের সাথে অর্থের উপর দোষ চাপানো যাবে না। যেমন ধরুন ইফতারিতে ভাজাপোড়া খাওয়ার ব্যপারটা। স্বচ্ছল হোক অসচ্ছল হোক চপ, বেগুনী সহ তেলেভাজা খাবার ছাড়া ইফতার ভাবা যায় না। আমাদের সবারই উচিত এই অভ্যাসটা থেকে বেরিয়ে আসা। কারণ এসব তেলে ভাজা খাবারে থাকে ক্ষতিকর ফ্যাট যা হার্টের অসুখ সহ অন্যান্য জটিল রোগ সূষ্টি করতে পারে। খরচ করে অস্বাস্থ্যকর খাবার কেন খাবেন। এখন আসুন প্রোটিন নিয়ে কথা বলা যাক।

  • আপনার যা ওজন ও স্বাস্থ্য, তা ধরে রাখতে হলে আপনাকে দৈনিক অন্তত ৫০ গ্রাম সলিড প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে।

  • সলিড প্রোটিন বলতে একটি ডিমে প্রোটিন থাকে ৭ গ্রাম। অর্থাৎ ডিম দিয়ে প্রোটিনের চাহিদা পূরণে আপনার প্রয়োজন হবে ৭ টি ডিম! 

  • গরুর মাংসে প্রতি ১০০ গ্রামে ২৬ গ্রামের কাছাকাছি প্রোটিন থাকে। অর্থাৎ প্রোটিনের চাহিদা গরুর মাংস দিয়ে পূরণে আপনার দৈনিক ২০০ গ্রাম মাংস খেতে হবে। 

  • মুরগীর মাংসে গরুর মাংসের তুলনায় কম প্রোটিন থাকে, প্রায় ১৬-১৮ গ্রাম প্রতি ১০০ গ্রামে।

রূপকথার গল্প থেকে বেরিয়ে আসা যাক, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে দৈনিক তো দূরে থাক অনেকের ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক মাংস খাওয়াও যেন দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। তবে এই ঘাঢ়তি পূরণ করবেন কিভাবে?

সৌভাগ্যবসত অন্য খাবারেও প্রোটিন পাওয়া যায়, যেমন-

  • ১০০ গ্রাম ভাতে আড়াই গ্রাম প্রোটিন,

  • ১০০ গ্রাম ওটস ১৬ গ্রাম, এমন সব খাবারেই কম বেশি থাকে।

যদিও প্রাণিজ প্রোটিন শোষণ সহজ ও শরীরের জন্য বেশি উপকারী। দামের কথা চিন্তা করে উদ্ভিজ্জ খাবার দিয়ে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা যায়। ছোলা, মটরশুটি, শিম বীজ, মসুর ডাল ইত্যাদি খাবার সচেতন থেকে গ্রহণ করলে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা সহজ। এই সব কিছুর দাম বাড়লেও অন্তত মানুষ কিছুটা হলেও কিনতে পারছে, অন্যদিকে মাংসের কেনা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরেই চলে যাচ্ছে দিন দিন। তবু সম্ভব হলে প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ আমিষ দুটোই ভারসাম্য রেখে গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মাছ স্বল্পমূল্যে সবসময়ই পাবেন, বিশেষ করে ছোট মাছ প্রোটিনের সাথে সাথে বিভিন্ন ভিটামিন মিনারেলস এর ঘাঢ়তি পূরণ করতে পারে।

স্বল্পমূল্যে পুষ্টিকর খাবারের তালিকা

বর্তমানে পুষ্টিকর অপুষ্টিকর সব খাবারেরই দাম বেশি। তবু এই সংকটের পুষ্টিকর খাবারেই লক্ষ রাখতে হবে। 

  • চিনা বাদাম

  • চিড়া

  • ছোলা

  • ডাবলি

  • লাল আটা

  • ডিম

  • আলু

  • মাছ

  • ছোট মাছ

  • গাজর

  • বিভিন্ন ধরণের ডাল ইত্যাদি।

জীবন ব্যবস্থায় পরিবর্তন

স্বাস্থ্যই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই বর্তমানে অন্য সকল বিলাসী চাহিদা কমিয়ে স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের উপর গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ভেতর ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রশাক, জামা, জুতো বা বিলাস বহুল কোথাও খাওয়ার যতটা সম্ভব কমিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যায় করলে কিছুটা স্বাচ্ছন্দে চলতে পারবেন। প্রয়োজনীয় হিসাব আগে আগে করে ফেললে, পরবর্তিতে বেশি খরচ করে ফেলার ঝুঁকি কমবে।  

স্বারমর্ম

চলুন এই প্রবন্ধটির মূল পয়েন্ট গুলো আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক!

  • যে সব কার্বহাইড্রেট জাতীয় খাবার ধীরে হজম হয়, সেগুলো গ্রহণ করে রোজা রাখলে স্বাচ্ছন্দে থাকবেন।

  • ইফতারে দ্রুত শক্তি দেয় এমন শর্করা জাতীয় খাবার উপকারী।

  • ইফতার থেকে সেহরী পর্যন্ত ৮ গ্লাস পানি পান করা জরুরী।

  • ঘন ডাল, ছোলা, ডিম, ডাবলি ইত্যাদি খেয়ে প্রোটিনের অভাব পূরণ করতে পারেন।

  • স্বল্পমূল্যের মাছ ও ছোটমাছ প্রোটিন সহ ভিটামিন এ মিনারেলসের অভাব পূরণ করবে।

  • শাক-সবজি ছাড়া সহজেই ভিটামিন এর ঘাঢ়তিতে পড়তে পারেন, তাই অল্প হলেও নিয়মিত সবজি খাওয়ার চেষ্টা করুন।

পরিশেষ

স্বাস্থ্যবিষয়ক খুব কম প্রবন্ধই লিখেছি যাতে যথার্থ উত্তর দিতে পারি নি, কারণ উত্তর নেই। এই উত্তর না থাকার পরও উত্তর দেবার চেষ্টাকে মার্জনা করবেন। তবু আশা করছি এই প্রবন্ধটি থেকে কিছু হলেও জানতে পেরেছেন যা একটু হলেও এই সময়টাতে কাজে লাগবে।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles