বিশ্ব নারী সহিংসতা দূরীকরণ দিবসঃ প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

২৫ নভেম্বর, বিশ্ব নারী সহিংসতা দূরীকরণ দিবস। জাতিসংঘ দ্বারা প্রবর্তিত এই দিবসের মূল লক্ষ্য হল নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করা। জাতীয়, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রয়োজন আমাদের সবার সচেতনতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ যেমন একটি সময়ের দাবী, ঠিক তেমনই এই দাবী উঠে আসার পেছনেও রয়েছে হাজারো, লাখো কিংবা তারো বেশি সহিংসতার ঘটনা। যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে নারীর প্রতি যে সহিংস আচরণ এবং ঘটনা ঘটে এসেছে সেগুলোর সমাপ্তি যেন আজ বহুল প্রত্যাশিত একটি বিষয়। 

একটি জরিপে দেখা গেছে যে বিশ্বের ৩০ শতাংশেরও বেশি নারী জীবনে কখনো না কখনো শারীরিক, মানসিক অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর বিশেষ করে যৌন নির্যাতন হয়েছে নিকট কোন আত্মীয়ের দারাই। 

কিভাবে আসল নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ দিবস

১৯৭৯ সালের দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষধ কর্তৃক Convention of the Elimination of All Forms of Discrimination against Women (CEDAW) নামক একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনকে গ্রহণ করা হলেও পুরো বিশ্বজুড়ে নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা একটি বিস্তীর্ণ সমস্যা হিসেবে থেকেই গেল। জাতিসংঘ নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য জনিত এই সহিংসতা রোধ করার জন্য বারংবার পদক্ষেপ নেয়া শুরু হল। উদ্দেশ্য একটাই, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নারী পুরুষ বৈষম্য জনিত সহিংসতা রোধ। 

সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও এই সচেতনতা জাতীয় গণ্ডী ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া তখনো হয়ে উঠেনি। আজ অবধি কেবল মাত্র তিনটি দেশের মধ্যেই সামাজিক ও ঘরোয়া সহিংসতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি ভাবতেই অবাক লাগে যে এখনো অনেক দেশ রয়েছে, যেখানে ধর্ষণের পর ধর্ষিতার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে ধর্ষণ জনিত কেস থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বেশীরভাগ দেশে এখনো নারীর প্রতি ঘরোয়া সহিংসতা রোধের জন্য কোন ধরণের আইন নেই। 

আবার এদিকে ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর লাতিন আমেরিকার একটি দেশ ডোমিনিকান এর স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কারণে প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনার্ভা মিরাবেল নামক তিন বোনকে হত্যা করা হয়েছিল। আর তাদের স্মরণে পরবর্তীতে নারী অধিকার কর্মীরা ১৯৮১ সাল থেকে ২৫ নভেম্বরকে বিশ্ব নারী সহিংসতা দূরীকরণ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। পরবর্তীতে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জাতিসংঘ থেকেও এই দিবসকে স্বীকৃত দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই দিবস নিয়ে জোর প্রচার প্রচারণা শুরু হয় সচেতনতা বৃদ্ধির একটি মাধ্যম হিসেবে। 

অবশেষে ২০০০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষধ কর্তৃক এই দিবসকে অফিশিয়াল ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ফলস্বরূপ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি এনজিওগুলোও নারী সহিংসতা রোধের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির একটি অফিশিয়াল মাধ্যম হিসেবে এই দিবসটিকে ঘিরে নানা কর্মসূচী পালন করা শুরু করে দেয়। 

নারীরা যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছে 

বিশ্বে বেশীরভাগ যায়গায় আজও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কোন ধরণের অভিযোগ করা হয় না, কেননা মনে করা হয় এতে নারীদের সম্মানহানি হবে। আবার যখন ব্যাপারটা আসে ঘরোয়া সহিংসতার বিষয়ে, তখন অনেক নারী এখনো মনেই করে থাকেন যে ঘরের পুরুষটির অধিকার রয়েছে তার প্রতি সহিংস আচরণ করার। নীরবে নিভৃতে নারীরা এই ধরণের অত্যাচার সহ্য করে এসেছে এতদিন ধরে। 

সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে নারীর প্রতি মানসিক, শারীরিক এবং যৌন নিপীড়নকেই মূলত সহিংসতা হিসেবে ধরা হচ্ছে। এর মধ্যে যে বিষয়গুলো অন্তর্গত সেগুলো হল- 

  • স্বামী কর্তৃক সহিংসতা (মানসিক, শারীরিক অথবা যৌন নির্যাতন) 

  • যৌন সহিংসতা (ধর্ষণ, জোর পূর্বক যৌনকর্ম করা, জোর পূর্বক বিবাহ, রাস্তায় নারীকে হয়রানী করা, সাইবার অর্থাৎ অনলাইনে নারীকে যৌন হয়রানী করা) 

  • নারী পাচার (দাসত্ব এবং যৌন শোষণ) 

  • বাল্য বিবাহ ইত্যাদি 

যদিও যৌন নির্যাতনের শিকার নারী এবং পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে, তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নারীদেরকেই এই ধরণের সমস্যার ভুক্তভোগী হতে দেখা যায়। এমনকি নারী পুরুষের বৈষম্য জনিত সমস্যা সবচাইতে বেশি পরিলক্ষিত হয় শিক্ষার ক্ষেত্রে। এখনো অনেক দেশে শুধুমাত্র ছেলে শিশুকেই পড়ালেখা করানো হয় এবং মেয়ে শিশুকে খুব একটা উচ্চ শিক্ষিত করা হয় তো নাই, এমনকি তারা এর প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন না। 

সমাজের বৈষম্য দূরীকরণ ও সুস্থ স্বাভাবিক মননশীল একটি জাতি পেতে হলে আমাদের অবশ্যই নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার পাশাপাশি শ্রদ্ধার চোখেও দেখতে হবে। নেপোলিয়ন যথার্থই বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব।” আদতে একজন মা যখন শিক্ষিত হবেন এবং বৈষম্যবিহীন চিন্তা ভাবনা করতে পারবেন তখন শিশুর মধ্যেও সেই চিন্তা এমনিতেই চলে আসবে।  

ধর্ষণ—নারীর প্রতি এই ভয়ংকর নির্যাতন রুখে দিতে হবে! 

ধর্ষণ! একটি ছোট শব্দ হলেও এর প্রভাব অনেক বিস্তৃত। এটি শুধুমাত্র শরীরের প্রতি একটি সহিংস আচরণ নয়, একটি ধর্ষণ একজন নারীর সাড়া জীবনের জন্য ভয়ংকর এক দুঃসহ স্মৃতি হয়ে থেকে যায়। মানসিক ভাবে আবারো শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ানো হয়ত সেই নারীর আর সম্ভব নাও হতে পারে। 

জাতিসংঘ থেকেও ধর্ষণ এর পাশাপাশি সকল ধরণের নারী পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ এর জন্য বিভিন্ন সচেতনতা বৃদ্ধির ক্যাম্পেইন করা হয় প্রতিনিয়তই। নারীর প্রতি ধর্ষণ রোধে জাতিসংঘের এক্সিকিউটিভ ডিরেকটর ‘ফ্লামজিল ম্লাম্বো’ বলেন, “আমার যদি কোন একটি ইচ্ছে পূরণ করা হত তাহলে আমি চাইতাম যেন পৃথিবী থেকে ধর্ষণ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। যারা নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করতে ধর্ষণ করে, তারা কখনই বুঝে না এটি একজন নারীর জন্য কতটা বেদনাদায়ক। এমনকি একটি জাতির মধ্যে যখন এই ধরণের অত্যাচার সংঘটিত হয় তখন সেটা পুরো জাতির জন্যই কলঙ্কজনক একটি বিষয়।” 

নারীর প্রতি সহিংসতা এবং বাংলাদেশ

আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার পুরো চিত্রটি যদি এক নজরে দেখা এবং বুঝা সম্ভব হত তাহলে যে কেউ এর ভয়াবহতা অনুধাবন করে শিউরে উঠত। অনেক নারী অধিকার কর্মীদের দাবী যে দেশের প্রায় প্রত্যেকটি নারীকেই জীবনে কখনো না কখনো যৌন নির্যাতন এবং বৈষম্যের শিকার হতে হয়। পড়ালেখা থেকে শুরু করে কর্ম জীবন ছাপিয়ে এই বৈষম্য এবং সহিংসতা তাদের সংসার জীবনকেও নানা ভাবে অবরুদ্ধ করে রাখে। 

