রমজান কি ওজন কমানোর সঠিক সময়?
অনেকের মনে হতে পারে ওজন কমানোর জন্য পবিত্র রমজান মাসটি একটা আদর্শ সময় হতে পারে। কিন্তু আসলে কিন্তু তা নয়! সামাজিক ও অভ্যাসগত কারণে এটি সত্যিসত্যি করতে পারা অনেক ক্ষেত্রেই অন্য সময়ের চেয়েও কঠিন হতে পারে। তবে সঠিক উপায়ে ও সঠিক মনোভাবের সাথে যদি চেষ্টা করেন তাহলে এই ওজন কমানো সম্ভব হতে পারে। তাছাড়াও কিছু ধর্মিয় বিষয় এই ওজন কমানোর সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
অতিরিক্ত ওজন যেমন আপনার শরীরের জটিল রোগ সৃষ্টির কারণ হতে পারে, সেই সাথে আপনার স্বাভাবিক দৈহিক সৌন্দর্যের জন্যও একটি সমস্যা। যদিও সৌন্দর্য বর্তমানের কথিত বিউটি স্টান্ডার্ড এর মত সংকীর্ণ নয়, তবুও বোধ করি বেশিরভাগ মানুষের কাছে সেটাই কাম্য। তবে আপনার উদ্দেশ্য স্বাস্থ্য কিংবা সৌন্দর্য যাই হোক না কেন, ওজন কমানো অত্যন্ত শারিরীক, মানসিক পরিশ্রম সাধ্য ও এর জন্য বেশ ধৈর্যের প্রয়োজন। তবে আপনি কি রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে ওজন কমাতে পারেন? এতে হয়ত ওজন কমানোর সংযম একটি ভালো কাজেও লাগানো হবে! আসুন প্রথমেই এর কিছু ভালো-খারাপ দিক গুলো জেনে নেই।
ওজন কমাতে গিয়ে রোজার মাহাত্ম কমিয়ে ফেলবেন না তো?
রোজার উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহ তালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকা। এটি তো শুধু খাবারেই সীমাবদ্ধ নয়, সওম আমাদের সংযত হতে শেখায়, মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করতে শেখায়, ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে মহোত্তর আধ্যাত্ম অর্জন করতে শেখায়। তবে রোজায় যদি ওজন কমিয়ে ফেলতে চান তবে সেটা কি ভুল হবে?
রোজার উদ্দেশ্য সর্বদাই সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন, এবং যদি অন্য কোন লক্ষ্য নির্ধারণ করার ফলে যদি সেই সন্তুষ্টি অর্জনের মূল লক্ষ থেকে বিচ্যুত হয়ে যান, বা বড় হয়ে ওঠে তবে সেটি আসলেও রোজার মহাত্মকে কমিয়ে দেয়। তবে সৃষ্টিকর্তার প্রতি একাগ্র থেকে, আরো একটু সংযমের সাথে জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে আপনি ওজন কমিয়ে আনতে পারেন।
তবে এটা প্রথমেই জানিয়ে দেই যে, শুধু রোজার কারণে আপনার ওজন কমবে না। ওজন কমাতে বাড়তি কিছু কাজ করতে হবে। তবে অবশ্যই রোজা রাখার বিষয়টি ওজন কমানোর কিছুটা সহজ করে দেবে।
শুধু রোজা রাখা কেন ওজন কমায় না?
ওজন কমানোর মূল ভিত্তিটা হলো, যতটুকু ক্যালরি প্রয়োজন তার চেয়ে কম ক্যালরি গ্রহণ করা। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক ২০০০+ ক্যালরির প্রয়োজন হয়। এখন একটু রোজার দিকে লক্ষ্য করুন। রোজা রাখার সময়ও আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনবেলা খাবার গ্রহণ করি। সেহরি, ইফতার ও রাতের খাবার। এই তিনবেলা মিলিয়ে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় ক্যালরির সিংহভাগ গ্রহণ করি। মাঝে মাঝে কিছু নাস্তা ও বাড়তি খাবার বাকী ক্ষুদ্রাংশ পূরণ করে।
এখন যদি রমজানে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের দিকে একটু খেয়াল করেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন কেন এ সময় আমাদের ওজন কমে না।
সেহরীতে বেশিরভাগ মানুষ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি খেয়ে থাকেন। অন্যদিকে ইফতারিতে ভাজাপোড়া সহ অন্যান্য হাই ক্যালরি খারার থাকে, সেখানেও পেট পুরে খাওয়াটাই আমাদের দেশে স্বাভাবিক। আবার রাতের খাবার তো আছেই। অর্থাৎ আপনি যদি সতর্ক না থাকেন, রমজানেরর এই মাসে আপনি ওজন কমানোর চেয়ে উল্টো বাড়িয়ে ফেলতে পারেন।
রমজানে ওজন কমানো কেন কঠিন?
