গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাস : প্রাথমিক বিপদ চলে গেলেও থাকতে হবে সতর্ক
বলা হয়, একজন মায়ের জন্য গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস বা ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার পার করাই নাকি সবচেয়ে কঠিন। আপনি যদি এখন প্রেগনেন্সির চতুর্থ মাসে পা দিয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে অভিনন্দন। কঠিন একটা সময় আপনি পার করে ফেলেছেন। তবে বিপদ কিন্তু এখনও কাটেনি, চলতে হবে সতর্ক ভাবেই।
পূর্ববর্তী ব্লগগুলোতে আমরা যথাক্রমে গর্ভাবস্থার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মাস নিয়ে আলোচনা করেছি। প্রথম তিন মাস ফার্স্ট ট্রাইমেস্টারের অন্তর্ভুক্ত। ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার শেষ হবার পর সেকেন্ড বা দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার শুরু হয়। চতুর্থ মাস সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারের প্রথম মাস। এই চতুর্থ মাস অর্থাৎ তের, চৌদ্দ, পনের এবং ষোলতম সপ্তাহ নিয়েই আজকে আমরা টুকটাক গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় জেনে নেব।
চতুর্থ মাসে বাচ্চার পরিবর্তন
চতুর্থ মাসে বাচ্চার আকার প্রায় ৬ থেকে ৭ ইঞ্চি মতন হয়ে যায়। এ সময় বাচ্চার মুখ চোখের গঠন অনেকটা স্পষ্ট হয়, ত্বকের নীচের ফ্যাট সেল তৈরি হওয়া শুরু হয়। হাত ও পা নমনীয় হয়, অনন্য অদ্বিতীয় আঙুলের ছাপ তৈরি হয়। এ ছাড়াও কিডনী বা রেচন তন্ত্র কার্যকর হতে শুরু করে, হাড় ও পেশী বিকশিত হয়।
মায়ের কি কি উপসর্গ দেখা যায়
গর্ভাবস্থার সকল উপসর্গের পেছনে 'প্রেগনেন্সি হরমোন' - এর একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে, সকল উপসর্গ এই হরমোনের কারণেই হয়ে থাকে।
গর্ভবতী মায়ের প্রথম দিককার বেশ কিছু লক্ষণ উপসর্গ চতুর্থ মাসে অনেকটাই কমে আসে। বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরানো, কিছু খেতে না পারা এইসব এ সময়ে থাকে না বললেই চলে। তবে স্ফীত স্তন, স্তনের রঙ গাঢ় হয়ে যাওয়া, শ্বাস ঘন হয়ে যাওয়া, জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া, বার বার প্রস্রাবের বেগ হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য এসব সমস্যা চতুর্থ মাসে এসেও বজায় থাকে।
-
মর্নিং সিকনেস থাকে না, তবে ক্লান্তি ভাব, সারাক্ষণ খিটিমিটি করার বিষয়টা থেকে যায়।
-
কুইকেনিং - চতুর্থ মাসে প্রথম বারের মত মা গর্ভের সন্তানের নড়াচড়া টের পান। একে বলা হয় কুইকেনিং।
-
হরমোনের ওঠানামার কারণে দাঁতের মাড়ি নরম ও সংবেদনশীল থাকে। ফলে মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। অল্পস্বল্প রক্ত পড়লে তাতে চিন্তিত হবার প্রয়োজন নেই। ব্রাশ করার সময় সতর্ক থাকা এবং নরম হালকা টুথব্রাশ ব্যবহার করাই যথেষ্ট। তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে নিকটস্থ দন্ত বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
-
হার্টবার্ন বা বুক জ্বালা পোড়া - অনেক প্রেগন্যান্ট মায়েরই হার্টবার্ন বা বুক জ্বালা পোড়া হয়ে থাকে। এ সময় পরিপাক ক্রিয়া ধীর গতিতে চলে, ফলে অম্বল বা বুক জ্বালা পোড়ার মত সমস্যা দেখা দেয়। এ সমস্যা এড়ানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, একবারে বেশি না খেয়ে অল্প অল্প করে বারে বারে খেতে হবে।
-
শ্বাসকষ্ট - ক্রমাগত বাড়তে থাকা জরায়ু ফুসফুসের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে চতুর্থ মাস সহ পরবর্তী মাসগুলোতে সামান্য শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এতে ভয় পাবার কিছু নেই। তবে শ্বাসকষ্ট বেশি মাত্রার হলে কিংবা শ্বাসকষ্টের জন্য রোজকার কাজকর্ম ব্যাহত হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
-
যেহেতু জরায়ুর আকার দিন দিন বেড়েই চলেছে, তাই বার বার প্রস্রাবের বেগ হওয়া খুবই স্বাভাবিক এ সময়ে। আর এই বাড়তে থাকা জরায়ুর কারণে পিঠ, উরু এবং কুঁচকিতে ব্যথা হতে পারে।
-
মায়ের উরুতে হালকা লাল রঙের শিরার মত দেখা যায়, একে বলে 'ভেরিকোজ ভেইন'। বাচ্চার জন্মের পর এগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়।
-
গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে হরমোন শরীরে উপস্থিত থাকে। এ কারণে মায়ের ত্বক শুষ্ক ও বিবর্ণ হয়ে যায়। নিয়মিত লোশন ও অন্যান্য স্কিন প্রডাক্ট ব্যবহার করে ত্বকের যত্ন নিতে হবে।
-
অনেক মা এ সময় হাত পা বিশেষ করে পায়ের পাতা ফুলে যাবার অভিযোগ নিয়ে আসেন। এই ফুলে যাওয়াটা দুই ধরনের হতে পারে। একটা ফিজিওলজিকাল বা প্রেগনেন্সির স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, অন্যটা প্যাথোলজিকাল বা অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া। স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলে কিংবা ঘুম থেকে ওঠার পর ফোলাভাব কমে যাবে। এ নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নেই। তবে প্যাথোলজিকাল হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
-
হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মায়ের যোনিপথ থেকে অতিরিক্ত স্রাব নির্গত হয়।
মায়ের করণীয়
-
এ সময় মাকে বাম দিকে কাত হয়ে শোবার জন্য বলা হয়। এর ফলে প্লাসেন্টায় রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় যা শিশুর বেড়ে ওঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
-
দিন দিন মায়ের বেবি বাম্প প্রকট হয়ে ওঠে। তাই মাকে অবশ্যই ঢিলাঢালা আরামদায়ক পোশাক বেছে নিতে হবে।
-
নিয়মিত এক্সারসাইজ করলে পরবর্তীতে তা বাচ্চা ডেলিভারিতে সাহায্য করে। এজন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত। নিদেনপক্ষে রোজ আধা ঘন্টা হলেও হাঁটা উচিত।
-
নিয়মিত ৭ থেকে ৮ ঘন্টার ঘুম গর্ভবতী মায়ের জন্য খুবই জরুরি।
-
আগেও বলেছি, গর্ভবতী মায়ের মদ্যপান বা ধূমপান করা একেবারেই চলবে না। মায়ের মদ্যপানের কারণে বাচ্চার 'ফিটাল এলকোহল সিনড্রোম' বা এফএএস (FAS) হতে পারে। ধূমপানের কারণে নবজাতক অস্বাভাবিক কম ওজন নিয়ে জন্মাতে পারে।
-
পোষা জীবজন্তুর যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। খুব ভালো হয় যদি এই নয় মাস পরিবারের অন্য কেউ কাজটা করে।
-
ভারী কাজ করা যাবে না।
-
আজকাল শহরে পাঁচতলা কিংবা দশতলায় বাসা নেওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। অনেক বাসাতেই লিফট থাকে না, গর্ভবতী মাকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়, যেটা একেবারেই উচিত নয়। প্রয়োজন হলে বাসা বদলে নীচতলা কিংবা দুই - তিনতলায় বাসা নিতে হবে।
-
প্রথম তিন মাস পার হয়ে যাবার পর সহবাস নিরাপদ ধরে নেয়া হয়। যদি কোনো মায়ের বার বার মিসক্যারেজ হওয়ার হিস্ট্রি থাকে, তবে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
মায়ের খাবার তালিকা
-
প্রথম তিন মাসের মত চতুর্থ মাসেও মায়ের খাবারের দিকে সর্বোচ্চ নজর দেয়া উচিত। ভিটামিন সহ অন্যান্য খাদ্যগুণ মা যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দরকার হলে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ভিটামিন মিনারেল সাপ্লিমেন্টেশন খেতে হবে।
