গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় মাসঃ সতর্ক থাকুন এবং নিজের প্রতি যত্নবান হোন
অভিনন্দন! আপনি এখন গর্ভাবস্থার অষ্টম সপ্তাহে পৌঁছেছেন। এই সময়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় মাসের গর্ভাবস্থায় আপনি আশ্চর্যজনক কিছু মুহূর্ত অনুভব করতে যাচ্ছেন।
-
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় মাসে শারীরিক এবং মানসিক লক্ষণগুলি প্রায় প্রথম মাসের মতোই হবে
-
আপনাকে প্রথমবারের মতো ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে এবং দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক বা ট্রাইমেস্টারের শেষ পর্যন্ত কমপক্ষে মাসে একবার দেখা চালিয়ে যেতে হবে
-
আপনার ডাক্তার প্রস্রাব এবং রক্ত পরীক্ষা সহ বেশ কয়েকটি রুটিন পরীক্ষা করতে বলবে
-
এই মাসেও যোনিতে রক্তপাত এবং গর্ভপাত বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে
গর্ভাবস্থার প্রথম মাসের মতো দ্বিতীয় মাসও প্রথম ট্রাইমেস্টারের অন্তর্ভুক্ত। যদিও প্রথম মাসের সাথে দ্বিতীয় মাসের খুব একটা পার্থক্য দেখা যায় না তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মায়েরা দ্বিতীয় মাসে বাস্তবিক ভাবে গর্ভাবস্থা অনুভব করেন। আজকের ব্লগে আমরা গর্ভবতী মায়েদের দ্বিতীয় মাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। সেই সাথে দ্বিতীয় মাসের করণীয়, লক্ষণ, উপসর্গ, যত্ন ও পরিচর্যা, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত ভাবে জানব।
দ্বিতীয় মাসে ভ্রূণের পরিবর্তন
দ্বিতীয় মাসে গর্ভস্থ ভ্রূণ একগুচ্ছ কোষ থেকে ধীরে ধীরে একটি জীবদেহের আকৃতি লাভ করে। যদিও তা দেখে মানুষের ভ্রূণ বলে চেনা যায় না। হাত পা কুঁড়ি আকারে থাকে তবে মাথা, গলা এবং চোখ থাকে সুস্পষ্ট। পরবর্তীতে এই কুঁড়ির মত হাত পা থেকে শনাক্তপযোগী হাত পায়ে পরিণত হয়। হৃৎপিন্ড, যকৃত, যৌনাঙ্গ, স্নায়ুতন্ত্র, মেরুদণ্ড এবং ফুসফুসের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে। অস্থি এবং পেশী গঠিত হয় যদিও বেশির ভাগ অঙ্গই প্রথম দুই মাস পর্যন্ত অনেকটাই অগঠিত অবস্থায় থাকে। তবে দেহের বেশির ভাগ অঙ্গতন্ত্র গঠনের কাজ মূলত দ্বিতীয় মাসেই শুরু হয়।
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় মাসের উল্লেখযোগ্য কিছু লক্ষণ
আগেই বলেছি দ্বিতীয় মাসের লক্ষণ গুলো কিছুটা প্রথম মাসের মতন। সেসব লক্ষণের মধ্যে রয়েছে মর্নিং সিকনেস এবং বমি বমি ভাব, খেতে ইচ্ছা না করা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, স্তনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, বিভিন্ন খাবারের প্রতি অদম্য আকর্ষণ বা ক্রেভিং, জরায়ুতে হালকা টান অনুভূত হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, এসিডিটি, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো ইত্যাদি।
মর্নিং সিকনেস বা সকালবেলার বমি বমি ভাব
সকালবেলা এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি হয়। গর্ভবতী মায়েদের সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর হালকা বমি বমি ভাব হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে বমি হয়ে যেতে পারে আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এটা শুধুমাত্র বমি বমি ভাবেই সীমাবদ্ধ থাকে। এটি সম্পুর্ণ স্বাভাবিক একটি অবস্থা তাই চিন্তিত হবার তেমন কোনো কারণ নেই। তবে যদি এর কারণে দিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয় তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টি এমেটিক ড্রাগ সেবন করা যেতে পারে। এ সমস্যা এড়ানোর জন্য সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সাথে সাথে কাজকর্ম শুরু না করে বরং কিছুটা সময় বিছানায় বসে নিজেকে ধাতস্থ করে নেওয়া ভালো। চেষ্টা করুন যে সমস্ত খাবার খেতে ভালো লাগে এবং অল্প খেলেই পর্যাপ্ত পুষ্টি গুন পাওয়া যায় তেমন খাবার খেতে কারণ বারবার বমি হলে মায়ের শরীর থেকে পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট বের হয়ে যায়। ফলে মায়ের পুষ্টিগুণের অভাব দেখা দিতে পারে।
বারবার বাথরুমে যাওয়া
প্রথম মাসের চেয়ে দ্বিতীয় মাসে জরায়ুর আকার বেড়ে যায়। বাড়তে থাকা জরায়ু বা ইউটেরাস ব্লাডার বা মূত্রথলির উপর ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে। তাই গর্ভবতী মায়ের বারবার প্রস্রাবের বেগ হয়। এটিও 'মর্নিং সিকনেস' এর মতই গর্ভাবস্থার স্বাভাবিক একটি লক্ষণ, তাই অতিরিক্ত চিন্তা না করে স্বাভাবিক পরিমাণে পানি খেতে হবে। অনেক মা বাথরুমে যাবার ভয়ে এসময় পানি খাওয়া কমিয়ে দেন। এর ফলে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা এবং ইউটিআই (ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন) হতে পারে। তখন মায়েরা বার বার প্রস্রাব হওয়ার পাশাপাশি প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া অনুভব করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
স্তনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন
এ সময় স্তনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। এ্যারিওলা বা স্তনের বোঁটা গাঢ় রং ধারণ করে এবং স্তনে ধীরে ধীরে ফ্যাট জমা হয়ে মাকে ব্রেস্ট ফিডিং বা স্তন্যপানের উপযোগী করে তোলে। গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন হরমোনের প্রভাবে দেহে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় তাই স্তনের রক্তনালীগুলো লক্ষণীয়ভাবে চোখে পড়ে।
মন মেজাজের দ্রুত পরিবর্তন
হরমোনের প্রভাবে প্রথম মাসের মত এই মাসেও মায়ের মন মেজাজের কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না। এই ভালো, এই খারাপ। কোনো কারণ ছাড়াই মন খারাপ হওয়া, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ খুশি হওয়া, সারাক্ষণ খিটখিট করতে থাকা, সবার কাজে ভুল ধরা এসব কিছুই গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় মাসে মায়ের স্বাভাবিক একটি লক্ষণ। তবে এ কারণে যেন মায়ের পারিবারিক বা পেশাগত জীবনে কোনো রকম সমস্যার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চাকরি ক্ষেত্রে সহকর্মী কিংবা পরিবারের বাকি সদস্যদের এসময় গর্ভবতী মায়ের প্রতি সহনশীল আচরণ করতে হবে।
এছাড়াও ভ্যাজাইনা থেকে নির্গত স্রাবের ঘনত্বের পরিবর্তন হতে পারে, মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য বা কনস্টিপেশন হতে পারে। মায়ের মুখে বারবার লালা জমে, এসিডিটির সমস্যা বেড়ে যায়, মায়ের রক্ত চাপের পরিবর্তন হতে পারে এবং তা থেকে মাথাব্যথা মাথা ঘুরানোর মত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
দ্বিতীয় মাসে গর্ভবতী মায়ের যত্ন ও সতর্কতা
-
বার বার বমি হলেও মায়ের শরীরে যেন পুষ্টিগুণের অভাব না পড়ে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আগের তুলনায় খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। খাদ্যতালিকায় মাছ, মাংস, দুধ, মৌসুমি ফল যেন অবশ্যই থাকে সেদিকে পরিবারের বাকি সদস্যদের খেয়াল রাখতে হবে।
-
ফলিক এসিডের অভাবে বাচ্চার 'নিউরাল টিউব ডিফেক্ট' হতে পারে। ফলিক এসিড যুক্ত খাবার যেমন সবুজ শাক সবজি, খাদ্যশস্য, কলিজা, ডিম খেতে হবে। প্রয়োজন হলে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্টে সেবন করতে হবে।
-
কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে প্রচুর আঁশজাতীয় খাবার খান।
-
হজমের সমস্যা দূর করতে সহজপাচ্য কম তেল মসলা যুক্ত খাবার খেতে পারেন। তাতে প্রতিকার না হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টাসিড ট্যাবলেট খেতে পারেন। গর্ভাবস্থায় কোনো ওষুধই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া যাবে না।
-
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। বার বার প্রস্রাব হওয়ার ভয়ে পানি খাওয়া কমিয়ে দেবেন না।
-
দ্বিতীয় মাসে ভ্রূণের অঙ্গতন্ত্র গঠিত হয়। এসময় যে কোনো ধরনের সংক্রমণ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। কোনো খাবারই কাঁচা খাবেন না। কাঁচা শাক সবজি, কাঁচা ডিম, সুশি বা কাঁচা মাছ, অপাস্তুরিত দুধ এড়িয়ে চলুন।
-
এসময় যেকোনো সংক্রমণের কারণে মায়ের গর্ভপাত বা এবরশন হতে পারে। তাই সংক্রামক রোগী আছে এমন কোনো জায়গায় মা যেন না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
-
রোজ অন্তত আধা ঘন্টা হালকা ব্যায়াম করতে পারেন। আর কিছু না হোক, খোলা জায়গায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করুন অন্তত। এতে শরীরে রক্ত চলাচল বাড়বে, শিশুর বৃদ্ধিতে এটি খুবই সহায়ক।
-
প্রথম ট্রাইমেস্টারে অর্থাৎ গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস সহবাস না করাই ভালো।
-
ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। উঁচুনিচু রাস্তা এড়িয়ে চলতে হবে। ঝাঁকুনি লাগে এমন রাস্তায় রিক্সা বা গাড়ির বদলে পায়ে হেঁটে চলা বরং নিরাপদ।
-
মাকে এলকোহল বা মদ্যপান ও ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
-
গর্ভবতী মাকে কোনো ধরনের শারীরিক বা মানসিক চাপ দেয়া যাবে না। সব সময় মা যেন হাসি খুশি উৎফুল্ল থাকে সেদিকে আশেপাশের সবার লক্ষ রাখতে হবে।
কখন যাবেন ডাক্তারের কাছে?
আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে গর্ভবতী মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রবল অনীহা দেখা যায়। এটা কখনোই উচিত নয়। প্রথম চেক আপের পর থেকে ডাক্তারের বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট সময় পর পর মাকে চেক আপ করাতে হবে। সাধারণত ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি মাসে এক বার করে চেক আপ করাতে হয়। এছাড়া যেকোনো সময় যেকোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি যেমন প্রবল মাথাব্যথা হলে, যোনী থেকে রক্তপাত হলে, অস্বাভাবিক গন্ধযুক্ত স্রাব নির্গত হলে মাকে সাথে সাথে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা
যেহেতু অনেক মা দ্বিতীয় মাসে নিজের প্রেগনেন্সির ব্যাপারটি বুঝতে পারেন, তাই বেশির ভাগ মায়ের প্রথম এএনসি (ANC) বা এন্টিনেটাল চেক আপ দ্বিতীয় মাসে হয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষার পর চিকিৎসক কিছু রুটিন ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করেন। এইসব পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে রয়েছে -
-
মায়ের ওজন ও রক্তচাপ পরীক্ষা
-
আল্ট্রাসনোগ্রাম
-
এনিমিয়া দেখার জন্য হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা
-
ব্লাড গ্রুপিং এবং Rh টাইপিং
-
ডায়াবেটিস আছে কিনা তা জানার জন্য সুগার পরীক্ষা
-
থাইরয়েড সংক্রান্ত সমস্যা জানার জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন পরীক্ষা
-
প্রস্রাব পরীক্ষা
-
রুবেলা, হেপাটাইটিস বি ইত্যাদি সংক্রামক রোগ আছে কিনা তার পরীক্ষা
-
সিফিলিসের উপস্থিতি শনাক্ত করার জন্য ভিডিআরএল (VDRL) পরীক্ষা
গর্ভাবস্থার প্রতিটি দিন মায়ের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় মাসে দেহের অঙ্গতন্ত্র গঠিত হয়ে মানব ভ্রূণ প্রথম একটি আলাদা সত্ত্বা হিসেবে বিকাশ লাভ করে বলে দ্বিতীয় মাস মা এবং আনাগত শিশু উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। তাই এ সময়ে মাকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং পরিবারের সবাইকে মায়ের দিকে লক্ষ রাখতে হবে।