আপনার তোয়ালেটি জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়ার আঁতুড়ঘর নাতো?

তোয়ালের মাধ্যমে কিভাবে রোগ ছড়ায়? কোন কোন জীবাণু তোয়ালের মধ্যে থাকে? তোয়ালে কিভাবে জীবাণুমুক্ত রাখব? তোয়ালে পরিষ্কার করার নিয়ম কী?

রান্নাঘর থেকে বাথরুম প্রায় সবখানেই আমরা তোয়ালে ব্যাবহার করে থাকি, কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছি এই তোয়ালে যে কোনো মুহূর্তে আপনার অসুস্থতার কারণ হতে পারে। আসলে আমরা এই ব্যপারটা ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করি না, খুব সহজেই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আমাদের ব্যবহৃত নোংরা তোয়ালেতে থাকে বিভিন্ন ধরণের জীবাণু, এমনকি আপাতত দৃষ্টিতে আপনার চোখে নোংরা না এমন তোয়ালেও ছড়াতে পারে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ। 

 

তোয়ালের মাধ্যমে কিভাবে রোগ ছড়ায়?

বিশেষজ্ঞরা অভিহিত করেছেন, “আপনি আপনার তোয়ালেগুলিকে ১০০% জীবাণু মুক্ত রাখতে পারবেন না, তবে আপনি চাইলে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণকে সীমাবদ্ধ করতে পারবেন এবং একটা মাত্র উপায় হলো ব্যাবহার করা তোয়ালে আগের থেকে বেশী বেশী ধৌত করা।” 

আমাদের তোয়ালে গুলোকে ব্যাকটিরিয়ার কারখানা বলা যায় যেখানে ব্যাকটেরিয়া ফাঁদ পেতে বসে থাকে মরণ কামড় দেওয়ার জন্য। কারণ প্রতিবার আপনি তোয়ালে ব্যবহার করার পর আপনার ত্বকের ব্যাকটেরিয়া এবং আপনার মাধ্যমে বহনকারী অন্য কোনও জীবাণু সেই তোয়ালের পৃষ্ঠের উপরে স্থানান্তর হয়। যদিও যেই জীবাণুগুলি আপনার কাছ থেকে এসেছে সেগুলোর বেশিরভাগই স্বাস্থ্যের উপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব তৈরী করে না, কিন্তু একটা মাত্র খারাপ জীবাণু আপনাকে অথবা আপনার পরিবারের কাউকে ঠেলে দিতে পারে মৃত্যুর দিকে।

আমাদের ব্যাবহার করা তোয়ালেগুলি সাধারণত ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য অণুজীবের বৃদ্ধির জন্য নিখুঁত একটি পরিবেশ দিয়ে থাকে কারণ আমরা প্রায়শই তোয়ালেগুলিকে স্যাঁতসেঁতে, উষ্ণ অবস্থায় অন্ধকার বাথরুমে ঝুলিয়ে রাখি যা ব্যাকটেরিয়াদের জন্য একটি উপযুক্ত স্থান। আর তাছাড়া আপনার হাত একটি উপযুক্ত মাধ্যম যার মাধ্যম্যে ব্যাকটেরিয়া আপনার ব্যাবহার করা তোয়ালেতে স্থানান্তর হয়। আপনি এই হাতদিয়ে সারাদিনে যা কিছুই স্পর্শ করেছেন সেখান থেকে ব্যাকটেরিয়া আসে আপনার হাতে তারপর আপনি নিজ দায়িত্বে সেটা স্থানান্তর করে দেন আপনার তোয়ালেতে, আর তারা সেখানে করতে থাকে বংশবিস্তার। 

 

তোয়ালে সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য

অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অণুজীব বিশেষজ্ঞ, চার্লস গারবা এক গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন যে, “গবেষনা করা প্রায় ৯০% বাথরুম তোয়ালে কলিফর্ম ব্যাকটিরিয়া এবং প্রায় ১৪% তোয়ালে ইকোলাই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত ছিল।” তিনি আরও বলেছেন, “আমরা আমাদের হাত দিয়ে মলদ্বারে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া যেমন কলিফর্ম ব্যাকটিরিয়া, সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া স্পর্শ করে থাকি যেটা পরবর্তীতে পানির মাধ্যমে রোগ ছড়াতে পারে।” তিনি তার গবেষণায় আরো পেয়েছেন যে, আমাদের ব্যাবহার করা তোয়ালে গুলো সপ্তাহে কতবার ধৌত করা হয় তার উপর এইসব ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা নির্ভর করে, অর্থাৎ যারা তোয়ালে সপ্তাহে ৩-৪ বার ধৌত করেন তাদের থেকে যারা তোয়ালে সপ্তাহে ১-২ বার ধৌত করেন তাদের তোয়ালেতে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ থাকবে বেশী। 