ইউনাইটেড ন্যাশন পপুলেশন ফান্ডের একটি জরিপে বলা হয়, নারীর প্রতি তার পুরুষ সঙ্গীর শারীরিক নির্যাতনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এমনকি এটা ভেবেও অবাক হয়ে যেতে হয় যে দেশের শতকরা চৌদ্দ শতাংশ গর্ভকালীন মৃত্যু হয় নির্যাতনের কারণে। এমনকি শতকরা একষট্টি শতাংশ পুরুষ মনে করে থাকেন যে, পুরুষ হওয়ার কারণে তিনি চাইলেই নারী সঙ্গীর উপর শারীরিক যে কোন ধরণের নির্যাতন করতে পারেন। 

সবচাইতে দুঃখজনক বিষয় হল সবাই যখন পরিবারের কাছে নিরাপদ আশ্রয় পেতে চায়, তখন এই নারীর প্রতি সহিংস আচরণের শতকরা আশি শতাংশ নির্যাতন সংঘটিত হয় পরিবারের কোন না কোন সদস্য দ্বারা। এমনকি আমাদের দেশে নারীরাও মাঝেমধ্যে নারী নির্যাতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি মেয়ে যখন কোন পরিবারে বউ হয়ে আসে, তখন দেখা যায় তার প্রতি সহিংস আচরণে সেই পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্য যেমন শাশুড়ি, ননদরাও জড়িত থাকে। 

এইসব কিছুই হচ্ছে শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে। নারীরা নিজেরাও নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। এমনকি অনেক নারী সমাজ এবং লোক লজ্জার ভয়ে তার প্রতি সহিংস আচরণের কোন ধরণের প্রতিবাদ না করেই নীরবে সহ্য করে থাকে। এমনকি নারীর প্রতি সহিংস আচরণের যে প্রতিকার পাওয়া যায় এটাই অনেকে জানেন না, এই অত্যাচার যেন অবধারিত নিয়তি মেনে নিয়েই চলছে লাখো নারীর জীবন। 

বাংলাদেশ সরকার থেকেও নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিকারের জন্য বর্তমানে ১০৯ নাম্বার হল বাংলাদেশ সরকারের জরুরী হেলপ লাইন। একজন নারী যদি কোন ধরণের সহিংসতার শিকার হন তাহলে তিনি এই নাম্বারে এর প্রতিকার চাইতে পারেন। 

 

নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইন থাকলেও আমাদের সবার উচিত ইতিবাচকভাবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা। নারীকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতেই হবে। তবেই আমরা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারব।

২৫ নভেম্বর বিশ্ব নারী সহিংসতা দূরীকরণ দিবসের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে যেন আমরা আরো অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠি এটাই লক্ষ্য হয়ে উঠুক। এজন্য পরিবার, সমাজ ও সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। 

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মিলে নির্যাতনহীন একটি বিশ্ব গড়াই হবে বিশ্ব নারী সহিংসতা দূরীকরণ দিবসের আমাদের সবার স্বপ্ন।

Default user image

ইকবাল মাহমুদ ইকু, লেখক, আস্থা লাইফ

দীর্ঘদিন ধরেই লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ততার সুবাদে বেশ কিছু স্বনামধন্য অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই লেখার প্রতি রয়েছে অদম্য অনুরাগ। এই লেখালেখিকেই নেশা এবং পেশা হিসেবে নেয়া আমার ইতোমধ্যেই চারটি উপন্যাস এবং একটি ছোট গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। জন্ম থেকেই ঢাকায় বসবাসরত আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেও পথ শিশুদের জীবন যাপনের মান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে আসছি প্রায় ১২ বছর ধরে। বর্তমানে আস্থা লাইফের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে জন সাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছি। বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসি এবং অবসর সময়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর মুভি নিয়েই কাটে।

Related Articles