-
ক্রমবর্ধমান বাচ্চার কারণে মায়ের শরীরে আয়রনের প্রচুর চাহিদা থাকে। তাই প্রচুর পরিমাণে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার মাকে খেতে হবে। দরকার হলে এর সাথে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া যেতে পারে।
-
হার্টবার্ন কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি পরিপাক সংক্রান্ত সমস্যা এড়ানোর জন্য ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে।
-
ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটানোর জন্য দুধ, দই, পনির এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবার খেতে হবে। অনেক মা এসময় দুধ থেকে গন্ধ পান, দুধ খেলে বমি হয় - এসব সমস্যার কারণে দুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। এটা একেবারেই উচিত নয়। গর্ভস্থ সন্তানের হাড়ের সঠিক বিকাশের জন্য দুধ খাওয়া খুবই জরুরি। নিতান্তই অসুবিধা হলে দুধ থেকে ছানা, পিঠা, পায়েশ, মিষ্টি বানিয়ে হলেও খেতে হবে।
-
কি কি খাবেন না - ১. বাইরের যেকোনো খাবার ২. কাঁচা বা আধাসিদ্ধ খাবার ৩. অতিরিক্ত ক্যাফেইন যুক্ত খাবার বা পানীয় ৪. যেকোনো ধরনের সী ফুড
গর্ভবতী মায়ের ওজন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য শারীরিক পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক এবং শারীরবৃত্তীয় একটি বিষয়। সন্তান জন্মের পর মায়ের শারীরিক গঠন আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। তাই ওজন বৃদ্ধি কিংবা বাড়তে থাকা পেট নিয়ে মায়ের অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই। অনেক মা এসব নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন, অনেকে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার মত ক্রনিক সমস্যায় আক্রান্ত হন। পরিবারের সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
কখন যাবেন ডাক্তারের কাছে?
-
যোনীপথে ব্লিডিং হলে - যত অল্পই হোক না কেন, এ সময়ে অল্প স্বল্প ব্লিডিংও ভয়ের কারণ হতে পারে। তাই রক্তপাত হলেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
-
ক্রমাগত পেটে ব্যথা এবং মাথা ব্যথা হলে
-
বার বার সংক্রমণ হলে
-
খিচুনি হলে
-
সংজ্ঞাহীন হয়ে পরলে
গর্ভাবস্থায় প্রতি মাসে অন্তত একবার ডাক্তার কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে গিয়ে মায়ের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করানো উচিত। মায়ের ওজন, ব্লাড প্রেশার, সিমফাইসিও ফান্ডাল হাইট (SFH), ইডেমা বা পায়ের ফোলাভাব, বাচ্চার হৃৎস্পন্দন পরীক্ষা - এসব করানো উচিত। কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে পরবর্তীতে ল্যাব ইনভেস্টিগেশন করানো যেতে পারে।
প্রথম তিন মাস পার করে ফেলতে পারলে মায়েদের অসুবিধা অভিযোগ অনেকটাই কমে আসে। গর্ভপাতের আশঙ্কা কমে যায়, অন্যান্য সমস্যাও কিছুটা হলেও কমতে শুরু করে। মায়ের মন মেজাজও আগের মাসগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো থাকে। কিন্তু তাই বলে গর্ভবতী মায়ের যত্ন নেয়া কমিয়ে ফেলবেন না যেন! স্বামী থেকে শুরু করে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, কর্মজীবনের প্রতিটি মানুষের উচিত এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যথাসম্ভব মাকে সাহায্য করা। গর্ভবতী মা এবং মায়ের ভেতর বাড়তে থাকা নতুন মানুষটার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে।