যেখানে সেখানে থুতু ফেলছেনঃ জেনে নিন কি কি রোগ ছড়াতে পারে?
আমাদের মুখে কেন থুতু আসে? থুতু নিয়ে আমাদের ভাবনা কেমন? থুতু কিভাবে রোগ ছড়ায়? আমাদের কিভাবে থুতু ফেলা উচিৎ? এর ভয়ংকর দিক কি কি?
থুতু ফেলা একটি অস্বাস্থ্যকর অশোভন সামাজিক অভ্যাস। রাস্তা ঘাটে চলতে গিয়ে আমাদের মধ্যে অনেকেই এই কাজটি করে থাকি। কখনো ভুল করে, কখনো ইচ্ছা করে, কখনো বা অভ্যাসের কারণে। আমাদের দেশের মানুষের এই বাজে অভ্যাসের কারণে রাস্তা গুলো আর হাঁটার যোগ্য থাকে না। যেখানে সেখানে চোখে পড়ে থুতু কিংবা পানেক পিক। দেখতে খারাপ লাগা ছাড়াও থুতু ফেলার যেসব স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রয়েছে, আমি নিশ্চিত সেগুলো ঠিকভাবে জানলে অনেকেই হয়ত এই অভ্যাস থেকে সরে আসবেন।
থুতু বা লালা কী?
আমাদের শরীরে মোট ৩ জোড়া লালাগ্রন্থি থাকে। প্যারোটিড, সাবলিঙ্গুয়াল, সাবম্যান্ডিবুলার। এগুলো থেকেই মুখগহ্বরের জন্য প্রয়োজনীয় লালা নিঃসৃত হয়। আমাদের লালাগ্রন্থি থেকে যে লালা নিঃসৃত হয়, মুখ দিয়ে কিছুটা সেটা বের করে দেয়াই হল থুতু ফেলা। যতক্ষণ লালা মুখগহ্বরের ভিতরে থাকে ততক্ষণ এটা শুধুই লালা। বের করে দেবার পর এটাকেই আমরা থুতু বলি। কখনো কখনো এটা শুধুই একটা শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার, আবার কখনো কখনো এই থুতু ফেলার মাধ্যমেই আমরা রাগ, বিরক্তি কিংবা হতাশা প্রকাশ করি।
থুতু কিভাবে সৃষ্টি হয়?
থুতু বা লালা একটি স্বচ্ছ আঠালো তরল যা আমাদের মুখের ভিতর ২৪ ঘন্টাই তৈরি হয় এবং ক্ষরিত হয়। উপরে উল্লেখিত ৩ টি স্যালিভারি গ্লান্ড বা লালাগ্রন্থি (প্যারোটিড, সাবলিঙ্গুয়াল, সাবম্যান্ডিবুলার) থেকে এটি তৈরি হয়। এর প্রায় ৯৯ শতাংশই পানি এবং বাকিটা জৈব পদার্থ। আমাদের মুখের ভিতরের স্বাস্থ্যবিধি বা পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য এবং খাদ্যদ্রব্য গিলতে সাহায্য করার জন্য লালার গুরুত্ব বলে শেষ করা যায় না। বিভিন্ন খাবারের আলাদা আলাদা স্বাদ বোঝার জন্যও এটি খুব দরকার।
খাদ্য পাকস্থলীতে যাবার আগেই লালায় অবস্থিত এনজাইম খাদ্যকে ভাঙতে শুরু করে এবং এভাবে খাবার পরিপাকের প্রথম ধাপ শুরু হয় মুখ গহ্বরে।
হাইপার স্যালাইভেশন বা মুখে অতিরিক্ত লালা কি?
একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দিনে দেড় লিটার পর্যন্ত লালা বা স্যালাইভা উৎপাদন হতে পারে। এর বেশি স্যালাইভা তৈরি হলে তাকে আমরা হাইপার স্যালাইভেশন বলে থাকি। এটি আলাদা কোনো রোগ নয় বরং অন্য কোনো রোগের উপসর্গ হিসেবে অতিরিক্ত লালা তৈরি হতে পারে বা মুখে অতিরিক্ত লালা জমতে পারে। বাচ্চাদের মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে আমরা অভ্যস্ত কিন্তু একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ এর জন্য সামাজিক ও মানসিকভাবে হেয় হতে পারেন।
মুখে অতিরিক্ত লালা তৈরি হওয়ার কারণ
নানা কারণে মুখে অতিরিক্ত লালা তৈরি হতে পারে। যেমন,
-
অতিরিক্ত টক, অতিরিক্ত মিষ্টি বা অতিরিক্ত গরম খাবার খেলে। এমনকি অনেক সময় আমরা খুব টক ঝাল আচারের কথা চিন্তা করলেও স্নায়ুবিক ক্রিয়ার জন্য মুখে অতিরিক্ত লালা ক্ষরণ হতে পারে।
-
লালাগ্রন্থিতে প্রদাহজনিত কারণে
-
গর্ভাবস্থায় প্রাতঃকালীন অসুস্থতার কারণে
-
সাইনাস অথবা টনসিল সংক্রান্ত কোনো প্রদাহ
-
বিষক্রিয়ার ফলে যেমন বিষাক্ত পোকামাকড়, কীটপতঙ্গের কামড়ে কিংবা বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে
-
মুখে বাঁধানো দাঁত থাকলে
-
দাঁত বা মাড়ির প্রদাহজনিত কারণে
-
মুখগহ্বর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না রাখলে
-
র্যাবিস / যক্ষ্মার মতো মারাত্মক সংক্রমণে
-
মুখের ভিতরে আলসার সংক্রান্ত বা অন্য কোনো ব্যথা থাকলে
-
চোয়ালের হাড়ে কোনো চিড় ধরলে সেক্ষেত্রেও মুখে অতিরিক্ত লালা তৈরি হতে পারে
আবার, তৈরিকৃত লালা যদি ঠিকভাবে অপসারিত না হয় সেক্ষেত্রেও মুখ দিয়ে লালা অপ্রত্যাশিতভাবে বের হয়ে আসতে পারে। জিনগত সমস্যা যেমন ডাউন সিনড্রোম, অটিজমে এই লক্ষণ দেখা যায়। স্ট্রোক, পারকিন্সন্স রোগেও এটা দেখা যায় কখনো কখনো।
থুতু এর সামাজিক দিক
ধূমপানের মত থুতু ফেলাও অনেকটা সামাজিক বদভ্যাস। মানুষ শুধুমাত্র অতিরিক্ত থুতু জমেছে বলে থুতু ফেলে তা কিন্তু নয় বরং অভ্যাসবসত অথবা অন্যের উপর রাগ, বিরক্তি প্রকাশ করার জন্য বা অন্যকে অপমান করার জন্যও থুতু ফেলে। কম বয়স্ক ছেলেমেয়েরা অনেক সময় পছন্দের তারকাকে অনুকরণ করে মাঠে ঘাটে থুতু ফেলে। তাদের এই অভ্যাস জনস্বাস্থ্যের জন্যে মারাত্মক হুমকি হলেও তারা পরোয়া করে না।
থুতু ছিটানোর মনস্তাত্ত্বিক দিক
মুখে অতিরিক্ত থুতু জমা হওয়া একটি শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার হলেও থুতু ফেলার ব্যাপারটা অনেকটাই অভ্যাস কিংবা প্রতিপক্ষকে হেয় করার কাজে ব্যবহৃত হয়। আমাদের গ্রামবাংলার খুব প্রচলিত একটা কথা হচ্ছে, 'তোর মুখে থুক দেই'। কারো উপর রেগে দিয়ে তাকে গালিগালাজ করার জন্য এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হয় না। ইউরোপের লিগ ফুটবল দেখেন অথচ প্রিয় খেলোয়াড়কে মাঠে থুতু ফেলতে দেখেননি এটা হতেই পারে না। কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য থুতু ফেলা হলে মিটমাট করার জন্য রেফারিকেও জড়িয়ে পড়তে হয়।
ইউরোপে উনিশ শতকের আগ পর্যন্ত থুতু ফেলা সামাজিকভাবে স্বীকৃত ছিল। যক্ষ্মা রোগের বিস্তার ঘটার পর থেকে অবস্থা পালটে গেছে। এখন পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রকাশ্যে থুতু ফেলা আইন ভাঙার সামিল।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি
থুতু যেখানে সেখানে ফেলা শুধু দৃষ্টিকটু না, এর স্বাস্থ্য ঝুঁকিও মারাত্মক। যক্ষ্মা, অন্যান্য ফ্লু, নানারকম ভাইরাস যেমন ইপস্টেইন বার ভাইরাস, সাইটোমেগালো ভাইরাস, স্ট্রেপটোকক্কাসের মত ব্যাকটেরিয়া সবই থুতুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে। এমনকি বর্তমানে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসও থুতুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে। তাই যত্রতত্র থুতু ফেলা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে এবং অন্যকেও বিরত রাখার চেষ্টা করা উচিত।
থুতু ছিটানোর ফলে কি কি রোগ হতে পারে?
