মাসিক রজঃচক্র : ৬টি সমস্যার সহজ প্রতিকার
মহিলাদের মাসিক বা রজঃচক্রের সময় বিভিন্ন ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু অনেকেই তা আমলে নেয় না বা অবহেলা করে। অথচ একটু সতর্ক হলেই খুব সহজেই সমস্যাগুলির সমাধান করা যায়।

একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে প্রতি মাসে মহিলাদের জরায়ু থেকে রক্ত, মিউকাস এবং অনিষিক্ত ডিম্বাণুর ধ্বংসাবশেষ রক্তপাত আকারে বেরিয়ে যায়। একে রজঃচক্র বা পিরিয়ড বলে। রজঃচক্র নারীর যৌনজীবন ও প্রজনন ক্রিয়ার নির্দেশক। বয়ঃসন্ধিকালে এই চক্র প্রথম শুরু হয়, চলে ৪৫-৫০ বছর বয়স পর্যন্ত। রক্তপাতের পাশাপাশি এ সময় আরো কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। একে তো এ সময় সব মেয়েই কম বেশি অস্বস্তিতে ভোগে। এইসব উপসর্গ যেন সেই অস্বস্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। অথচ সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে চললেই এর প্রতিকার হতে পারে। এখানে পিরিয়ডকালীন সেইসব সমস্যা ও তার সম্ভাব্য প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হল -
১) প্রাক রজঃস্রাবীয় উপসর্গ / প্রি মেন্সট্রুয়াল সিম্পটম (PMS)
রজঃচক্র বা মাসিক শুরু হবার কয়েকদিন আগে থেকেই মেয়েদের মধ্যে কিছু শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন চোখে পড়ে। কোনো কারণ ছাড়াই ঘুমে অস্বস্তি, অবসাদ, স্তন স্ফীতি, ব্রণ, বিরক্তি কিংবা মুড সুয়িং - শতকরা ৮৫ জন মহিলার এর মধ্যে অন্তত একটি হলেও উপসর্গ দেখা যাবে। অনেকের এই সময় স্তনে হালকা হালকা ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এই উপসর্গ গুলি বয়সের সাথে সাথে বাড়তে থাকে এবং মেনোপজ বা শেষ রজঃচক্রের আগে বেশি করে হয়। এছাড়াও যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ এই উপসর্গগুলিকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
প্রতিকার
এই উপসর্গ গুলি পুরোপুরিভাবে নিরাময় করার কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। তবে সহনীয় করার উপায় অবশ্যই আছে।
-
যদি আপনার ঘুম না হয়, আর ঘুম না আসার কারণ যদি হয় আপনার আসন্ন রজঃচক্র, সেক্ষেত্রে ঘুমের ওষুধ না খেয়ে বরং অন্যভাবে চেষ্টা করুন। ঘুমানোর আগে কিছুক্ষণ রিলাক্স করুন, এককাপ দুধ কিংবা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খান। নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর একটা প্রবাদ হয়ত আপনার জানা আছে। দু'ফোটা ল্যাভেন্ডার অয়েল এক্ষেত্রে দারুণ কাজ করে।
-
স্তনে অস্বস্তি, ব্যথা, স্তন স্ফীতি এসময় অনেকের অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চা, কফি, উচ্চ মাত্রায় ফ্যাট আছে এমন খাবার এড়িয়ে চলুন। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ট্যাবলেট খেতে পারেন।
-
মাসিকের আশেপাশে সময়ে ব্রণ উঠে মুখ ভরে যায় - এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। ডার্মাটোলোজিস্টদের মতানুসারে, এসময় লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) ডায়েট গ্রহণ করা উচিত। নিয়মিত ত্বকের ক্লিনসিং করুন ও আর্দ্রতা বজায় রাখুন। তাতেও কাজ না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী টপিকাল এন্টিবায়োটিক খেতে পারেন। অনেক সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল প্রেসক্রাইব করা হয় যা মেইল হরমোন গুলিকে ব্লক করে ব্রণ হওয়া আটকায়।
-
সম্ভব হলে পরিশোধিত খাবার খাওয়া বন্ধ করুন। পরিশোধিত আটা, চিনি এসব খাদ্যতালিকায় রাখবেন না।
-
