জন্মবিরতিকরণ পিলের কার্যকরী ব্যবহার!

জন্মবিরতিকরণ পিল চেনার উপায় ও এর বৈশিষ্ট্য। জন্মবিরতিকরণ পিলের প্রকারভেদ, কোন পিল কাদের জন্য এবং মাসিকের সাইকেলের উপর ভিত্তি করে বিশদভাবে পিল খাবার নিয়ম

জন্মবিরতিকরণ পিল/বড়ি সম্পর্কে আমরা সকলেই কম-বেশি জানি। প্রচলিত জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে এটি জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যাবহৃত একটি অস্থায়ী পদ্ধতি। তবে মহিলাদের অনেকেই এ নিয়ে প্রায়ই কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়ে থাকেন। তার কারণ হল এইসব পিলের সঠিক ব্যাবহারবিধি না জানা, জানা সত্বেও তা পালন না করা, পিল খেতে ভুলে যাওয়া এবং ভুলে গেলে কি করণীয় সেটা না জানা। যদিও বিষয়টা একটু জটিল, তবুও আপনাদের কাছে সহজ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

জন্মবিরতিকরণ পিল কি

প্রথমেই আমরা জেনে নেই জন্মবিরতিকরণ পিল কি। জন্মবিরতিকরণ পিল হচ্ছে এক ধরণের পিল বা খাবার বড়ি যা গর্ভনিরোধনে সাহায্য করে। এই পিল কয়েক ধরণের হয়ে থাকে। যার মধ্যে বহুল প্রচলিত হচ্ছে-

১। কম্বিনেশন পিল (সিওসি)

২। প্রোজেস্টিন পিল

১। কম্বিনেশন পিলঃ এই ধরণের পিল বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত। এই পিলে মহিলাদের ২টি প্রধান সেক্স হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন এর (কৃত্রিম রুপ) কম্বিনেশন থাকে। এই দুটি হরমোনের স্বাভাবিক ব্যালেন্সড মাত্রাই মহিলাদের মাসিক, গর্ভধারণ এবং প্রেগন্যান্সির জন্য প্রয়োজনীয়।

কম্বিনেশন পিল আবার কয়েক ধরণের হতে পারে। যেমন- মনোফেসিক (যেখানে প্রতিটি পিলেই ২টি হরমোনের কম্বিনেশন থাকে) এবং মাল্টিফেসিক (যেখানে আলাদা পিলে আলাদা আলাদা হরমোন থাকে)।

২। প্রোজেস্টিন পিলঃ এই ধরণের পিলে শুধুমাত্র প্রোজেস্টেরন থাকে এবং কোন ইস্ট্রোজেন থাকে না। এদের সাধারণত মিনিপিল বলা হয়। যে সকল মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন গ্রহণে সমস্যা হয় তাদের জন্য এই পিল ব্যাবহার করা হয়।

প্রোজেস্টিনগুলি প্রথম থেকে চতুর্থ প্রজন্মের প্রোজেস্টিন হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। তবে বিভিন্ন প্রজন্মেরও কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রজন্মগুলো হচ্ছে, 

  • প্রথম প্রজন্ম: লাইনেস্ট্রেনল

  • দ্বিতীয় প্রজন্ম: নরজেস্ট্রেল

  • তৃতীয় প্রজন্ম: ডেসোজেস্ট্রেল

  • চতুর্থ প্রজন্ম: ড্রসপিরেনোন

মনে রাখবেন যে, সবসময় নতুন প্রজন্ম আপনার দরকার নাও হতে পারে। বিভিন্ন ধরণের প্রজন্মের উপর ভিত্তি করে কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন হরমোনাল ব্রণের সমস্যা, অস্বাভাবিক মাসিকের লক্ষণ, অনিয়মিত মাসিক সমস্যা এবং মাসিক শুরু হওয়ার আগের মানসিক ও শারীরিক সমস্যার সমাধান।

পিল চেনার উপায়

পিলের প্যাকেটের গায়ে পিলের ব্র্যান্ড নেইমের (কোম্পানী প্রদত্ত নাম) নিচে তার উপাদানের নাম ও মাত্রা দেখে আপনি বুঝতে পারেন এটি কোন ধরনের পিল। পিলের উপাদান যদি ২টি হয় তাহলে সেটি কম্বিনেশন পিল এবং একটি হলে প্রোজেস্টিন পিল।

পিলের বৈশিষ্ট্য 

প্রায় সব ধরনের পিলেই ইস্ট্রোজেন হিসেবে ইথিনাইলএস্ট্রাডিওল থাকে। এর পরিমাণ যদি ০.০৩ মিলিগ্রাম অথবা ৩০ মাইক্রোগ্রাম হয় তাহলে তাকে আমরা লো ডোজ পিল বলি। কোন কোন পিলে এই হরমোনের পরিমাণ ০.০৩ মিলিগ্রাম বা তার বেশিও থাকতে পারে। আলট্রা লো ডোজ পিলে আবার এর মাত্রা ০.০২ মিলিগ্রাম বা ২০ মাইক্রোগ্রাম বা তার কম থাকতে পারে। লো ডোজ বা আলট্রা লো ডোজ পিলের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কম হয় (যেমন ওজন বৃদ্ধি কম হওয়া)।

কোন পিল কাদের জন্য

 সব ধরণের পিল সবার জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। পিল গ্রহণের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া জরুরী। পিল গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় মাথায় রাখা জরুরী-

  •  মাসিকের লক্ষণসমূহ

  • শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো হচ্ছে কিনা

  • হৃদরোগ আছে কিনা

  • অন্য কোন দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা আছে কিনা

  • অন্য কোন ঔষধ সেবন করা হচ্ছে কিনা ইত্যাদি।

পিলের উপাদান, তার পরিমাণ, জেনারেশন (প্রজন্ম), সুবিধা-আসুবিধা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পিলের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে পিল গ্রহণ করা উচিত।

পিল গ্রহনের সঠিক নিয়ম

পিল গ্রহনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় মনে রাখা জরুরী-

  • প্রতিদিন পিল খাওয়া- বাজারে পিলের ধরন অনুযায়ী প্রতি পাতায় ২১টি, ২২টি এবং ২৮টি (এখানে ২১টি, ২২টি বা ২৪টি সক্রিয় পিল এবং বাকিগুলো নিষ্ক্রিয় পিল) পর্যন্ত হয়ে থাকে। যা প্রতিদিন একটি করে খেতে হয়। সাধারনত পিলের প্যাকেটের গায়ে দিনের নাম লিখা থাকে। সেই দিন খেয়াল করে খেলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

  • প্রতিদিন একই সময়ে পিল খাওয়া- পিল একই সময়ে খাওয়া অত্যন্ত জরুরী। এতে শরীরে হরমোনের ব্যালেন্স ঠিক থাকে এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কম হয়।

  • লো ডোজ অথবা আলট্রা লো ডোজ (ইস্ট্রোজেনের মাত্রা অনুযায়ী) পিলের ক্ষত্রে অধিক সতর্কতা।

  • অস্বাভাবিক কোন লক্ষণ দেখা যায় কিনা সেদিকে খেয়াল রাখা।

  • মাসিকের পূর্বলক্ষণ বিবেচনা করে পিল গ্রহণ করা ইত্যাদি।

পিল খেতে ভুলে যাওয়া

একটি গবেষনায় দেখা গেছে বিভিন্ন কারনে প্রায় ২১% মহিলারা কখনও ঔষধ খেতে ভুলে না, ৬৫% মহিলা বছরে ১৩বারের নিচে ভুলে যায়, ১৪% মহিলা মাসে অন্তত একবার ভুলে যায়, অর্থাৎ ৭৯% মহিলাই কোন না কোন ভাবে পিল খেতে ভুলে যায়।

ভুলে গেলে করণীয়

পিলে উপাদানের মাত্রার উপর ভিত্তি করে ভুলে যাওয়া পিল গ্রহণের নিয়ম থাকলেও মহিলাদের ব্যাবহারের সুবিধার্থে সোসাইটি অফ অবসটেট্রিসিয়ান্স এন্ড গাইনেকোলজিস্টস অফ কানাডা (এসওজিসি) কমিটির মতে- কেউ যদি কম্বিনেশন পিল গ্রহনে ভুলে যায় বা মিস করে তাহলে নিম্নোক্ত উপায় অবলম্বন করতে হবে,

১। মাসিকের সাইকেলের যে কোন সময় ১টি পিল ভুলে গেলে এবং ভুলে যাওয়ার ২৪ ঘন্টা পার হওয়ার আগে তা মনে পরলেঃ যত দ্রুত সম্ভব মিসড পিল খেয়ে নিতে হবে এবং বাকী পিলগুলো আগের নিয়মে খেয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, যেদিন ভুলে যাওয়া পিল খাবেন সেদিন নিয়মিত সময়ে ঐ দিনের পিল ও খেতে হবে। অর্থাৎ সেদিন ২টি পিল খাওয়া হবে, একটি মনে পরার সাথে সাথে এবং অন্যটি নিয়মিত সময়ে।

২। ১টি (২৪ ঘন্টার পার হয়ে) বা ১টির বেশি পিল ভুলে গেলেঃ

ক) মাসিকের সাইকেলের ১ম সপ্তাহে যদি ১টি বা তার বেশি মিস হয়ঃ যত দ্রুত সম্ভব মিসড পিল খেয়ে নিতে হবে এবং বাকী পিলগুলো আগের নিয়মে খেয়ে যেতে হবে। তবে পরের ৭দিন পিলের পাশাপাশি অতিরিক্ত সতর্কতা (যেমন কনডম) ব্যাবহার করতে হবে। যদি ঐ সপ্তাহের শেষের ৫দিন অরক্ষিত সহবাস হয় তবে ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ খাওয়া যেতে পারে (যদিও এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে)।

 খ) মাসিকের সাইকেলের ২য় বা ৩য় সপ্তাহে যদি ১টি বা তার বেশি মিস হয়, 

  •  যদি ৩টির কম মিস হয়ঃ যত দ্রুত সম্ভব মিসড পিল খেয়ে নিতে হবে এবং বাকী পিলগুলো আগের নিয়মে খেয়ে যেতে হবে। তবে সক্রিয় পিল শেষ হবার পর নিষ্ক্রিয় পিল (যদি থাকে- অনেক সময় পিলের পাতায় নিষ্ক্রিয় কিছু পিল থাকে যেখানে কোন হরমোন থাকে না কিন্তু মনে রাখার সুবিধার্থে দেওয়া হয়) না খেয়ে ফেলে দিতে হবে এবং সক্রিয় পিল শেষ হওয়ার পরের দিন থেকেই সেই পিলের নতুন আরেকটি পাতা শুরু করতে হবে।

  •  যদি ৩টি বা তার বেশি মিস হয়ঃ যত দ্রুত সম্ভব মিসড পিল খেয়ে নিতে হবে এবং বাকী পিলগুলো আগের নিয়মে খেয়ে যেতে হবে। তবে সক্রিয় পিল শেষ হবার পর নিষ্ক্রিয় পিল (যদি থাকে) না খেয়ে ফেলে দিতে হবে এবং সক্রিয় পিল শেষ হওয়ার পরের দিন থেকেই সেই পিলের নতুন আরেকটি পাতা শুরু করতে হবে। পাশাপাশি পরের ৭দিন পিলের পাশাপাশি অতিরিক্ত সতর্কতা (যেমন কনডম) ব্যাবহার করতে হবে। যদি ঐ সপ্তাহের শেষের ৫দিন অরক্ষিত সহবাস হয় তবে ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ খাওয়া যেতে পারে।

পিলের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া

  •  স্পটিং (২ মাসিকের মাঝে অল্প পরিমাণে ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং হওয়া)

  •  বমি বমি ভাব

  •  স্তনের অতি-সংবেদনশীলতা

  •  মাথা ব্যাথা এবং মাইগ্রেন সমস্যা

  •  ওজন বৃদ্ধি পাওয়া

  • মেজাজ পরিবর্তন হয়ে যাওয়া

  • পিরিয়ড মিস হওয়া ইত্যাদি।

সকল হরমোনাল পিলেরই কিছু না কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকে। তাই অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বুঝে পিল খাওয়া উচিত। পিল খাওয়া শুরু করার পর কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও ডাক্তারের মতামত নেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে ডাক্তার আপনার লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে সমাধান দিতে পারেন।
 

Default user image

মোঃ হাবিবুর রহমান, লেখক, আস্থা লাইফ

ঢাকার স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে বর্তমানে ব্যাবসায় প্রশাসন বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন। কর্মরত আছেন একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর সেলস ট্রেইনিং বিভাগের সিনিয়র ট্রেইনিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে। পড়াশুনা এবং কাজের ধরনের সাথে তাল মিলিয়েই দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় ক্ষুদ্র অবদান রখার প্রয়াসে যুক্ত হয়েছেন আস্থা লাইফের পরিবারের সাথে। তার বিশ্বাস আস্থা লাইফের এই ডিজিটাল প্লাটফর্ম এবং লেখক/লেখিকাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে একদিন এ দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়বেই ইন-শা-আল্লাহ্‌।

Related Articles