সূর্যের পূর্ব দিকে ওঠার মতই, না খেলে ক্ষুধা লাগবে এ কথাও সত্য। ক্ষুধা হলো আমাদের শরীরের একটা সংকেত, যে শরীরের শক্তি উৎপাদনের যথেষ্ট রসদ অর্থাৎ খাদ্য নেই। যদিও ক্ষুধা লাগা মানেই যে শরীরের সব জ্বালানী ফুরিয়ে গেছে তা না, বরং জ্বালানী শেষের দিকে বলা যায়। মোটামুটি ১২-১৪ ঘন্টা না খেয়ে থাকলে আমাদের শরীর পূর্বে যা খেয়েছিলো তা খরচ করে ফেলে। তবে প্রাথমিক জ্বালানী ফুরিয়ে গেলেই আপনার শরীর বন্ধ হয়ে যাবে না। শরীর দেহের বিভিন্ন অংশে ফ্যাট আকারে শক্তি জমিয়ে রাখে, এবং প্রাথমিক শক্তির উৎস ফুরিয়ে এলে সেই ফ্যাট ভাঙতে শুরু করে। অর্থাৎ ১২-১৪ ঘন্টা না খেয়ে থাকলে আমাদের শরীরের চর্বি ভাঙতে শুরু করে। দীর্ঘ সময় না খেয়ে ওজন কমাতে চাইলে ১৪ ঘন্টার অধিক সময় আহার থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু রোজার ক্ষেত্রে দেখুন, আমারা ১৪-১৫ ঘন্টাই আহার বিরত থাকছি। অর্থাৎ এতে করে খুব একটা বেশি লাভ হচ্ছে না।
ওজন কমানোর আরেকটি উপায় হলো দৈনিক ক্যালরি চাহিদার কম ক্যালরি গ্রহণ করা। এতে করে দেহের ক্যালরির চাহিদা পূরণ করতে ফ্যাট ভাঙতে শুরু করে। এটিই ওজন কমানোর সবচেয়ে প্রচলিত ও সহজসাধ্য উপায়। কিন্তু সমস্যা হলো, রোজায় দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকার ফলে দেহের মেটাবলিজম অর্থাৎ খাদ্য থেকে পুষ্টি সংগ্রহের প্রক্রিয়া বেশি কার্যকরি হয়ে ওঠে। যার জন্য যেকোন খাবার ভালোভাবে শোষিত হয় ও ক্যালরির চাহিদা এতে পূরণ হয়ে গিয়ে, ওজন কমানো কঠিন হয়ে যায়।
ওজন কমানোর সহজতর উপায় দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা নয়, বরং অনেকটা দেহের সাথে ছলনা করে কম ক্যালরি যুক্ত খাবার গ্রহণ, ও এমন ভাবে খাবারের শিডিউল তৈরি করা, যাতে খাবারের চাহিদা কমে ও কম ক্যালরি যুক্ত খাবার গ্রহণের পরও ক্ষুধায় হাপিত্তেশ না করা লাগে। তবে কি ওজন কমানোর চিন্তা এখন বাদ দেবেন? অবশ্যই না। অল্প কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে আপনি সহজেই কিছুটা ওজন কমিয়ে ফেলতে পারেন। তার চেয়েও বড় কথা রোজার মাধ্যমে আপনি ওজন কমানোর চেয়েও মূল্যবান যা শিখতে পারেন তা হলো, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণ যা পরবর্তিতে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও প্রয়োজনে কমাতে সাহায্য করবে। চলুন এবার মূল অংশটিতে আসা যাক।
রোজায় ওজন কমাতে করণীয়
রোজায় ওজন কমাতে ও একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস গড়ে তুলতে নিচের পয়েন্ট গুলো খেয়াল করুন।
বদঅভ্যাস পরিবর্তনের আদর্শ সময়
প্রথমেই আপনাকে চিহ্ণিত করতে হবে আপনি কি কারণে মুটিয়ে যাচ্ছেন? আপনি কি সবসময় এটা-ওটা স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার খেতে থাকেন? নাকি অতিরিক্ত ফাস্টফুড খান? বা খুব বেশি শুয়ে থাকেন? রোজা হতে পারে সেই বদ অভ্যাস গুলো পরিত্যাগের আদর্শ সময়। রোজার সময় আপনি যেমন সারাদিন এটা ওটা খাই-খাই করতে পারছেন না। ইফতারির পর সেটা পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করবেন না। এতে করে যেমন রোজার বাইরেও সংযম অনুশীলন হবে সেই সাথে পুনরায় ওজন বেড়ে যাওয়ার সমস্যাটাও সমাধান হবে। ওজন কমানোর প্রথম ধাপটা হলো ওজন যেন না বাড়ে সেটা খেয়াল করা। এরপর আসে ওজন কমানোর প্রশ্ন!