সেরাটোনিনকে বলা হয় শরীরের 'হ্যাপী হরমোন'। মাসিক শুরু হবার এক সপ্তাহ আগে থেকেই শরীরে এর পরিমাণ কমতে শুরু করে। ফলাফল? অবসাদ, হতাশা, ক্লান্তি। এ সময়ে শরীরে ক্যালসিয়ামের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে স্বল্প মাত্রার এন্টি ডিপ্রেসেন্ট সেবন করতে পারেন, সেই সাথে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট।
২) অতিরিক্ত ক্ষুধা ও রুচি বৃদ্ধি
রজঃচক্রের ৫-৭ টি দিন অনেকের মধ্যেই অতিরিক্ত ক্ষুধা কিংবা কোনো বিশেষ খাবার খাওয়ার প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ দেখা যায়। একে ক্রেভিং বলে। যা হয়ত মাসের বাকি দিনগুলিতে দেখা যায় না। যেমন : রক্তপাত শুরু হবার পর প্রথম দুই একদিন লবণ অর্থাৎ নোনতা খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখা যায়।
২৮ দিনের মেন্সট্রুয়াল সাইকেলের দ্বিতীয় ভাগে অর্থাৎ ১৪ তম দিন থেকে ২৮ তম দিন পর্যন্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং চকলেটের প্রতি ক্রেভিং থাকে। এ সময় শরীরের হরমোন লেভেল কমতে থাকে এবং আমাদের ব্রেইনের অতিরিক্ত জ্বালানির দরকার পড়ে।
প্রতিকার
-
শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্থিতিশীল রাখা প্রয়োজন। ৩ বেলার প্রধান খাবারের পাশাপাশি অন্তত ২ বার স্বাস্থ্যকর নাস্তা খান। ভাজা-পোড়া নাস্তার বদলে এক পিস পাউরুটি, এক বাটি ফল, কয়েকটি বাদাম অথবা খানিকটা দই খেতে পারেন।
-
প্রতিবেলার খাবারে শর্করা ও আমিষের উপস্থিতি নিশ্চিত করুন।
-
উচ্চমাত্রায় আঁশযুক্ত ফল ও সবজি হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩) ক্রাম্পস (cramps)
বেশিরভাগ মহিলাই পিরিয়ড শুরু হবার আগে ক্রাম্পিং এর অভিযোগ করেন। সাথে সাথে তলপেটে, লো ব্যাক বা কোমরের দিকে এবং পায়ে ব্যথা থাকতে পারে। অল্প স্বল্প ক্রাম্পিং সবারই হয়ে থাকে কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে এটা সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যায়।
প্রতিকার
-
প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকা থেকে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার এবং মাংস বিশেষ করে রেড মিট বাদ দিতে হবে। পুরোপুরি বাদ দেয়া সম্ভব না হলে পরিমাণ কমিয়ে দিন এবং তার বদলে বেশি বেশি শাক সবজি এবং ফল খান। কারণ দুগ্ধজাত খাবার এবং মাংসে প্রোস্টাগ্লানডিন নামক হরমোন থাকে যা ক্রাম্পিং এর জন্য অনেকাংশে দায়ী।
-
ধূমপান, মদ্যপান ক্রাম্পিং বৃদ্ধি করে। সুতরাং এগুলি পরিহার করুন।
-
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব মহিলারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন তাদের তুলনায় যারা তুলনামূলক কম শারীরিক পরিশ্রম করেন, কম নড়াচড়া করেন তাদের ক্রাম্পিং বেশি হয়।
-
ক্রাম্পিং শুরু হবার পর প্রথম দিকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে, পেটের উপর হিটিং প্যাড অথবা গরম পানির বোতল দিয়ে সেঁক দিলে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়।
-
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ সেবন করতে পারেন। ইবুপ্রোফেন প্রোস্টাগ্লানডিন হরমোনকে ব্লক করে ক্রাম্পিং এর তীব্রতা কমায়। এতে কাজ না হলে অনেক সময় জন্ম বিরতিকরণ বড়িও প্রেসক্রাইব করা হয়। পাশাপাশি ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম সাপ্লিমেন্টেশন দেয়া যেতে পারে।
৪) অনিয়মিত রজঃচক্র
আজকাল অনেক মেয়ের মুখেই শোনা যায় ইরেগুলার পিরিয়ড বা অনিয়মিত রজঃচক্রের কথা। প্রতি মাসে গড়ে ২৮ দিন পরপর জরায়ু থেকে রক্ত, মিউকাস, এন্ডোমেট্রিয়ামের ভগ্নাংশ, অনিষিক্ত ডিম্বাণুর অংশ রজঃস্রাব আকারে বেরিয়ে আসে। কারো কারো ক্ষেত্রে ২৮ দিনের বদলে ২৯ বা ৩০ দিন, সর্বোচ্চ ৩২ দিন পর্যন্ত হতে পারে। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময় পর পর ব্লিডিং হবার কথা থাকলেও যাদের সাইকেল অনিয়মিত তাদের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়।
