সেচ্ছাসেবক হবার অভাবনীয় উপকারীতা! বদলে দিবে গোটা পৃথিবী
সেচ্ছাসেবা হলো সেই কাজ যার বিনিময়ে কোন অর্থ পাবেন না। কিন্তু বিনিময়ে যা পাবেন, আর যা দেবেন তা কোন অর্থমূল্যে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। দলবদ্ধ সেচ্ছাসেবা আপনাকে নতুন বন্ধু বানানো, নতুন দক্ষতা গড়ে তোলা এমনকি ক্যারিয়ার জীবনেও সুবিধা করে দেবে। আসুন বিস্তারিত জেনে নেই এই মহৎ কাজটির উপকারীতা ও মাহাত্ম।
সেচ্ছাসেবক হিসেবে আপনি অন্যের জীবনের সাথেও বদলে দিতে পারেন আপনার নিজের জীবন ও গোটা পৃথিবী।
প্রতিটি মানুষকেই জীবন ও জীবিকার জন্য ছুটতে হয় প্রতিনিয়ত। এর মাঝে স্বেচ্ছাসেবার কথা উঠলেই সাধারণ মানুষ ভাবতে বসেন, মূল্যবান সময় টুকু দিয়ে কোন বিনামুল্যের কাজ করাটা কতটুকু যৌক্তিক হবে? অন্যদিকে একজন নতুন স্বেচ্ছাসেবক কিছুদিন কাজ করার পরই ভাবেন, এতদিন কেন শুরু করেন নি আর অন্যরাই বা করছে না কেন! অর্থাৎ এটুকু পরিষ্কার স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়াতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারীতা আছে যা সাধারণ মানুষের জ্ঞানের অন্তরালেই থেকে যায়। এই প্রবন্ধটিতে সেই সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করব।
কেন স্বেচ্ছাসেবক হবেন?
একজন স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করার মূল কারণ হওয়া উচিৎ সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ। সামান্য স্বেচ্ছাশ্রমে দিয়ে একজন সমাজ, মানুষ ও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সাধন করতে পারেন।
ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে সাহায্য করে
স্বেচ্ছাশ্রম মানুষে-মানুষে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। শুধু নিজের জন্য বাঁচা কি মানব জীবনের অপচয় নয়! সৃষ্টির সবচেয়ে উন্নত জীব হিসেবে শুধু শুধু নিজের জন্য ভাবার চাইতেও বড় দায়িত্ববোধ অনুভব করা একজন মহৎ মানুষের বৈশিষ্ট্য।
এইতো গেল নীতির কথা। তবে হিসেব করতে গেলে, স্বেচ্ছাশ্রমে যে সময় ও শ্রম দিচ্ছেন তার বহুগুন অর্জন করতে পারবেন এই মহৎ কাজটি থেকে।
নতুন নতুন মানুষের সান্নিধ্যে আসা যায়
আমরা বেশিরভাগ মানুষ একটা গন্ডির মত আবদ্ধ থাকি যেখানে নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশের সম্মুখীন খুব একটা হতে হয় না। কোন স্বেচ্ছাসেবক দলে যুক্ত হলে আপনি প্রতিনিয়ত নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। নতুন মানুষের সাথে কিভাবে দ্রুত সহজ হওয়া যায়, সেই জ্ঞানটুকুও জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বইকি!
যোগাযোগ দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে
খেয়াল করুন, যারা স্বেচ্ছাসেবা করতে আসেন, তাদের ভেতর আত্বত্যাগ ও সেবার গুনাবলী রয়েছে। তাই খু্ব সম্ভব কিছু ভালো বন্ধুও পেয়ে যেতে পারেন। স্বেচ্ছাসেবা গোষ্ঠিগুলোতে সাধারণত অনেক ধরণের ও বয়সের মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া যায় যা আপনাকে একটা ভালো সামাজিক জানাশোনা ও যোগাযোগ উন্নত করতে সাহায্য করবে।
বহু গুণের অধিকারী হবেন
এই ধরণের কাজে নানা রকম দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে। হতে পারে কখনো বাঁশের সাঁকো তৈরি করতে হচ্ছে আবার কখনো কম্পিউটার টাইপিং করে কোন দরখাস্ত লিখতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নানা রকম কাজ শেখা আপনার দক্ষতা ও বহুমুখীতা বহু গুনে বাড়িয়ে তুলবে।
শারিরীক ও মানসিক ভাবে সুস্থ্য রাখে
এসব কাজে যেহেতু কোন প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা নেই, আপনি যেকোন সময় যেকোন কাজ করতে ও ছাড়তে পারেন। ভলেন্টিয়ারিং এর অন্য অনেক উপকারীতাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন বেশিরভাগ সময় আপনাকে কাজ করতে হবে মাঠ পর্যায়ে যা আপনাকে শারিরীক ও মানসিক ভাবে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করবে।
মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন
আরেকটি মুখ্য বিষয় হলো এরধরণের কাজে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাওয়া যায়। স্বেচ্ছাসেবা জীবনের একটা অর্থ প্রদান করে যা মোটেও ফেলনা নয়। সর্বপরি মানসিক প্রশান্তি ও ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠার একটা মোক্ষম উপায় হলো স্বেচ্ছাশ্রম প্রদান।
সেচ্ছাসেবার চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারীতা
১) সামাজিক যোগাযোগ ও কমিউনিকেশন স্কিল বাড়ায়।
২) শরীর ও মনের জন্য উপকারী।
৩) কর্মজীবনে গুরুত্বপূর্ণ।
৪) প্রচ্ছল আনন্দ ও আত্বতৃপ্তির উৎস।
চলুন এই চারটি পয়েন্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
সামাজিক যোগাযোগ ও কমিউনিকেশন স্কিল
সাধারণত স্বেচ্ছেসেবক দলগুলোতে অনেক পেশা ও বয়সের মানুষ থাকে। ধরুন আপনি কোন একটা ইভেন্ট ম্যানেজ করতে চান তবে তেমন কোন ধারণা নেই। এমন হতে পারে আপনি সে স্বেচ্ছাসেবক দলে কাজ করেন কেউ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞ। আপনি তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা পেতে পারেন। অথবা, একদিন দেখলেন রাস্তায় কোন পথশিশু অসুস্থ্য হয়ে পড়ে আছে। একজন সাধারণ মানুষের জন্য এমন পরিস্থিতিতে সহায়তা করা বেশ কঠিন। কিন্তু একজন স্বেচ্ছাসেবক সহজেই তার দল ও সহকর্মিদের জানিয়ে পরিস্থিতি সামলে ফেলতে পারে।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রকম মানুষের সাথে পরিচয় থাকা বেশ কাজের হতে পারে। একসাথে নিস্বার্থ ভাবে কাজ করা মানুষদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠা বেশ সহজ। বিশেষ করে ইন্ট্রোভার্ট মানুষেরা স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে নিজের গন্ডি থেকে সহজেই বের হয়ে আসতে পারেন। সেই সাথে একটি দল হিসেবে কাজ করার দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুনাবলী অর্জেনের একটি অসাধারণ মাধ্যম হলো এই স্বেচ্ছাসেবা। পুরো পরিবার মিলে স্বেচ্ছাসেবা দেওয়াও পারিবারিক মিলবন্ধন বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে। তাছাড়া বাচ্চারা তো যা দেখে তাই শেখে।
শরীর ও মনের জন্য স্বেচ্ছাসেবা
শরীর ও মন এর জন্য স্বেচ্ছাসেবা বেশ উপকারী। স্বেচ্ছাসেবার কাজে হাঁটা ও অন্যান্য কায়িক পরিশ্রম এর কাজ প্রায়ই থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য লাভজনক। আমেরিকায় একটা জরিপে দেখা গেছে যে সব বৃদ্ধ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে আসছেন তাদের উচ্চরক্তচাপ এর প্রবণতা কম। রিটায়ারমেন্টে বা অবসরের পর অনেকে বাকী জীবনে আর কোন উদ্দেশ্য খুঁজে পান না। এটি একটা সাধারণ মানসিক পীড়া। এই সমস্যাটি থেকে পরিত্রান পেতে স্বেচ্ছাসেবা শুরু করা একটি ভালো উপায়। সমাজের উপকারের সাথে সাথে শরীর ও মনও ভালো রাখা গেল। আপনি যত হাসেন, নতুন কিছু দেখেন বা কারো সাখে কথা বলেন, তা আপনার মস্তিষ্কে বিভিন্ন হরমোন নিঃস্বরণকে বাড়িয়ে তোলে। যার ফলে মানসিক বিষন্নতা ও ডিপ্রেশন এড়ানো যায়। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে রাগ, ক্রোধ ও হতাশা থেকেও নিস্তার পাওয়া সম্ভব।
কর্মজীবনে গুরুত্ব
স্বেচ্ছাশ্রমের উপকারীতা সম্ভবত কর্মজীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখে। নিউয়র্ক ভিত্তিক একটি জরিপে উঠে আসে, যারা চাকরী দেন তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ স্বীকার করেছেন সিভিতে স্বেচ্ছাসেবার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রার্থিদের তারা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। সেচ্ছাসেবার মাধ্যমে খুব সহজে অনেকগুলো প্রয়োজনীয় ও প্রাক্টিক্যাল দক্ষতা অর্জন করা যায় যা চাকরীক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া একটি দল হিসেবে কাজ করা, নেতৃত্বের গুনাবলি ও ত্যাগের মানসিকতা স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। চাকরীদাতা প্রতিষ্ঠান গুলোও এইসব বিষয়ে অবগত। তাই স্বেচ্ছাসেবার অভিজ্ঞতা আপনার সিভির জন্য একটি অসাধারণ সংযোজন হতে পারে। তাছাড়া স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচিতিও কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়তে পারে। ধরুন আপনি কোন সেচ্ছাসেবা দলের হয়ে গ্রাফিক ডিজাইন করেছেন। হয়ত কারো প্রয়োজন হলে আপনাকে প্রাসঙ্গিক কোন কাজে নিয়োগ দিতে পারেন।
প্রচ্ছল আনন্দ ও আত্মতৃপ্তির উৎস
মানুষের সেবা করার মাঝে এমন একটা অকৃত্তিম আত্মতৃপ্তি আছে যার নিচে বড় বড় ত্যাগও ঢেকে যায়। তাছাড়া সমবয়সী একদল স্বেচ্ছাসেবক একসাথে হলে আনন্দ বিনোদনের কোন অভাব হয় না তা বলাই বাহুল্য। স্বেচ্ছাশ্রমে হয়ত দুঃখি মানুষের সেবা করার প্রয়োজন হতে পারে তবে এটি এমন কিছু রসহীন কাজ নয় যে গোমড়া মুখে করে যেতে হবে, ডেস্কের পেছনে বসে যেমনটি করে থাকেন। একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করুন, গান গান, অবসরে গল্প করুন এইতো। ছুটির দির বাসায় গা এলিয়ে সারাদিন শুয়ে থাকার চাইতে একবেলা ভলেন্টিয়ারিং করে আসা খুব একটা মন্দ হবে না। খুব বেশি সময় না, সপ্তাহে ৩ ঘন্টা দিলেও বছর শেষে তা হবে দেড়শো ঘন্টা। যা সত্যিকার অর্থেই সমাজে একটা ভালো প্রভাব রাখবে।
যেভাবে স্বেচ্ছাসেবক হতে পারেন
আসলে স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার জন্য মনের ইচ্ছাটুকই যথেষ্ট। আপনি নিজের থেকেই শুরু করুন। দেখবেন আপনার দেখাদেখি আপনার পরিচিতরা আস্তে আস্তে যোগ দিচ্ছে। কয়েকজন বন্ধু মিলেও স্বেচ্ছাসেবা শুরু করে দিতে পারেন। সবখানেই এমন মানুষ পাবেন যারা নিস্বার্থ ভাবে সমাজ বদলের কাজ করবে।
এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক দল ও সংস্থা কাজ করছে। দলে যোগ দেবার আগে ঠিক করুন আপনি কতটা সময় দিতে পারবেন ও কি ধরণের কাজ করতে চান। সে অনুসারে স্বেচ্ছাসেবক দল গুলোতে যোগ দিতে পারেন। কোনটি হয়ত অসহায় মানুষদের নিয়ে কাজ করে, কোনটি নারীর উন্নয়ন আবার কোনটি পথের অসহায় জীবজন্তুর দেখভাল করে। আবার সব ধরনের কাজও করে এমনও সংস্থা রয়েছে। তাই পছন্দমত একটি বেছে নিন। একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যেতে পারেন।
পাঠকের স্বার্থে এই প্রবন্ধেই বাংলাদেশের কিছু সেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানের লিস্ট দিয়ে দিচ্ছি।
-
ভলেন্টিয়ার ফর বাংলাদেশ
-
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন
-
বাংলাদেশ স্কাউট
-
আত্ম কর্ম সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (AKSUS)
-
ACORD (The Association for Cooperative Operations Research and Development)
-
CARI (Community Advancement and Research Initiatives)
-
Center for Information and Communication
-
Human Rights- First The Child
-
Polash Association for Rural Development
-
Participatory Human Rights Advancement Society
-
Rural Mother and Child Healthcare Society
এছাড়া রয়েছে আরো অনেক সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান।
সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। পালা বদলের শুরু হোক আপনার হাতেই।