গর্ভাবস্থায় রোজা রাখা যাবে কি? - aastha.life

গর্ভাবস্থায় রোজা রাখা কি নিরাপদ? গর্ভাবস্থায় রোজা রাখার ব্যাপারে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি কী? স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরই বা কি মতামত! আসুন জেনে নেই রমজান মাসে গর্ভবতী নারীদের রোজা রাখা নিয়ে বিস্তারিত।

গর্ভাবস্থায় রোজা রাখা নিয়ে মায়েদের সাধারণ কিছু প্রশ্ন এবং উত্তর 

১) আমার প্রেগন্যান্সির ৫ মাস চলে, আমি কি রোজা রাখব?

উত্তরঃ হ্যা, আপনি রোজা রাখবেন তবে অবশ্যই আপনি যদি সুস্থ হন এবং ডাক্তার  যদি রোজা রাখার  পরামর্শ দেয়। 

২) গর্ভাবস্থায় নারীর রোজা রাখার মাসায়ালা কি? গর্ভাবস্থায় রোজা রাখতে না পারলে পরে কি তা রাখতে হবে? 

উত্তরঃ গর্ভবতী ও স্তন্যদান কারিণী মায়ের জন্য রোজা না রাখার বিধান রয়েছে। তবে পরবর্তীতে ঐ রোজার কাযা আদায় করতে হবে। কিন্তু কাফফারা দিতে হবে না। (সূত্রঃ.১। আল-কোরআনঃ সূরা বাকারা- আয়াত- ১৮৫, ২। সুনানে আবু দাউদঃ রোজা না রাখার অনুমতি অধ্যায়, হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ বর্ণিত হাদিস।)

৩) আমার স্ত্রী আমার ৬ মাসের শিশুকে স্তন্যদান করেন, তার জন্য রোজা রাখার বিধান কি?

উত্তরঃ এমন মায়েদের ক্ষেত্রে দুই রকম ঘটনা ঘটতে পারে-

           ১। রোজা রাখার দ্বারা তার বা তার সন্তানের কোনো ধরনের স্বাস্থ্যহানি না ঘটা বা স্বাস্থ্যহানি ঘটার কোনো আশংকা না থাকে তবে তার রোজা ভঙ্গ না জায়েয হবে।

          ২। যদি রোজ রাখার দ্বারা মা বা তার সন্তানের বা উভয়ের স্বাস্থ্য হানি ঘটার আশংকা থাকে ত্যবে সে রোজা ভঙ্গ করতে পারবে। এবং তা পরে কাযা আদায় করতে হবে।   

 

ইসলাম ধর্মে রোজা রাখা ফরজ। তবে রোজা রাখলে যদি আপনার শরীরের মারাত্মক কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে বা আপনার গর্ভের সন্তানের ও আপনার অসুস্থতার কারনে যদি ডাক্তার আপনাকে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়, তবে আপনি রোজা রাখা থেকে বিরত থাকতে পারেন। তবে, সুস্থ হয়ে রোজার কাযা আদায় করতে হবে। 

ইসলামী বিধান  

রোজা অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় রীতি, আদায় করা ফরজ। কিন্তু শান্তির ধর্ম ইসলাম কিছু বিষয় অতি মানবিক। আপনি যদি এমন কোনো শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে থেকে থাকেন তবে আপনার জন্য ধর্মীয় বিধি নমণীয়।

একজন গর্ভবতীর সুস্থতা তার নিজের জন্য এবং তার অনাগত সন্তান এর জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সাওম পালন করতে গিয়ে যদি গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয় বা তার নিজের কোনো মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যায়, তবে তার জন্য রোজার বা সাওমের শর্ত শিথিল।

একজন গর্ভবতী নারীর রোজা রাখা না রাখা নিয়ে ইসলাম বলে, সত্যিকারের কোনো কারণ ছাড়া রোজা ভঙ্গ করা যাবে না। যদি সত্যিকারের কোনো কারণে রোজা ভঙ্গ করতে হয় তবে পরবর্তিতে কাযা আদায় করতে হবে। কোরআন এর দলিল হলো- ‘’তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে সে অন্যদিনগুলোতে এ সংখ্যা পূর্ণ করবে’’;(সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)। মুফাসসির গনের মতে গর্ভবতী নারীরা অসুস্থ ব্যক্তির তালিকা ভুক্ত। 

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের ভাষ্য 

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, গর্ভাবস্থায় রোজা রাখতে কোনো নিষেধ নাই তবে, গর্ভবতী নারীর রোজা রাখায়  ভাবতে হবে অনেক কিছু। গর্ভবতী নারীদের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্যালরি প্রয়োজন হয়। এ কারনে তার খেতেও হয় বেশি। যা রোজা রেখে সম্ভব না। শীতের সময়ের থেকে গরমের সময় রোজা রাখলে আরও বেশি সময় পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়। তাছাড়া গরমে বেশি ঘাম হয়ে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। যা একজন সন্তান সম্ভবা মায়ের জন্য খুবই বিপদজনক। এজন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলেন যে, সাওম আদায় করতে গিয়ে যদি এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টি যা একজন সন্তান সম্ভবা মা বা তার গর্ভের সন্তানের জন্য ক্ষতিকর তবে তার সাওম পালন না করাই ভালো।  

গর্ভকালীন সময়ে কখন রোজা রাখা যাবে বা রাখা যাবে না, এই সময়টিকে তিনটি আলাদা সময়ে ভাগ করা যায়।

প্রথম তিন মাস

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, এই সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গর্ভের সন্তানের জন্য। এই সময়ই গর্ভের সন্তানের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠন হয়। নির্দিষ্ট পরিমানে পুষ্টি, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ও পানির সুষ্ঠ সরবরাহ প্রয়োজন এই সময়ে। মায়ের শরীরে কোনো কিছুর ঘাটতি থাকলে তার অনাগত সন্তানের শরীরে পরতে পারে ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব। তাছাড়া গর্ভবতী নারীর প্রথম তিন মাসে বমির ভাব বেশি আসে, তার ক্ষুধা মন্দা হয়, তার ওজন কমে যায়। তাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা এই সময়ে রোজা না রাখতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

মধ্যবর্তী তিন মাস

এই সময়টা গর্ভবতী মা কিছুটা সুস্থ থাকেন, কিছুটা ভালো অনুভব করেন। অন্যকোনো শারীরিক অসুস্থতা না থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখতে পারেন।

শেষের তিন মাস

শেষের তিন মাস গর্ভবতী মা এবং তার অনাগত সন্তান,উভয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে শিশু খুব দ্রুত বড় হতে থাকে। তার প্রচুর পুষ্টি দরকার হয়। এজন্য তার মা’র প্রচুর খাবার খাবার খাওয়া প্রয়োজন হয়। এজন্য এই সময়টা ডাক্তাররা রোজা রাখতে নিষেধ করেন।

গর্ভবতী নারীর রোজার খাদ্যতালিকা

যদি একজন গর্ভবতী মা রোজা রাখতে চান তবে তার খাবার কেমন হবে তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাহলে জেনে নেয়া যাক একজন রোজাদার গর্ভবতী নারীর খাবারের মেন্যু।

সেহেরিতে কি খাবেন

গরমের সময় রোজা হলে পানিশুন্যতা ও লবনের ঘাটতি তৈরি হতে পারে। তাই খেয়াল রাখতে হবে পানি পানের বিষয়টিতে। তাছাড়া স্বাভাবিক খাবার, ক্যালরি ও আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে। বেশি ভারী খাবার, ভাজা-পোড়া ও তৈলাক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। মেন্যুতে সবজি, ছোট মাছ থাকতে পারে। যেকোনো একটি বা দুইটি ফল যেমন, আপেল, কলা,খেজুর থাকতে পারে।

ইফতারিতে কি খাবেন

ইফতারির খাবার একজন গর্ভবতী নারীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্থমেই এমন সব খাবার পরিহার করতে হবে, যা খেলে পেটে গ্যাস হতে পারে বা পেট ফাঁপা দিতে পারে। ইফতারিতে সহজ পাচ্য খাবার খেতে হবে। তালিকায় প্রচুর তরল খাবার রাখতে হবে। বিভিন্ন ফল, জুস,সালাদ, প্রোটিনযুক্ত খাবার যেমন, মাছ, মাংশ, গমের আটার রুটি রাখা যেতে পারে। 

একজন গর্ভবতীর জন্য আদর্শ খাবার

একজন গর্ভবতী নারীর খাবার সব সময় ই গূরুত্বপূর্ণ। সহজ পাচ্য, আঁশযুক্ত, ক্যালরিযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে। তাছাড়া বেশি বেশি পানি পান করতে হবে, তরল খাবার খেতে হবে। ফল খেতে হবে। প্রতিদিন একটি আপেল বা পেয়ারা বা দুইটি কলা খাওয়া যেতেপারে। গাজর, শসা দিয়ে সালাদ খাওয়া। রঙিন শাক-সবজি খেতে হবে বেশি বেশি।

সতর্কতা ও বিশ্রাম 

একজন সন্তান সম্ভবা মা’র সারাদিনের কর্ম তালিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, তার বিশ্রাম এর অংশ। বিশ্রাম তার অতি প্রয়োজন। তাকে থাকতে হবে দুশ্চিন্তামুক্ত, নিতে হবে নিয়মিত বিশ্রাম। সতর্ক থাকতে হবে দৈনন্দিন কাজ কর্মে। অতি পরিশ্রম বা কোনো ভারি কাজ, ভারি বস্তু তোলার মত ঝুকিপূর্ন কাজ করা যাবে না। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, গর্ভাবস্থায় একটি অসতর্কতা তার সারাজীবনের স্বপ্ন ভঙ্গের কারন হতে পারে। 

জরুরী অবস্থায় করণীয় 

যে কোনো জরুরী অবস্থায় কালক্ষেপন না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। যেমন, মাথা ঘুরে পরে যাওয়া, পেটে বাচ্চার নাড়াচাড়া অনুভব না হলে, খিচুনি উঠলে, পেটে বেশি ব্যাথা হলে।

রোজা ব্যতিত তার অন্যান্য সকল ইবাদতই সে নিয়মিত করতে পারবে। তার বেশি বেশি ইবাদতই করা উচিত। তবে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে কখনো কখনো কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন হতে পারে। 

গর্ভবতী নারীর স্বাভাবিক অসুস্থতা

  • পায়ে পানি আসা।

  • রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া ও চোখে ঝাপসা দেখা।

  • সকালে ঘুম থেকে উঠার পর মাথা ঘুরানো, বমি ভাব আসা বা বমি আসা।

  • কোমরে ব্যাথা। প্রায় ৫০ শতাংশ মেয়ে কোমরে ব্যাথায় ভুগে। ওজন বৃদ্ধি, কোষ্ঠ্যকাঠিন্য, প্রসাব এ সংক্রমন এর জন্য দায়ী।

  • ঘন ঘন প্রসাব জনিত একটি সমস্যা  প্রথম ৮-১২  সপ্তাহ একজন গর্ভবতী ভোগ করেন।

এইসব অসুস্থতা মাত্রা ছাড়ালে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। 

 

অতএব, রোজা রাখার ক্ষেত্রে গর্ভবতী নারীদের নিমোক্ত বিষয়গুলি খেয়েল রাখতে হবে-

১। শারীরিক অবস্থা ভালো হলে রোজা রাখুন।

২। রোজা রাখার পূর্বে নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে নিজে ভাবুন এবং আপনার ডাক্তার এর সাথে আলোচনা করুন। 

৩। রোজা রাখতে না পারলে সুস্থ হয়ে কাযা আদায় করুন। 

একজন নারীর সারাজীবনের স্বপ্ন মা হওয়া। সাওম পালনও অবশ্য পালনীয় ফরজ ইবাদত। কিন্তু ইসলাম যেহেতু একজন অসুস্থ নারী বা একজন গর্ভবতী নারীর ব্যাপারে নমনীয় সেহেতু সাবধানতা অবলম্বন করা শ্রেয়।

Default user image

খন্দকার মোঃ শওকত হোসেন, লেখক, আস্থা লাইফ

বরিশাল এর নিভৃত ও মনোরম একটি গ্রামে জন্ম। সাহিত্য অনুরাগী মা-বাবার কাছেই লেখালেখির হাতেখড়ি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করলেও লেখালেখির দিকেই ঝোঁকটা বেশি। তাই অবসরে লেখালেখির চেষ্টা করি। লেখনীর মাধ্যমে যদি কারো উপকার করা যায় কিংবা কোন পরিবর্তনের সূচনা করা যায়, তাহলে তৃপ্তিটা আসে মন থেকে। এই উদ্দেশেই আস্থা লাইফ পরিবারে যোগ দেয়া। আমার লেখার মাধ্যমে কারো মধ্যে কিঞ্চিৎ সচেনতাও যদি সৃষ্টি করতে পারি, সেইটাই হবে পরম পাওয়া।

Related Articles