ভালো অভ্যাস গড়ে তুলুন
যেকোন অভ্যাস পরিত্যাগ করলে অন্য একটি অভ্যাস তার জায়গা দখল করবে। তাই চেষ্টা করুন ত্যাগ করা অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস গুলো ভালো অভ্যাস দিয়ে পরিবর্তন করতে। শুয়ে বসে না থেকে হালকা ব্যায়াম করুন, সকালে বা বিকেলে হাটতে বের হন। বাইরে ফাস্টফুড না খেয়ে মানুষকে সহায়তা করুন। শরিরীক আরাম আয়েস কমিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সময় ব্যয় করুন। মানসিক প্রশান্তি অর্জন করবেন।
ব্যায়াম করুন, কিন্তু একটু বুদ্ধি করে
খুব ব্যায়াম করে প্রচুর ওজন কমিয়ে ফেলার জন্য রোজার সময়টা আদর্শ না। কিন্তু একটু বুদ্ধি করে ব্যায়াম করলে ওজন কমানো সহজ হতে পারে। দিনের ঠান্ডা সময়টা অর্থাৎ সকালে ও বিকালে ব্যায়াম করুন, রোদের ভেতর শারিরীক পরিশ্রম পরিহার করুন। এতে ডিহাইড্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভারী ব্যায়ামের জন্য প্রয়োজনে ইফতারের পর ৩০ মিনিট ব্যায় করতে পারেন। এতে ডিহাইড্রেটেড হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
ওজন কমাতে রোজার খাবার
ওজন কমাতে রোজার সময় ঠিক কি খাবেন? প্রথমত, অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। সেহেরিতে এমন খবার পরিমিত খাবেন যা অনেক সময় ধরে আপনাকে স্বাভাবিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে সহায়তা করবে। ভাত আসলে খুবই সরল কার্বহাইড্রেট যা দ্রুত খরচ হয়ে যায়। জটিল শর্করা যেমন মোটা আটা, ওট ইত্যাদি খেতে পারেন যা অধিক সময় ধরে খরচ হয়। সেই সাথে ভালো মানের প্রটিন যেমন ডিম, দুধ, বাদাম ইত্যাদি রাখতে পারেন আপনার দৈনিক সেহরীর খাবারে।
ইফতারেও খাবারের উপর হামলে পড়বেন না। ধীরে ধীরে খাবেন। মুখের খাবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্লেটের খাবার ছুঁবেন না। চামচ থাকলে তা হাত থেকে রেখে দিন। এভাবে ধীরে খেলে অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকবে না। ইফতারেও ভাজাপোড়া এড়িয়ে চলে পুষ্টিকর ও শক্তিদায়ক খাবার গ্রহণ করার চেষ্টা করুন।
যদিও কেউ খাবার খেতে দিলে স্বানন্দে তা গ্রহণ করবেন, ও সুযোগ পেলে আপনার খাবার ভাগ করার ভেতরই সওমের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।
কম খাবেন তবে দৈনিক ১২০০ ক্যালরির নিচে নামবেন না। দীর্ঘ সময় না খাওয়া ও যথাসাধ্য কম ক্যালরি গ্রহণ করা, আর শারিরীক ব্যায়াম। এই বিষয়গুলিই রমজানে আপনাকে বেশ কিছুটা ওজন কমিয়ে ফেলতে সাহায্য করবে।
শেষ কথা
যদি আপনি রোজা রেখেও এই পরামর্শ গুলো মেনে ওজন কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হতে পারেন, ব্যাপারটি সত্যিকার অর্থেই অভাবনীয় ও চমকপ্রদ। আপনি সৃষ্টিকর্তার নৈকট্যের সাথে সাথে নিজের শরীরের উপরও নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছেন। আপনি অনেকগুলো ভালো অভ্যাস গড়ে তুলেছেন, খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করেছেন, খাদ্যের উপরও আপনার নিয়ন্ত্রণ তৈরি হয়েছে। আপনি সংযমে বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক গুণ। এর পরেই আপনি এই সাফল্য পেয়েছেন (বা পাবেন)। কিন্তু খেয়াল রাখবেন যেন রমযানের শেষে এই দীর্ঘ প্রচেষ্টা বিফলে না যায়। স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গুলো রোজার পরোও ধরে রাখার ভেতরই আসল স্বার্থকতা।