কর্মজীবী মায়েদের প্যারেন্টিং যেমন হওয়া উচিৎ

যে কোন কর্মজীবী মায়ের জন্য সন্তানের সঠিক যত্ন নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আপনার পূর্ব প্রস্তুতি, ধৈর্য, সহনশীলতা, এবং ইতিবাচক চিন্তাধারা প্রয়োজন। আপনার এই পথ চলাকে আরো কিছুটা সহজ করার জন্য এখানে রইল সন্তান লালন পালনের কিছু টিপস।

গল্পটি একজন কর্মজীবী মায়ের। দেশের স্বনামধন্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনের পর ৭ বছরের সফল ক্যারিয়ারে ৩টি প্রোমোশন নিয়ে যখন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছেন ঠিক তখনই ৬ মাসের শিশু কন্যাটির দেখাশোনা নিয়ে পড়লেন চরম বিপাকে। ফলাফল মেয়ের জন্য অতীব সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারে ইতি টেনে কর্মজীবী মা হয়ে গেলেন পুরোপুরি গৃহিণী। 

তবে সব মা এভাবে হার মেনে নেন না, সন্তান লালন পালনের পাশাপাশী খুব সফলতার সাথেই তাদের কর্মজীবন সচল রাখেন তবে তাদের যাত্রাপথ খুব সহজ হয় না। সন্তানের সঠিক যত্ন নিয়ে প্রতিনিয়ত তারা অলিখিত যুদ্ধ করে চলেন। তাদের এই যুদ্ধকে সহজ করে তুলতে আজকের এই আর্টিকেলে কর্মজীবী মায়েদের জন্য শিশুর যত্নের সহজ কিছু সমাধান নিয়ে আলোচনা করবো।  

মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে অফিসে ফেরার সময় যা করতে হবে 

সন্তানের সঠিক যত্ন ও লালনপালনের প্রয়োজনে অনেক সময় একজন কর্মজীবী মা নিজের ক্যারিয়ার মাঝপথে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রে আত্মঘাতী হয়ে যেতে পারে। তাই শুরুতেই হাল ছেড়ে না দিয়ে বিকল্প পথ খোঁজা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে। চলুন দেখি কোন বিষয়গুলো আপনার মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে কাজে অফিসে ফেরা সহজ করে তুলবে-

মানসিক প্রস্তুতি নিন

সবার আগে নিজে মানুষিকভাবে প্রস্তুত হোন। নিজেকে বোঝান যে এখন থেকে প্রতিদিন আপনাকে প্রানপ্রিয় শিশুটি থেকে দিনের বেশ কিছুটা সময় দূরে থাকতে হবে। এখন থেকে বাসা এবং অফিসের পাশাপাশী সন্তানের দেখভালও করতে হবে। এক্সট্রা কিছু শারীরিক এবং মানুষিক চাপ নিতে হবে। এবং সবশেষে আপনি যে এই সবকিছুই সামলে নিতে পারবেন এমন ইতিবাচক মনোভাব রাখতে হবে। 

কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগ করুন

যেহেতু আপনি অনেকদিন কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে ছিলেন, তাই এই সময়ের মধ্যে অফিসে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হয়েছে কিনা, নতুন কোন রুল তৈরি হয়েছে কিনা ইত্যাদি জেনে নিন। আপনার বস আপনার উপর নতুন কোন দায়িত্ব অর্পনের চিন্তা করছে কিনা অথবা পুনরায় যোগদানের পর কি পরিমান কাজের প্রত্যাশা রাখছে সেটাও জানার চেষ্টা করুন। এতে কর্মক্ষেত্রে নিজের সেরাটা উপস্থাপনের আত্মবিশ্বাস পাবেন।

