সন্তান নেওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি (পর্ব-৩): গর্ভাবস্থায় লাইফস্টাইল যেমন হওয়া উচিৎ
সন্তান গর্ভে ধারণ করার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন মায়ের মনে থাকে নানারকম প্রশ্ন। গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সহায়ক নিয়ামক থেকে শুরু করে এই সময়ের সুস্থতা নিশ্চিতে করণীয় এমন প্রতিটি ব্যাপারেই মায়ের থাকে জিজ্ঞাসা। ছোট্ট কিছু প্রশ্নের উত্তরেই সহজ, স্বাভাবিক ও ভীতিহীন হয়ে উঠতে পারে একজন নারীর মা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। আসুন জেনে নেই বিস্তারিত।
_গর্ভাবস্থায়_লাইফস্টাইল_যেমন_হওয়া_উচিৎ_jpg_16689565873282.jpg)
সন্তান নেওয়ার আগের প্রস্তুতি প্রথম পর্বে আমারা জেনেছিলাম গর্ভধারণ করার উপযুক্ত সময় কখন? এবং দ্বিতীয় পর্বে আমারা জেনেছিলাম গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের যত্ন কীভাবে নিতে হয়? আর আজ আমরা জানব গর্ভাবস্থায় লাইফস্টাইল কেমন হওয়া উচিৎ?
লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনার ব্যাপারটা একটা সামগ্রিক ব্যাপার। এখানে খাবার ও ঔষুধের পাশাপাশিও পরিধেয়, চলাচল ও অন্যান্য অভ্যাসের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনতে হয়। আসুন জেনে নেই সেগুলি-
পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানোর চেষ্টা করুন
শরীরকে ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই। চেষ্টা করুন এই সময় যথেষ্ট পরিমাণ ঘুমাতে। অনেকেই ভেবে থাকেন যে সন্তান জন্ম নিলে মায়ের ঘুমের সমস্যা বা স্বল্পতা দেখা যায়। বাস্তবে শুধু এই সময়ে নয়, একজন মা গর্ভধারণকালীন সময়েও ঘুমের সমস্যায় ভুগে থাকেন। তাই শুধু রাতে নয়, যখনই সময় পাবেন ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন। শুধু তাই নয়, পর্যাপ্ত ঘুম একজন নারীকে মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকতে ও দ্রুত গর্ভধারণ করতেও সাহায্য করতে পারে।
অ্যালকোহল ও ধুমপান থেকে বিরত থাকুন
মদ্যপান ও ধূমপান দুটোই আপনার শরীরকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। শুধু মাকে নয়, মায়ের গর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুকেও অসুস্থ করে দেয় এই অভ্যাসগুলো জন্ম নেওয়ার আগেই। বিশেষ করে প্রথম টাইমেস্টারে ধূমপান একজন শিশুর জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। যেসব নারী মদ্যপান বা ধূমপান করেন না তাদের তুলনায় যেসব নারী মদ্যপান ও ধূমপান করেন তাদের মধ্যে গর্ভপাতের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
গবেষকদের মতে, শুধু ধূমপান নয়, মদ্যপান একাই গর্ভপাতের সম্ভাবনাকে অনেক এবশি বাড়িয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, এই অভ্যাসগুলো একটি শিশুর মধ্যে ফ্যুটাল অ্যালকোহল সিন্ড্রোম বা এফএএস-ও তৈরি করে।
এই সমস্যার ভুক্তভোগী শিশুরা জন্ম থেকে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঝামেলার মুখোমুখি হয়। শারীরিক বিকলাঙ্গতা থেকে শুরু করে মানসিক সমস্যাও তৈরি হয়। সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য এফএএস এর উদাহরণ হলো-