-
সবচেয়ে বেশি যে রোগটা হতে পারে তা হল যক্ষ্মা। উনিশ শতকে যক্ষ্মার জীবাণু থুতুর মাধ্যমে ছড়ায় এটা সবাই জেনে যাবার পর থেকে থুতু ফেলা একটি সামাজিক ও আইনগত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
-
ইপস্টেইন বার ভাইরাস থেকে হতে পারে মনোনিউক্লিওসিস।
-
শুধু যে থুতু ছিটানোর ফলেই হয় তা নয়, একই খাবার কিংবা পানীয় শেয়ার করলে তাতে লেগে থাকা লালার মাধ্যমেও রোগ ছড়াতে পারে।
-
হারপিস ভাইরাস একটি সংক্রামক ভাইরাস যা মুখে হওয়া কোল্ড সোরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে যদি কোল্ড সোর থেকে ক্ষরণ শুরু হয় সেক্ষেত্রে সংক্রমণের হার বহুগুণ বেড়ে যায়।
-
যে কোন ধরণের ফ্লু।
-
কোভিড ১৯ তথা করোনা ভাইরাস।
রোগগুলো কিভাবে ছড়ায়?
রোগগুলো মূলত আমাদের এখানে সেখানে ফেলা থুতু থেকে ছড়ায়। খোলা জায়গায় ফেলা থুতু শুকিয়ে বাতাসে মিশে যায় ড্রপলেট (কণা) হিসবে। এতে থাকা রোগ জীবাণুও সেইসাথে বাতাসে মিশে যায়। এছাড়া বদ্ধ জায়গায় থুতু ফেললে তা শুকায় না এবং তাতে মশা মাছি বসে। এক্ষেত্রে মশা মাছি বাহক হিসেবে কাজ করে। এই মশা মাছ আমাদের গায়ে বসলে কিংবা খাবারে বসলে রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। আবার অনেক সময় আমরা বন্ধুদের সাথে, পরিবারের সাথে একই খাবার ভাগাভাগি করে খাই। এর ফলেও লালার মাধ্যমে সংক্রমিত হয় এমন রোগ ছড়িয়ে পরে।
থুতু কোথায় ফেলবেন?
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশে রাস্তা ঘাটে এমনকি আবাসিক এলাকা বা অফিস আদালতেও থুতু ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই অনেক সময় বাধ্য হয়ে রাস্তাতেই অনেককে থুতু ফেলতে দেখা যায়। আইন অনুযায়ী পিকদান রাখার কথা হলেও বাস্তবে সেটা দেখা যায় না। রাস্তা ঘাটে থুতু না ফেলার অভ্যাস করাটাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল উপায়। যদি একান্তই ফেলতে হয় তবে সাথে করে পিকদানি অথবা প্লাস্টিকের ডিসপোজেবল ব্যাগ (স্পিট ব্যাগ) বহন করুন। কোনোভাবেই কোনো দেয়ালে কিংবা রাস্তায় থুতু বা পানের পিক ফেলবেন না।
থুতু এবং বাংলাদেশের আইন
বাংলাদেশ শ্রম আইন- ২০০৬ এ 'আবর্জনা বাক্স ও পিকদানি’ শিরোনামে উল্লেখ আছে, 'প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে সুবিধাজনক স্থানে পর্যাপ্ত সংখ্যক আবর্জনা ফেলার বাক্স ও পিকদানি থাকতে হবে এবং সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।' এতে আরো উল্লেখ আছে, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের আঙিনার মধ্যে কেউ বাক্স ও পিকদানি ছাড়া ময়লা বা থুতু ফেলতে পারবেন না।' বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, এই বিধান লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।
এছাড়াও দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে পুলিশ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, প্রকাশ্যে জনসমক্ষে থুতু ফেলার জন্য একশত থেকে তিনশত টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার আইন রয়েছে। আমাদের জনসচেতনতা এবং আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
রাস্তাঘাটে মাঠে ময়দানে থুতু ফেলা আমাদের অনেকেরই বাজে অভ্যাস। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে না হলেও আমাদের এই 'অভ্যাস' আমাদের অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রোগ জীবাণু ছড়ানোর গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে থুতু ফেলা। মুখে প্রয়োজনের অতিরিক্ত থুতু জমা যেমন বিরক্তিকর তেমনি এটা হতে পারে অন্য কোনো বড় রোগের উপসর্গ। তাই অভ্যাসের দোহাই না দিয়ে প্রয়োজনে ডাক্তার দেখান, কোনো রোগ থাকলে তার চিকিৎসা করুন। আর যদি কোনো রোগ না থাকে সেক্ষেত্রে নিজের অভ্যাস বদলান। আমাদের স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাসই পারে সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ গড়তে।