শিশুর দায়িত্ব কাকে দিবেন তা ঠিক করুন

একজন কর্মজীবী মায়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত হল সন্তানের দায়িত্ব অন্য কাউকে অর্পন করা। আপনার নিকট কোন আত্মীয়, ডে-কেয়ার সেন্টার অথবা কোন গৃহ পরিচারিকা যার কাছেই শিশুকে রাখতে চান না কেন, কিছুদিন আগে থেকেই শিশুকে তার সাথে রাখার ব্যবস্থা করুন। এতে শিশুটিও মা ছাড়া অন্য একজনের সাথে পরিচিত হয়ে উঠবে এবং আপনিও বুঝে যাবেন যে আপনার শিশুর জন্য ব্যক্তিটি নিরাপদ কিনা। 

দায়িত্ব ভাগ করে নিন

ঝামেলা এড়াতে সাংসারিক কাজগুলো ভাগ করে নিন। আপনার স্বামীর সাথে আলোচনা করে কে কতটুকু সময় দিতে পারবেন এবং কোন কাজের দায়িত্ব কে নিবেন তা ঠিক করে নিন। মনে রাখতে হবে যে, সন্তান কেবল একা মা অথবা বাবার দায়িত্ব নয়, উভয়কেই নিজ নিজ দায়িত্ব শতভাগ পালনের চেষ্টা করতে হবে। শিশুর যত্ন নেয়া থেকে শুরু করে গৃহস্থালির কাজকর্ম নিজ নিজ অবসর সময় হিসেব করে আগেই ভাগ করে নিন। এতে দুজনেই নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত থাকবেন এবং সঠিক সময়ে পালন করতে পারবেন।

নিজের নতুন প্রয়োজনগুলো সম্পর্কে জানুন

একটি শিশু মায়ের জীবনে অনেক নতুন দায়িত্ব নিয়ে আসে। আর এত সব নতুন দায়িত্ব পালনের জন্য নতুন নতুন প্রয়োজন বা চাহিদা যুক্ত হতে শুরু করে। তাই আগেই আপনার নতুন প্রয়োজনগুলোর একটা তালিকা তৈরি করে নিন।

যেমন ধরুন-মা হওয়ার আগে আপনি হয়তো হঠাৎ আসা কাজের জন্য ওভার টাইম করতে পারতেন অথবা প্রতি সপ্তাহে ভিন্ন এলাকায় ফিল্ড ভিজিটে যেতে পারতেন কিন্তু এখন যেহেতু আপনার ঘরে একটা ছোট্ট শিশু আছে তাই আপনার প্রয়োজন কাজের একটি নির্ধারিত সময়সূচীর। 

নতুন রুটিনে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিন

যে কারো জন্যই হঠাৎ নতুন একটি রুটিনে নিজেকে মানিয়ে নেয়া কঠিন। তাই, কর্মক্ষেত্রে ফেরার আগেই আপনার নতুন রুটিনটি কয়েকদিন ট্রায়াল দিয়ে নিন। এতে পুরোপুরি অভ্যস্ত না হলেও রুটিনটি পরবর্তিতে অনুস্মরণ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

ধরুন, কাজে ফেরার পর আপনাকে সকালে যেসময় উঠতে হবে কয়েকদিন আগে থেকেই সেটা শুরু করে দিন। সন্তানকে স্তন্যপান করালে কিভাবে পাম্পিং করে দুধ সংরক্ষন করবেন সেটাও ট্রায়াল দিন। শিশু কার কাছে থাকবে তার সাথে সন্তানকে বেশী সময় কাটাতে দিন।  

সর্বোপরি ইতিবাচক চিন্তা করুন এবং সবকিছু সহজভাবে দেখার চেষ্টা করুন। আপনার প্রবল ইচ্ছাশক্তি সবকিছুই সহজ করে তুলবে। 

অফিস এর কাজের মধ্যেও শিশুর যত্ন নেয়ার কিছু টিপস 

মাত্র কিছুদিন আগে পৃথিবীতে আসা ছোট্ট শিশুটিকে ঘরে রেখে অফিসে ১০/১২ ঘন্টা সময় কাটানো যে কোন মায়ের জন্যই অনেক কঠিন ব্যাপার। কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার, স্বপ্ন, পরিবারকে সাপোর্ট ইত্যাদি কারনে চাকুরি ছেড়ে আসাও সম্ভব নয়। ফলাফল অপরাধবোধে ভোগা। 

