গর্ভাবস্থার নবম মাস: শেষ ভালো যার, সব ভালো তার
গর্ভাবস্থার নবম মাসে গর্ভবতী নারীর শারীরিক পরিবর্তন, শিশুর বৃদ্ধি, খাদ্যাভাস, ডেলিভারি তারিখ, চিকিৎসক পরিদর্শন, বিশেষ ব্যবস্থা এবং করণীয় নিয়েই আজকের আলোচ্য বিষয়।
বলা হয়ে থাকে, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। নবম মাসকে স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার শেষ মাস হিসেবে ধরা হয়। আর ৩৬তম থেকে ৪০তম সপ্তাহ মিলে নবম মাস। এই শেষ মাসে এসে মায়েদের প্রতীক্ষা প্রায় অসহনীয় হয়ে ওঠে। গুণে গুণে আটটি মাস যদিও বা পার হয়, নবম মাস যেন আর পার হতে চায় না। মায়েরা এই মাসে শিশুর জন্ম এবং জন্ম পরবর্তী নানান সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। আজকে তাহলে এই শেষ মাসটা নিয়েই কিছু খুটিনাটি কথা জেনে নেয়া যাক।
মাতৃগর্ভে শিশুর বৃদ্ধি
এই পর্যায়ে শিশুর ওজন হয় ছয় থেকে নয় পাউন্ড বা চার কেজির মতন। বাচ্চা প্রায় ১৮ থেকে ২০ ইঞ্চি লম্বা হয়।
৩৯ সপ্তাহের গর্ভাবস্থাকে 'ফুল টার্ম প্রেগনেন্সি' হিসেবে ধরা হয়। এ সময়ে শিশু ভার্টেক্স অথবা ব্রিচ নামক পজিশনে অবস্থান করে।
ফুল টার্ম প্রেগনেন্সিতে “লাইটেনিং” ('Lightening') নামক একটি বিষয় দেখা যায়। জন্মের প্রস্তুতি হিসেবে বাচ্চার মাথা পেলভিসের ভিতরের দিকে চলে যায় এবং সেখানেই স্থির হয়ে থাকে। ফলে মায়েরা আগের চেয়ে কিছুটা হালকা বোধ করেন। উপরের পেটের চাপ চাপ ভাব, নিশ্বাসের কষ্ট একটু হলেও কম বোধ হয়৷ এই অবস্থাকে Lightening বলে। তবে বাচ্চা নিচের দিকে চলে যাওয়ায় ব্লাডার বা মূত্রথলির উপর চাপ আরো বেড়ে যায়। ফলে বার বার প্রস্রাবের বেগ হতে থাকে।
নবম মাসে মায়ের খাদ্যাভ্যাস
আঁশযুক্ত খাবার
তাজা সবজি, ফল, শস্য জাতীয় খাবার, রুটি এসব খাবার খেতে হবে৷
ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার
গর্ভাবস্থার শেষ দিকে ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার অবশ্যই খেতে হবে। বাড়ন্ত শিশুর হাড় মজবুত করার জন্য ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবারের কোনো বিকল্প নেই। চিজ, পনির, বিভিন্ন ডেইরি প্রডাক্ট, ড্রাই ফ্রুটস এসব নিয়মিত খেতে হবে।
আয়রন যুক্ত খাবার
গর্ভবতী মায়েদের শেষ ট্রাইমেস্টারে আয়রনের ঘাটতি দেখা যায়। তাই আয়রন সাপ্লিমেন্টের পাশাপাশি আয়রন আছে এমন খাবার প্রচুর পরিমাণে খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত।
ভিটামিন সি যুক্ত খাবার
টক জাতীয় ফল, সবুজ শাক সবজি, টমেটো, ফুলকপি এসব খাবারে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। এসব খাবার নিয়মিত খাওয়া উচিত৷
নবম মাসে মায়েদের সাধারণ কিছু সমস্যা
বার বার প্রস্রাবের বেগ
গর্ভবতী মায়ের এই সমস্যাটি একদম গর্ভাবস্থার প্রথম মাস থেকে চলতে থাকে। আমাদের গর্ভাবস্থা সংক্রান্ত প্রতিটি ব্লগে কম বেশি এই সমস্যার কথা এসেছে। সত্যি বলতে কি, বাচ্চা যতদিন গর্ভে আছে ততদিন এই সমস্যা চলতেই থাকে৷ তবে বাচ্চার সাইজ যত বড় হয়, সমস্যাও তত বাড়তে থাকে। বার বার বাথরুমে যাওয়াটা অস্বস্তিকর, তবে তার চেয়েও বেশি অস্বস্তি হয় যদি প্রস্রাব লিক হতে থাকে৷ সেক্ষেত্রে প্যান্টি লাইনার বা সব সময় পরে থাকা যায় এমন পাতলা কোনো প্যাড ব্যবহার করতে পারেন।