অনিয়মিত রজঃচক্রের বিভিন্ন কারণ হতে পারে। কোনো ধরনের ফ্লুতে আক্রান্ত হলে, স্ট্রেস, অনিয়মিত ঘুম - এইসব কারণে পিরিয়ড হতে দেরি হতে পারে। অতিরিক্ত ওজন, খাবার ও খাদ্যনালী সংক্রান্ত কোনো ডিসঅর্ডার, থাইরয়েড জনিত কোনো রোগ থেকেও সাইকেল অনিয়মিত হতে পারে। যেসব মা বুকের দুধ খাওয়ান, তাদের রজঃচক্র আপনাতেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রতিকার
-
কোনো মাসে পিরিয়ড মিস গেলে সবার আগেই প্রেসনেন্সি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নিন।
-
স্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকা মেনে চলুন।
-
দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করুন। তবে অতিরিক্ত ব্যায়াম করা যাবে না, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
-
যদি দুই মাস বা তার বেশি সময় ধরে পিরিয়ড বন্ধ থাকে তাহলে অবশ্যই একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
৫) স্পটিং
চক্রের ১৪ তম দিনে ফলিকল থেকে ডিম্বপাত হয়। এস্ট্রোজেন হরমোনের ওঠানামার কারণে অনেকের এ সময়টাতে কমবেশি স্পটিং হতে পারে। জন্মবিরতিকরণ বড়ি সেবন করা অবস্থায়ও স্পটিং হতে পারে। স্ত্রী প্রজননতন্ত্রে কোনো ধরনের সংক্রমণ হলে কিংবা জরায়ুতে পলিপ বা সিস্ট হলেও স্পটিং হতে পারে।
প্রতিকার
-
এই সমস্যার সমাধান করতে হলে আগে দেখতে হবে সমস্যার কারণটা কি। যদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের কারণে হয়ে থাকে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। পিল এবং কনডম ছাড়াও ট্রান্সডার্মাল প্যাচ, বিভিন্ন মেয়াদী ইনজেকশন, ইনট্রা ইউটেরাইন বিভিন্ন ডিভাইস রয়েছে।
-
যদি স্পটিং এর কারণ জরায়ুর ভিতরের সিস্ট বা পলিপ হয়ে থাকে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে পারেন অথবা সার্জারির প্রয়োজন হলে তাও করাতে পারেন। পলিপের আকার বড় হলে সার্জারির মাধ্যমে তা অপসারণ করা হয়।
৬) প্রি মেন্সট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার (PMDD)
ক্লান্তি, অবসাদ, প্যানিক অ্যাটাক, মুড সুয়িং, অবিরাম খিটখিটে মেজাজ, ক্রাম্পিং - এই সব মিলিয়ে পিরিয়ডকালীন ডিপ্রেশন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শতকরা ৮ শতাংশ মহিলা পিরিয়ডের অনাকাঙ্ক্ষিত উপসর্গের দরুণ ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ভোগে।
প্রতিকার
-
PMS বা প্রি মেন্সট্রুয়াল সিম্পটম মারাত্মক হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
-
খাদ্যতালিকা সংশোধন, ব্যায়াম, হালকা পাতলা পেইনকিলার কিংবা গরম সেঁক দিয়ে যদি নিরাময় হয় তো ভালো।
-
কিন্তু পিরিয়ড ও তার আগে পরে দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত হলে সেক্ষেত্রে ঘরে বসে থাকবেন না, নিকটস্থ ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিন। আর যদি ক্লিনিকাল ডিপ্রেশন বলে নিশ্চিত হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে একজন মনোবিদের পরামর্শ নেয়াটাই ভালো।
এখনো আমাদের দেশে অনেকেই পিরিয়ড সম্পর্কে আলোচনা করতে কিংবা এ ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে ইতস্তত করেন। অনেকের পরিবার থেকেও এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, রজঃচক্র নারীদেহের একটি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া। এ নিয়ে রাখঢাক করার কোনো সুযোগ নেই। রজঃচক্রে সামান্যতম সমস্যাও পরবর্তীতে মেয়েদের বিভিন্ন শারীরিক ও যৌন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তাই পিরিয়ড সংক্রান্ত সকল বিভ্রান্তি দূর করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।