চার্লস গারবা আরও বলেন, “আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা নিজের হাত পুরোপুরি ধৌত করেন না, তাই যখন তারা তোয়ালেতে হাত শুকান তখন তারা নিজের অজান্তেই ব্যাকটেরিয়াকে তোয়ালেতে ঘষছেন এবং তোয়ালেকেও বানিয়ে দিচ্ছেন সেইসব ব্যাকটেরিয়ার জন্য উপযুক্ত আবাসস্থল।” তার ভাষ্য মতে, প্রায় দুই দিন পরে, আপনি যদি এমন কোনও হাতের তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে থাকেন তাহলে আপনি আপনার টয়লেটে মাথা আটকে রেখে ফ্লাশ করে দেওয়ার চেয়ে বেশী ইকোলাই ব্যাকটেরিয়া আপনার মুখে পেয়ে যাবেন। 

এমনকি আমাদের বাড়ির বাইরেও তোয়ালেগুলি সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে। নিউইয়র্ক প্রেসবিটারিয়ান এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার  এর ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজির ডাইরেক্টর সুসান হুইটার এর মতে, “স্যাঁতস্যাঁতে বা আর্দ্র তোয়ালেগুলো হলো এমআরএসএ (MRSA) প্রদাহ সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়ার বংশবিস্তারের জন্য একটি উপযুক্ত স্থান”। এই ধরণের প্রদাহ সাধারণত এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী স্টাফিলোকক্কাস অরিয়াস ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়ে থাকে, কিছু মানুষ এই ব্যাক্টেরিয়াকে তাদের ত্বক অথবা নাকের মাধ্যমে বহন করে থাকে কোনো রকম রোগের লক্ষন প্রকাশ করা ছাড়াই। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে সেসব মানুষ থেকে পরবর্তীতে এই ব্যাকটেরিয়া অন্যের দেহে প্রদাহ সৃষ্টি করে থাকে। একটা সংঘ হতে পারে সেটা কোনো ক্রিকেট অথবা ফুটবল দল যেখানে সদস্যরা ঘনঘন একে অপরের সংস্পর্শে আসে এবং একই জিনিস অনেকে ভাগ করে তাদের মধ্যে এই প্রদাহ খুব বেশী দেখা দেয়। 

২০০৩ সালে এমআরএসএ (MRSA) প্রদাহের প্রাদুর্ভাব দেখা যাওয়ার পর লস এঞ্জেলস কলেজ গুলোর ফুটবল দলের উপর একটি গবেষনা চালানো হয়েছিলো, তারপর সেখানে দেখা গিয়েছিলো তোয়ালে ভাগ করে ব্যাবহার করার জন্য খেলোয়াড়দের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ হয়েছিলো যা অনেকের ক্ষেত্রে খুবই মারাত্মক ছিলো। 

সুসান হুইটার এটাও বলেছেন, “আপনি শুধু মাত্র তোয়াল ব্যাবহারের মাধ্যমে যে অসুস্থ হয়ে যাবেন এমনটা না, কিন্তু যদি আপনার শরীরে কোথাও কেটে যায় অথবা চোট লেগে কোথাও ক্ষয় হয় (সাধারণত খেলোয়াড়দের বেশী দেখা যায়) অথবা শুষ্ক ত্বক যার মাধ্যমে জীবাণু আপনার রক্তে যেতে পারে তখনই আপনি ঝুঁকির মধ্যে পরে যেতে পারেন, এমনকি এই ছোট অনুজীব আপনার মৃত্যু ডেকে আনতেও পারে”।

 

আমাদের করণীয়

এই অবস্থা থেকে নিজেকে রক্ষার সর্বোত্তম উপায় হ'ল প্রায়শই রান্নাঘর এবং বাথরুমের তোয়ালে ধৌত করা এবং অবশ্যই সপ্তাহে ব্যাবহারের দুইদিন পরপর তোয়ালে ধুয়ে নেওয়া উচিত। অণুজীব বিশেষজ্ঞ, চার্লস গারবা এর মতে, যদি আপনার বাড়িতে ছোট বাচ্চা থাকে তাহলে অবশ্যই আপনাকে সপ্তাহে কমপক্ষে ৩ বার তোয়ালে ধৌত করতে হবে এবং শুধু ধৌত করলেই হবে না সেটাকে করতে হবে ব্যাকটেরিয়া মুক্ত। চার্লস গারবা এর ভাষ্য মতে, কিছুকিছু ব্যাকটিরিয়া ডিটারজেন্ট থেকেও বাঁচতে পারে, তাই অবশ্যই তোয়ালেগুলি ভালভাবে পরিষ্কার করতে হলে গরম পানি এবং ব্লিচিং পাউডার ব্যাবহার করতে হবে।  

সুসান হুইটার এই ব্যাপারে বলেছেন, যদি আপনার ব্যাবহার করা তোয়ালে ব্যাবহারের মধ্যেই শুকিয়ে যায় তাহলে ব্যাকটেরিয়া স্থানান্তর হওয়ার সম্ভবনা কম থাকে, তাই তোয়ালে কোনো ভাবেই ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে বা আর্দ্র অবস্থায় ফেলে রাখা যাবে না, এতে সংক্রমণ বেশী হয়। 

 

তোয়ালে পরিষ্কার করার নিয়ম

নিয়মিত পরিষ্কার না করলে যেমন তোয়ালে থেকে একধরনের ভ্যাপসা দুর্গন্ধ পাওয়া যায় ঠিক তেমনি আপনি যদি শুধু মাত্র ডিটারজেন্ট দিয়ে তোয়ালে বারবার ধৌত করেন তাহলে শক্ত ও ধারালো হয়ে যায়। তাই তোয়ালে পরিষ্কার করতে হবে একটু ভিন্ন ভাবে। 

প্রথমে গরম পানিতে ১ কাপ সাদা ভিনেগার ভালোমতো মিশিয়ে আপনার তোয়ালে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন তারপর সেখান থেকে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন। আবারও বালতিতে গরম পানি নিয়ে এবার আধা কাপ বেকিং সোডা ভালোমতো মিশিয়ে তোয়ালে ডুবিয়ে রাখুন। ২০ মিনিট পর ভালো করে নিংড়ে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নিন। এতে করে আপনার তোয়ালেরও কোনো ক্ষতি হবে না, তোয়ালেও পাবেন দুর্গন্ধ মুক্ত।

 

শেষ কথা হলো, যদি আপনি নিয়মিত সর্বোত্তম পরিষ্কার থাকতে চান তাহলে আপনার হাত এবং তোয়ালে দুটোই পরিষ্কার রাখতে হবে, বিশেষজ্ঞদের মতে এই অভ্যাস আপনাকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।


 

Default user image

মোঃ ইকবাল হোসেন নয়ন, লেখক, আস্থা লাইফ

লিখতে পছন্দ করেন। সাধারণত তিনি তার কল্পনা থেকে কবিতা, রম্যরচনা এবং বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলি সম্পর্কে লেখালেখি করে থাকেন। তার পছন্দের একটি কাজ ব্লগে লেখা এবং অতীতে তার লেখা কিছু অনলাইন ভিত্তিক ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয়েছে। তিনি এখন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এর ফার্মাসি বিভাগে স্নাতকোত্তর এ অধ্যয়নরত আছেন। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার স্নাতক শেষ করেছেন। ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত লেখায় তাঁর আগ্রহ এখন প্রবল। তিনি অবসর সময়ে গান শুনতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন। সাধারণত লেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ বই এবং ব্লগ পড়া থেকে আসে। তাঁর প্রিয় বইগুলির মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনী, কিছু কবিতার বই এবং সায়েন্সফিকশন যা তাকে তাঁর কল্পনার জগতে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। লেখালেখি করার জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো সোশ্যাল সাইটগুলি, যেখানে সে নিজের লেখা লিখতে পারে।

Related Articles