-
কম উচ্চতা
-
খাওয়াদাওয়া ও ঘুমানোর ক্ষেত্রে সমস্যা
-
কানে ও চোখে সমস্যা
-
কোন নির্দেশনা বুঝতে সমস্যা
-
অমনযোগীতা
-
অন্যদের সাথে মিশতে না পারা ইত্যাদি।
শুধু মদ্যপান বা ধূমপান নয়, আপনি যদি অন্য কোন মাদকও নিয়ে থাকেন সেটা নিয়েও চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন এবং অভ্যাসটি ছেড়ে দিন। গর্ভধারণের যকোন ধাপেই এই অভ্যাসগুলো আপনার শিশুকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে মানসিক ও শারীরিকভাবে। তাই আগে থেকেই এ ব্যাপারে সতর্কতা বজায় রাখুন।।
ক্যাফেইন গ্রহণে নিয়ন্ত্রিত হন
চা বা কফিতে প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যাফেইন আপনি নিচ্ছেন, সেটি আপনার সন্তানের মিসক্যারেজের ক্ষেত্রেও প্রভাব রাখতে পারে। তাই চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন গর্ভধারণ করতে চাইলে এর মাসখানিক আগ থেকে ক্যাফেইন বাদ দিতে। গর্ভধারণকালীন সময়েও কেউ ক্যাফেইন পান থেকে বিরত থাকা শুরু করতে পারেন। তবে এতে করে পরবর্তীতে মায়ের শরীরে উইথড্রোয়াল সিম্পটমও দেখা দিতে পারে।
আরামদায়ক পোশাক পরুন
আপনি সাধারণত যে পোশাকগুলো পরে থাকেন সেগুলোতে যদি আরাম বোধ না করেন গর্ভধারণকালীন সময়ে একটু ঢিলেঢালা পোশাকের দিকে চলে যেতে পারেন। আপনার থাকার স্থান, আপনার প্রতিদিনের নিয়ম- সবকিছু চিন্তায় রেখেই নিশ্চিত করুন যে সেটি গর্ভধারণ করার জন্য যুতসই। অন্যথায় হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্ত আপনার প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনকে কিছুটা বদলে দিলেও সেটা পরবর্তী মানসিক ও শারীরিকভাবে আপনাকে বড় আকারে প্রভাবিত করতে পারে!
মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা নিশ্চিত করুন
মানসিক চাপ, উদ্বিগ্নতা ও এর সাথে গর্ভধারণের সম্পর্কটা ঠিক কি সেটা নিয়ে চিকিৎসকেরা এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না। তবে মানসিক চাপ ও উদ্বিগ্নতা শারীরিক হরমোনকে প্রভাবিত করে। এতে অরে পিরিয়ডের সাইকেল বদলে যেতে পারে। ফলে বদলে যেতে পারে গর্ভধারণ সক্ষমতাও। তবে খুব সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, মানসিক চাপ একজন মানুষকে খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে সে ব্যাপারে কোন দ্বিধা নেই।
তাই গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সাথে সাথে মানসিক উদ্বিগ্নতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন। ইয়োগা, ম্যাসাজ, মেডিটেশন ইত্যাদি মাধ্যমে নিজেকে মানসিকভাবে প্রশান্ত রাখুন। একইসাথে জীবনের অপ্রয়োজনীয় মানসিক চাপগুলোকেও বিদায় বলুন। খুব বেশি মানসিক চাপে থাকলে হাটুন, চুপচাপ সময় কাটান, শরীরচর্চা করুন। এছাড়া দিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। পরিমিত ঘুম আপনাকে সারাদিনের মানসিক চাপ অনেকটাই কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
তবে ঘুমাতে বা মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকতে যদি সমস্যা হয় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের সাথে নিয়মিত কথা বলুন।