পায়ের ফোলা ভাব
এক্সট্রা ফ্লুইড রিটেনশন এবং প্রেগনেন্সি হরমোনের কারণে পা এবং পায়ের পাতায় ফোলা ফোলা ভাব থাকতে পারে। এ সমস্যা কমানোর জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং শোবার সময় পা দুটো শরীরের চেয়ে উঁচুতে রাখতে হবে। ঘুমানোর সময়ে পায়ের নীচে বালিশ রাখলে সাধারণত এই ফোলাভাব কমে যায়।
ব্যাক পেইন বা পিঠে ব্যথা
ইউটেরাস যত বড় হয়, ততই মায়ের শরীরের ভার বাড়তে থাকে। এছাড়াও আসন্ন সন্তান জন্মদান সহজ করার জন্য প্রেগনেন্সি হরমোন কাজ করতে শুরু করে যেন পেলভিসের জয়েন্টগুলো রিলাক্স হয়ে যায়৷ সব কিছু মিলিয়ে ব্যাক পেইন হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার শেষ দুই মাস এই সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দেয়। সেজন্য শোয়া বসার পজিশন ঠিক রাখতে হবে, আরামদায়ক ও নরম জুতা পরতে হবে এবং প্রয়োজন হলে গরম পানির সেঁক দিতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না।
স্ট্রেচ মার্কস
হবু মায়েদের জন্য স্ট্রেচ মার্কস একটি কমন সমস্যা। দিন দিন গর্ভের শিশু বড় হচ্ছে, ফলে ইউটেরাসের আকার বাড়সে, সেই সাথে বাড়ছে মায়ের পেট। ফলে চামড়া ফেটে সাদা সাদা দাগ তৈরি হচ্ছে৷ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাচ্চা জন্মানোর পর আস্তে আস্তে এই দাগ গুলো মিলিয়ে যায়। এই সমস্যা কমাতে ভালো কোনো ময়েশ্চারাইজার নিয়মিত ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রতি সপ্তাহে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে
ফুল টার্ম প্রেগনেন্সি মানে এখন যেকোনো দিন যেকোনো সময় আপনার প্রসব ব্যথা শুরু হতে পারে৷ যদিও নিজেদের নির্ধারিত সপ্তাহে সন্তানের জন্ম দেয় এমন মায়েদের সংখ্যা খুবই কম, মাত্র ৪%। তাই নবম মাসে প্রতি সপ্তাহে একবার, প্রয়োজনে দুইবার চিকিৎসকের কাছে চেক আপের জন্য যেতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে ঘরেই চেক লিস্ট তৈরি করে কিছু বিষয় নোট করে রাখতে হিবে। যেমন -
-
মায়ের ওজন
-
রক্তচাপ
-
বাচ্চার হার্টবিট
-
ফান্ডাল হাইট
-
বাচ্চার পজিশন
-
কিক কাউন্ট
-
প্রাকটিস কনট্রাকশনের হার
-
পায়ের পাতায় ফোলা ভাব ( ফিজিওলজিকাল ফোলা ভাব রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যায়, তবে ফোলাভাবের সঙ্গে মাথা ব্যথা, পেটে ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখার মত উপসর্গ যুক্ত হলে প্রেগনেন্সি সংক্রান্ত উচ্চ রক্তচাপ অর্থাৎ প্রি একলাম্পসিয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।)
এছাড়াও নবম মাসে রুটিন চেক আপের অংশ হিসেবে মায়ের ভ্যাজাইনাল সোয়াব নেয়া হয় এবং এ থেকে স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
নিতে হবে কিছু বিশেষ ব্যবস্থা
-
নির্দিষ্ট সময়ের পরও প্রসব আপনা আপনি শুরু না হলে 'Induced Labor' করতে হতে পারে। আগে থেকেই এ বিষয়ে চিকিৎসকের সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ আলোচনা সেরে রাখুন।
-
ডেলিভারি কোথায় হবে বাড়িতে নাকি হাসপাতালে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বাড়িতে হলে বিছানাপত্র, বড় গামলা,জীবাণুমুক্ত ব্লেড, হেক্সিকর্ড সহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনে রাখতে হবে। এবং ডেলিভারির সময় অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ধাত্রীকে উপস্থিত থাকতে হবে৷
-
আর ডেলিভারি হাসপাতালে হলে সেখানে অন্তত ৩ দিন থাকার মত প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি আগেই গুছিয়ে একটা ব্যাগে ভরে রাখতে হবে।
-
হাসপাতালে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাম্বুলেন্স কিংবা অন্য কোনো যানবাহন আগে থেকেই ঠিক করে রাখতে হবে।
-
বাচ্চার জন্মের পর স্বভাবতই মা খুব দুর্বল হয়ে পড়েন। নতুন বাচ্চা ও নিজের দুর্বল স্বাস্থ্য - সব মিলিয়ে মায়ের পক্ষে ঘরের অন্য কোনো দিকে নজর দেয়া সম্ভব হয় না। রান্না বান্না, অন্য বাচ্চার দিকে খেয়াল রাখা এসব কাজের জন্য আগেই অন্য কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া উচিত।
-
বাচ্চার ডায়পার থেকে শুরু করে মায়ের দুধ খেতে না পারলে বিকল্প দুধের ব্যবস্থা এই সময়েই করে রাখতে হবে।
কিভাবে বুঝবেন প্রসব বেদনা আসল কিনা
ট্রু লেবার পেইন বা প্রসব বেদনা শুরু হবার আগেই অনেকের ব্রাক্সটন হিকস কনট্রাকশন হয়ে থাকে৷ একে প্রাকটিস কনট্রাকশন বলা হয়। এই কনট্রাকশন সাধারণত পজিশন চেঞ্জ করলেই কমে যায়। সেক্ষেত্রে চিন্তার কিছু নেই। তবে ট্রু লেবার পেইন শুরু হলে মাকে তাড়াতাড়ি নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। লেবার পেইন বা প্রসব ব্যথার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যা থেকে বোঝা যায় এটা ট্রু লেবার পেইন নাকি প্রাকটিস কনট্রাকশন। ট্রু লেবার পেইন প্রগ্রেসিভ ধরনের হয়, একবার ব্যথা শুরু হলে ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। কনট্রাকশন গুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর হতে থাকে এবং আস্তে আস্তে দুইটি কনট্রাকশনের মধ্যবর্তী সময় কমে আসে। এর পাশাপাশি সারভিক্স বা জরায়ুমুখ প্রসারিত হতে থাকে। কোনো ধরনের ওষুধ পত্র কিংবা পজিশন চেঞ্জ, কোনোভাবেই এই ব্যথা কমানো যায় না। এই লক্ষণ গুলো যদি মায়ের মধ্যে দেখা যায় এবং মা যদি নবম মাসের গর্ভবতী হন, তবে ধরে নেয়া যেতে পারে তার প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে। এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে।
খুব শিগগিরই আপনি নতুন সন্তানের মুখ দেখতে চলেছেন। হবু মাকে আমার ও আস্থা পরিবারের পক্ষ থেকে আগাম শুভকামনা। সেই সাথে গর্ভাবস্থার মত সন্তানের জন্মের পরেও যেন সুস্থ সুন্দর ভাবে প্রতিটি দিন অতিবাহিত হয়, সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভাবে ভবিষ্যৎ। আর এই ভবিষ্যৎ গড়ার প্রধান কারিগর আমাদের গর্ভবতী মায়েরা। তাই গর্ভবতী মায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া আমাদের সকলের কর্তব্য।