এই অপরাধবোধ থেকে সরে আসুন কারন অফিসের কাজের মধ্যেও শিশুর যথাযথ যত্ন নেয়া সম্ভব। এখানে রইলো কিছু টিপস।

কাজের তালিকা তৈরি করুন

আপনার অফিস এবং বাসার সারাদিনের কাজের একটি তালিকা তৈরি করে নিন। এতে আপনি সারাদিন সুসংগঠিত থাকবেন। এই তালিকাটিতে গুরুত্ব অনুযায়ী কাজের সময় ভাগ করুন। আপনার সন্তানের জন্য বিশেষ কিছু সময় রাখুন। 

যেমন আপনার সন্তানের খাবার তৈরির জন্য প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় রাখুন তালিকাতে। অথবা স্কুল পড়ুয়া শিশুটির হোম ওয়ার্ক করানোর জন্য কিছু সময় রাখুন।

মানসিকভাবে দৃঢ় থাকুন

অপরাধবোধ থেকে বের হয়ে আসুন। আপনি চাকুরিজীবী, এটা কোনভাবেই আপনার অপরাধ নয় বরং এটা আপনার পরিচয়। এমন নয় যে শুধু আপনি চাকুরিজীবী বলেই আপনার সন্তানকে সঠিকভাবে বেড়ে উঠছে না। 

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবী মায়েদের উপর করা একটি গবেষনায় দেখা গেছে যে কর্মজীবী মায়দের কন্যশিশুরা গৃহিণী মায়েদের কন্যশিশুদের তুলনায় বেশী বুদ্ধিমতি, উচ্চশিক্ষিত এবং ক্যারিয়ার সচেতন হয়। 

তাই আপনার ক্যারিয়ার আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে এমন ভাবার কোন কারন নেই। বরং আপনার অপরাধবোধ আপনার এবং আপনার সন্তানের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহনে ভুমিকা রাখতে পারে।  

সকালগুলো সুন্দর হোক

দিনের শুরুটা সুন্দর করুন। আপনি নিজে সকালে কিছুটা তাড়াতাড়ি উঠুন এবং সন্তানকেও উঠিয়ে দিন। দুজনে কিছুটা সময় একসাথে কাটান। একসাথে কিছুটা সময় হেটে আসুন, নাস্তা করুন এবং গল্প করুন। এতে আপনার আর সন্তানের মাঝে সম্পর্ক অনেক স্বচ্ছ হয়ে উঠবে।

অফিসের কাজের মাঝে শিশুর সাথে যোগাযোগ রাখুন

অফিসের কাজের ফাঁকে কিছুটা সময় বের করে ফোনে সন্তানের সাথে যোগাযোগ করুন। যেমন দুপুরে খোঁজ নিন সে খেয়েছে কিনা, স্কুল থেকে কখন ফিরেছে, তার পরীক্ষা কেমন হয়েছে ইত্যাদি। পারলে একটা ভিডিও কল দিয়ে তার সাথে কথা বলুন। এতে সন্তান বুঝবে যে আপনি যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, সন্তানের কথা ভুলে যান নি।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলি শিশুকে দিন

সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলিতে সবার বেশ কিছু কাজের পরিকল্পনা থাকে। তবে আপনি যদি একজন মা হোন তবে আপনার সাপ্তাহিক ছুটির দিনের পরিকল্পনা আপনার শিশুর সাথে করুন। চেষ্টা করুন শিশুকে সর্বোচ্চ সময় দেয়ার। তাকে নিয়ে বাইরে বের হোন। পছন্দের যায়গা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসুন। এমনকি সংসারিক কাজেও তাকে আপনার সাথে রাখুন। এতে সে নিজেকে আপনার জীবনে গুরুত্বপূর্ন একজন ভাবতে পারবে। 

রাতেও শিশুর জন্য সময় রাখুন

অফিস থেকে ফিরে রাতেও শিশুকে আলাদা একটু সময় দিন। পারলে তাকে নিয়ে হাটতে বের হোন। সারাদিন সে কি কি করলো, কেমন সময় কাটালো সেটা জানুন। স্কুলের পড়া দেখিয়ে দিন এবং একসাথে খেতে বসুন। পারিবারিক বন্ধন খাবার টেবিলেই সবচেয়ে বেশি দৃঢ় হয়। 

নিজেকে ভালোবাসুন

সন্তানকে ভালোবাসার পাশাপাশী নিজেকে ভালোবাসাও জরুরি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সুলতানা আলগিন বলেন যে, শিশুর সাথে মানুষিক বন্ধন গড়ে ওঠার জন্য মায়ের মানুষিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা জরুরি।  

অর্থাৎ আপনি মানুষিকভাবে প্রসন্ন না থাকলে শিশুর যত্ন কখনোই ভালোভাবে নিতে পারবেন না। তাই নিজেকে ভালোবাসুন এবং নিজের কাজকে সম্মান করুন। 

অফিসের দুশ্চিন্তা অফিসেই রেখে আসুন

এটা শুধু মা নয়, বাবার জন্যেও জরুরি। অফিসের স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা অফিসেই রেখে আসুন এতে ঘরের শান্তি বজায় থাকবে। আপনিও আপনার শিশুর প্রতি পুরোপুরি মনোযোগী হতে পারবেন। চেষ্টা করুন অফিসের কাজগুলো বাসায় না এনে অফিসেই শেষ করে আসতে।

প্রয়োজনে ছুটি নিন

যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে যোগাযোগ কমিয়ে দিন। অর্থাৎ অফিস পার্টি, কাজ শেষে কলিগদের সাথে আড্ডা ইত্যাদি সামাজিক ব্যাপারগুলো কিছুটা সংকুচিত করে দিন এতে আপনার সন্তানের জন্য বরাদ্দ সময় সম্প্রসারিত হবে। শিশুর অসুস্থতায় প্রয়োজনে ছুটি নিন, আর এই জন্য অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ন কারনে অফিস কামাই করা বন্ধ করুন। 

শেষ কথা 

দিনশেষে আপনি মানুষ তাই আপনারও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে তা মেনে নিন। প্রয়োজনে সাহায্য চান। যে কোন কর্মজীবী মায়ের জন্যই সংসার ও কর্মক্ষেত্র একসাথে সামলিয়ে চলা অনেক কঠিন কাজ। তাই প্রয়োজনে কিছু কাজের দায়িত্ব পরিবারের অন্য সদস্যদেরও দিন। 

সন্তান এবং অফিসের দায়িত্বের চাপে দাম্পত্য সম্পর্ককে অবহেলা করবেন না। মনে রাখবেন আপনার সুখী দাম্পত্য জীবন কেবল সংসারে শান্তিই বজায় রাখবে না আপনাকে বড় বড় দায়িত্ব পালনে মানুষিক শক্তিও যোগাবে। তাই ইতিবাচক থাকুন, সবকিছু সহজ ভাবে দেখার চেষ্টা করুন। সমস্যা যত বড়ই হোক, তার সমাধান আপনি নিশ্চয় করতে পারবেন এমন মনোবল রাখুন। কোন পরিবর্তনে ভয় পাবেন, পরিস্থিতি যায় হোক না কেন, আপনার সন্তান আপনাকে ভালোবাসবেই।

Default user image

সানজিদা আলম, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি একজন ফ্রিল্যান্স কন্টেন্ট রাইটার। বাংলা এবং ইংরেজী উভয় ভাষাতেই লেখি। টেকনোলজি, স্বাস্থ্য, প্রোডাক্ট রিভিউ এবং ইনফরমেটিভ কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। লেখালেখির পাশাপাশি ভালোবাসি পড়তে।

Related Articles