এ তো গেলো মানসিক চাপের কথা। তবে এর পরবর্তীতে আসে যে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি সেটি হলো ডিপ্রেশন। মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে এই হতাশা বা ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বেশিরভাগ নারীই পুরুষের চাইতে বেশি হতাশা বা ডিপ্রেশনে ভুগে থাকেন। তাই যেসব নারীর পরিবারে ডিপ্রেশনের কোন হিস্ট্রি আছে, তাদেরকে গর্ভধারনের আগেই চিইতসকের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন তারা। আগে কোন কিছু খুব ভালো লাগতো, এখন লাগে না, আগে কোন কাজে মন বসতো, কিন্তু এখন আর বসে না, আগের মতো ঘুমাতে, ঘুরতে বা কিছু করতে আগ্রহ জাগে না, নিজেকে সবসময় নিরাশ, অনর্থক মনে হয়- এমন কোন লক্ষণ দেখা দিলেই গর্ভধারণের পূর্বে আপনার উচিৎ চিকিৎসকের সাথে কথা বলা।
ডিপ্রেশনের সবচেয়ে কার্যকরী প্রতিষেধক হচ্ছে সাইকোথেরাপি ও মেডিকেশন। অনেকের ক্ষেত্রে এই দুটো একসাথেই চালু রাখার দরকার পড়ে। তবে গর্ভধারণ একজন নারীকে আরো বেশি মানসিকভাবে হতাশ করে ফেলতে পারে সময়ে সময়ে। তাই এমন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চিকিৎসকের সাথে দ্রুত দেখা করুন।
আর্থিকভাবে সচেতন হোন
ভাবছেন সন্তানের স্কুল, কলেজ, ডায়াপার, খাবার- এগুলোর জন্য টাকা জমানোর কথা বলছি? একদম নয়! গর্ভধারণকালীন সময়েও প্রচুর আর্থিক প্রয়োজন হতে পারে আপনার। ভিটামিন, মাতৃত্বকালীন পোশাক, ডাক্তারের ফি, টেস্টের টাকা- এমন নানারকম টুকটাক খরচে খুব স্বল্প জমানো টাকাও আপনার অসম্ভব কাজে আসবে এই পুরো সময়ে। তাই সন্তানের জন্য নয়, তার আগে নিজের সুস্থতার জন্য ও সন্তানকে পৃথিবীতে সুস্থভাবে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করুন আর্থিকভাবে সচেতন হতে।
আর সেই জমানো টাকা থেকে কিছু টাকা যদি বেচেই যায়, তাহলে সেটা পরবর্তীতে কাজে তো লাগবেই। শুধু তাই নয়, টাকা জমানোর এই যে অভ্যাস, একবার সেটা গড়ে উঠলে পরবর্তীতেও আর্থিক দিক দিয়ে সচেতনভাবে খরচ করাটা সহজ হয়ে উঠবে আপনার পক্ষে।
বাড়ির আবহকে শিশুবান্ধব করে তুলুন
শিশু মানেই তার জন্য একটা উপযোগী পরিবেশ উপহার দেওয়ার চিন্তা। আপনার বাড়িকে তাই শিশুবান্ধব করে তুলুন তার জন্মের আগেই। শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই এই কাজটি করতে পারেন আপনি।
শিশুর জন্য একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করুন ঘরে। সে যেন নিরাপদে থাকতে পারে ঘরে, কোনরকম ধারালো কিছু বা অন্য কোন উপাদান যেন তাকে ক্ষতিগ্রস্থ না করতে পারে সেটা নিয়ে নিশ্চিত থাকুন। এছাড়াও, ঘরের ভেতরে উচ্চ শব্দ, কলহ ইত্যাদি সমস্যাগুলোরও সমাধান করুন। অন্যথায়, শিশু জন্মের আগে থেকেই মায়ের শরীরে মায়ের মানসিক ও শারীরিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্থতা থেকে প্রভাবিত হবে।
আপনার শিশু বাড়িতে আসলে তার জন্য আরামদায়ক আর একটা নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন তো? সন্তানের জন্মের আগেই তার ভবিষ্যতের লালন-পালন নিয়ে ভাবুন এবং আর্থিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে তার জন্য বাসার প্রতিটি সদস্যকে প্রস্তুত করে তুলুন!
আরও জানুন: