ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং - দ্রুত ওজন কমানোর সেরা উপায়। (২০২১)
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বা সবিরাম উপবাস বিশ্বজুড়ে বহুল আলোচিত ডায়েট প্লান। শুধু ওজন কমানোই নয়, এটি যেমন সুসাস্থ্য ও রোগমুক্তিতে সহায়ক তেমনি গলাটিপে ধরা প্রচলিত ডায়েট থেকে অনেকাংশেই সহজ।
আমরা বাঙালিরা জাতিগত ভাবেই খুব ভোজন রসিক। খাবারে প্রতি আমাদের ভালোবাসা কথায় প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু এই ভোজন রসিকতায় বাঁধ সাজতে চলে আসে মুটিয়ে যাওয়া, ডায়বেটিস, হার্টে সমস্যা, লিভারে গোলযোগের মত সমস্যাগুলি। এজন্য প্রয়োজন ওজন নিয়ন্ত্রণ, কিন্তু পছন্দের খাবার পরিহার করা কি এত সোজা! তাইতো মোটামুটি বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষ ডায়েটিং শুরু করেন না। আবার যারা করেনও বেশিরভাগই মনপীড়ায় ভোগেন!
কিন্তু যদি বলি এমনও উপায় আছে যেখানে পছন্দের খাবারটিও খেতেও পারবেন, সাথে স্বাস্থকর ভাবে ওজনও কমবে! হ্যাঁ, এটিই মূলত ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং।
২০১৯ সালে ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি খোঁজা শব্দের মধ্যে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ছিল উপরের দিকে। এটা এত জনপ্রিয় ছিল যে, ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এটি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। মূলত এটি সবার সামনে উঠে আসে ২০১২ সালে, বিবিসির সাংবাদিক ডাঃ মাইকেল মোসলে এর টিভি শো "Eat Fast, Live Longer" এর মাধ্যমে। চলুন জেনে আসা যাক এর ইতি বৃত্তান্ত!
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং আসলে কী?
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং একটি খাদ্যাভ্যাস যেখানে আপনি কি খাচ্ছেন, কতটুকু খাচ্ছেন সেটি মুখ্য বিষয় নয়। বরং আপনি কখন কখন খাচ্ছেন সেটার উপর গুরুত্বারোপ করে। অনেকটা রোজা রাখা বা উপবাসের মতই। আপনি দিনের একটা বড় সময় উপবাস থেকে বাকী সময়টা স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করতে পারবেন।
আবার এমনও নিয়ম আছে যেখানে সপ্তাহে দুই দিন উপবাস করে বাকী ৫ দিন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন। ভয় নেই, যতটা কঠিন শোনাচ্ছে আদতে ততটা না। আপনি বেশি করে পানি, ক্যালরি ছাড়া ড্রিঙ্কস বা পানীয়, চা, কফি পান করতে পারবেন। বড় উপবাস গুলোতে সামান্য ক্যালরি যুক্ত খাবারও গ্রহণ করতে পারবেন। এই খাদ্যাভাসের কয়েকটি নিয়মের মধ্যে কোনটি আপনার জীবনে ভালো খাপ খাবে সেটি আপনি নির্ধারণ করবেন!
এটি কিভাবে কাজ করে?
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি নিয়ম হলো ১৬:৮ এবং ৫:২। ১৬:৮ হলো ১৬ ঘন্টা উপবাস ও ৮ ঘন্টা স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ। অন্যদিকে ৫:২ হলো সপ্তাহে ২ দিন মাঝারি আকারের খাবার (৫০০-৬০০ ক্যালরি) গ্রহণ করতে পারবেন। সব নিয়মেই প্রচুর পানি পান করতে হবে।
আমরা যা খাই সেটি ভেঙে আমাদের রক্তে যায়। রক্তের থেকে দেহের প্রতিটি কোষে শক্তি যায়। শর্করা জাতীয় খাবার খুব দ্রুত ভেঙে যায় ও গ্লুকোজ আমাদের শরীরে শক্তি যোগায়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার গ্রহণে অতিরিক্ত শক্তি দেহে চর্বি হিসেবে জমা করে। এই প্রক্রিয়া একমাত্র সম্পন্ন হয় ইনসুলিন এর মাধ্যমে। যদি আপনি দীর্ঘসময় উপবাস থাকেন তবে দেহের ইনসুলিন এর মাত্র কমে যায়, যার ফলে জমে থাকা চর্বি ভাঙতে শুরু করে!
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর উপকারী দিকগুলি কি কি?
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর বিস্তারিততে যাবার আগে চলুন উপকার গুলো জেনে নেই। খাবার ঝামেলা কম হলে দৈনন্দিন জীবন সহজ হবে, কাজে আরো মন দিতে পারবেন, অর্থ সাশ্রয় হবে ইত্যাদি জাগতিক সুবিধা তো পাবেনই সাথে শারীরিক দিক থেকেও বেশ অনেক উপকার পাবেন।
-
রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকবে।
-
রক্তে ইনসুলিন হ্রাস করবে। যা দেহের চর্বি ভাঙতে সাহায্য করবে।
-
রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে।
-
ওজন বৃদ্ধি বন্ধ হবে।
-
অতিরিক্ত ওজনের সাথে সম্পর্কিত সকল রোগ প্রতিরোধ করবে।
-
দীর্ঘ জীবন লাভে সহায়তা করবে।
-
হিউম্যান গ্রোথ হরমোন (Human Growth Hormone বা HGC) বাড়াতে সহায়তা করবে। যা চর্বি ভেঙে পেশি বাড়াতে সহায়তা করবে।
-
সর্বোপরি সহজে ওজন হ্রাস করবে।
আপনি কিভাবে শুরু করবেন?
বেশিরভাগ সুস্থ মানুষের জন্য ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং উপকারী। তবে আপনি যদি ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর কোন একটি অভ্যাস রপ্ত করতে চান তবে সর্বপ্রথম আপনাকে আপনার ব্যক্তিগত চাহিদা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। অর্থাৎ আপনি কি চান? ওজন কমানো আপনার উদ্দেশ্য নাকি স্বাস্থ্যকর জীবন? আপনার দৈনন্দিন রুটিনের সাথে কোন নিয়মটি সুবিধা জনক? ইত্যাদি বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তবেই একটি নিয়ম গ্রহণ করা উচিত। তবে অবশ্যই শুরু করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
কোন পদ্ধতি আমার জন্য ভাল হবে?
স্বাস্থ্যের দিক খেয়াল রেখে উপবাস করার সময় কোনও ব্যক্তি চারটি সম্ভাব্য পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। আপনার এমন পরিকল্পনা বেছে নেওয়া উচিত যা আপনার পছন্দগুলির সাথে খাপ খায় এবং আপনি তা দীর্ঘদিন করতে পারবেন।
পদ্ধতিগুলি হচ্ছে -
-
খান, উপোস থাকুন, আবার খান ( Eat stop Eat)
-
ওয়ারিয়র ডায়েট (Warrior Diet)
-
লিঙ্গাইনস (Leangains)
-
অল্টারনেট ডে ফাস্টিং (Alternate Day Fasting)
মাথায় রাখবেন, কি খাবেন কতটুকু খাবেন যদিও তা ধরা-বাঁধা নেই, তারপরও পুষ্টি গুন সম্পন্ন স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা আপনার জন্য সুফলই বয়ে আনবে। যে সময়টাতে খাবেন তাতে বেশি খেয়ে উপসের সময়ের না খেয়ে থাকা উসুল করতে যাবেন না। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই খাবেন। আসুন এবার পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে কার্যকরী ডায়েট!
খান, উপোস থাকুন, আবার খান ( Eat stop Eat) বা ২৪ ঘন্টার ডায়েট
ব্র্যাড পাইলন (Brad Pilon) নামক এক ব্যক্তি এই ডায়েট প্লান তৈরি করেন, যেখানে ২৪ ঘন্টার উপোস সপ্তাহে দুই বার করতে হয়। অর্থাৎ, আপনি সপ্তাহের যে কোন ২ দিন টানা ২৪ ঘন্টা না খেয়ে থাকবেন, তবে পরপর ২ দিন নয়। তবে প্রচুর পরিমান পানি ও ক্যালরি বিহীন পানীয় পান করতে পারবেন। যারা আগে কখনো এরূপ দীর্ঘসময় উপোস করেন নি, প্রথম প্রথম তাদের এটি থেকে বিরত থাকা উচিত।
ওয়ারিয়র ডায়েট (Warrior Diet) বা ২০:৪ ঘন্টার ডায়েট
এই ডায়েটেও Eat stop eat ডায়েটের মত দীর্ঘসময় উপোস থাকতে হয়। ওরি হফমেকলার (Ori Hofmekler) নামক ব্যক্তি এটি উদ্ভাবন করেন। এখানে আপনি ২০ ঘন্টা উপোস করে বাকী চার ঘন্টা স্বাভাবিক খাবার খেতে পারবেন। যারা নতুন শুরু করার কথা ভাবছেন তাদের জন্য এটি উপযোগী নয়।
লিঙ্গেইনস (Leangains) বা ১৬:৮ ঘন্টার ডায়েট
ইন্টারমিটেন্ড ফাস্টিং এর সবচাইতে জনপ্রিয় ও সুবিধা জনক নিয়ম হলো ১৬:৮ ডায়েট প্লান। মার্টিন বারখান (Martin Berkhan) নামক ব্যক্তি এটির উদ্ভাবক। এতে ১৬ ঘন্টা উপোস ও ৮ ঘন্টা স্বাভাবিক খাবার খাওয়ার নিয়ম। যদি আপনি তিন বেলার একবেলা খাবার না খান তবেই ১৬:৮ ডায়েট প্লান ফলো করা হয়ে যায়। তবে সুবিধা জনক হলো মধ্যাহ্নভোজন বাদ দেওয়া। এতে করে কর্ম ক্ষেত্রে দুপুরের খাবার নিয়েও ঝামেলায় পড়তে হয় না।
হ্যাঁ মানছি, যত সহজে বলছি আদতে ততটা সহজ নয়। প্রথম দিকে কষ্ট হবে, তবে আস্তে আস্তে শরীর মানিয়ে নেওয়া শুরু করবে। প্রথম দিকে ১২-১৩ ঘন্টার উপোস দিয়ে শুরু করবেন। এটি খুব সম্ভবত কঠিন হবে না। উপোসের মাঝে পানি পানে কোনো বাঁধা নেই। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সব মুসলিমই রোজা রেখে অভ্যস্ত। অন্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও উপোস করার রেওয়াজ রয়েছে। এই সময় আস্তে আস্তে বাড়িয়ে ১৬ ঘন্টায় আনতে হবে। নারীদের ১৪ ঘন্টা উপোস করার করার পরামর্শ দেন কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ।
এই ডায়েট প্লানটি এতই কার্যকর যে হলিউডের অনেক বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী সুস্বাস্থ্যের জন্য এই ডায়েট প্লান ফলো করেন।
অল্টারনেট ডে ফাস্টিং (Alternate Day Fasting) বা ৫:২ দিনের ডায়েট
অল্টারনেট ডে ফাস্টিং ৫ঃ২ ডায়েট নামেও পরিচিত। এই ডায়েটটি ব্যাখ্যা করা খুব সহজ।
প্রতি সপ্তাহের যেকোন পাঁচ দিন, আপনার সাধারণত খাওয়া এবং ক্যালোরি সীমাবদ্ধ করার বিষয়ে ভাবতে হবে না।
কিন্তু অন্য দু'দিনে, আপনার ক্যালোরির পরিমাণ কমিয়ে প্রতিদিনের প্রয়োজনের এক চতুর্থাংশ করে ফেলতে হবে। এটি মহিলাদের জন্য প্রতিদিন ৫০০ ক্যালরি এবং পুরুষদের জন্য ৬০০ ক্যালরি।
তবে খেয়াল রাখবেন টানা ২ দিন যেন না হয়।
মনে রাখবেন, যেকোনো ডায়েট প্লান গ্রহণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ বাঞ্ছনীয়।
ডায়েট নাকি ব্যায়াম, ওজন কমাতে কোনটি বেশি কার্যকরী?
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর পার্শপ্রতিক্রিয়া
একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জন্য খুব সামান্য পার্শপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। প্রথম দিকে মাথা ঘোরা, মন্থর ও কাজে অমনোযোগ এর মত সমস্যা হতে পারে। তবে আস্তে আস্তে মানিয়ে যাবে।
তবে, যাদের শারীরিক সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে ডায়েট শুরু করার আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত। কারণ তাদের জন্য তা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিছু ক্ষেত্রে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং থেকে বিরত থাকা উচিত,
-
গর্ভবতী নারী
-
স্তন্যদাত্রী নারী
-
যারা অন্তঃসত্ত্বা হবার চেষ্টায় আছেন
-
ডায়বেটিস রোগী
-
নিম্ন রক্তচাপের রোগী
-
স্বাভাবিকের চেয়ে যাদের ওজন কম
এমন নয় যে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং সবার জন্য উপযোগী হবে। এটি আপনার লাইফস্টাইলের সাথে খাপ নাও খেতে পারে। তবে হতাশ হবার কিছু নেই, আরো অসংখ্য ডায়েট প্লান আছে যা আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করবে।
সুস্বাস্থ্য আমাদের সকলের প্রত্যাশা। বেশিরভাগ সুস্থ মানুষই অনুধাবন করেন না যে, সুখ ও শান্তি সব এই দেহের মাঝেই নিহিত। তাই স্বাস্থ্য হারাবার আগেই থেকে সচেতন হউন। আপনার সুস্থ সুন্দর আগামী দিনের যাত্রায় সুস্বাস্থ্য অবশ্যই কাম্য।