গর্ভাবস্থার অষ্টম মাস : অপেক্ষার শেষ প্রহর

গর্ভাবস্থার প্রথম সাত মাস কি আপনি পার করে ফেলেছেন? আপনি কি এখন আট মাসের গর্ভবতী? যদি তা হয়ে থাকেন, তবে এই লেখাটি শুধুমাত্র আপনার জন্যই। কারণ, আজ আমরা গর্ভাবস্থার অষ্টম মাস নিয়েই কথা বলব।

৩২তম , ৩৩তম, ৩৪তম এবং ৩৫তম - এই চারটি সপ্তাহ নিয়ে গর্ভাবস্থার অষ্টম মাস গঠিত। শতকরা ৫০ শতাংশ গর্ভবতী মা অষ্টম মাসের শেষ দিকে কিংবা নবম মাসের শুরুর দিকে এসে নিজের সন্তানের মুখ দেখতে পান। কারণ আজকাল শহর বন্দর এলাকায়, এমনকি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নির্ধারিত সময়ের আগেই সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়৷ তাই অষ্টম মাসকে অপেক্ষার শেষ প্রহর বললে অত্যুক্তি হয় না। আসুন তাহলে অষ্টম মাস নিয়ে কিছু কথা জেনে নিই -

অষ্টম মাসে শিশুর বেড়ে ওঠা

এই মাসে শিশুর খুব দ্রুত বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। গর্ভের ছোট্ট শিশুটি প্রায় ১৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি লম্বা হয় এবং ওজন হয় প্রায় ৪ থেকে ৬ পাউন্ড। এই সময় শিশুর ব্রেইনের বিকাশ ঘটে৷ কিডনী ম্যাচুরিটি পায়। ফলে অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের পরিমাণ কমতে থাকে৷ এছাড়াও এই পর্যায়ে বাচ্চার হাত পায়ের নখ বাড়তে থাকে। পাশাপাশি অষ্টম মাসে শিশুর জেনিটাল অর্গান অর্থাৎ যৌনাঙ্গের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।

অষ্টম মাসে শিশুর নড়াচড়া আগের চেয়ে কমে যায়৷ ব্রিচ পজিশন থেকে বাচ্চা সেফালিক পজিশনে এসে স্থির হয়। বাচ্চার মাথা মায়ের পেলভিক হাড়গুলোর মধ্যে এসে ফিক্স হতে থাকে। একবার বাচ্চা এই পজিশনে স্থির হিয়ে গেলে ডেলিভারি পর্যন্ত এই অবস্থায়তেই থাকে। তাই ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি বা নর্মাল ডেলিভারির জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্টেপ।

অষ্টম মাসের লক্ষণ উপসর্গ

শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া

অষ্টম মাসে মায়ের গ্রোয়িং ইউটেরাস অর্থাৎ বাড়তে থাকা জরায়ু পেটের প্রায় সমস্ত জায়গা দখল করে নেয়। ধীরে ধীরে ইউটেরাস স্টমাক বা পাকস্থলীতে চাপ দেয়, সেই পাকস্থলী আবার লাংস বা ফুসফুসের উপর চাপ দেয়। ফলে ডিপ ব্রেদিং বা লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। অল্প পরিশ্রমেই মা হাপিয়ে ওঠেন।

হেমোরয়েডস

হেমোরয়েডস বা পাইলসকে আমরা বাংলায় বলি অর্শ্বরোগ। পায়ুপথ থেকে রক্তপাত হলে সেটাকেই আমরা পাইলস বা হেমোরয়েডস বলে জানি। অষ্টম মাসে অনেক মা পায়ুপথ থেকে রক্ত যাচ্ছে এমন অভিযোগ নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসেন। এতে ভয় পাবার কিছু নেই। প্রচুর পরিমাণে আঁশ যুক্ত খাবার খাওয়া, বেশি বেশি পানি এবং তরল জাতীয় খাবার খাওয়া যেন শরীর হাইড্রেটেড থাকে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আইস প্যাক কিংবা হিপ বাথ ব্যবহার করার মাধ্যমে এ সমস্যার উপশম হতে পারে। গর্ভবতী মাকে একটি বড় গামলায় হালকা কুসুম গরম পানি নিয়ে তাতে অল্প ভায়োডিন মিশিয়ে রোজ মিনিট দশেক বসতে বলা হয়। এটাকেই বলে হিপ বাথ বা সিজ বাথ।

ভেরিকোজ ভেইন

প্রেগনেন্সিতে রক্তের টোটাল ভলিউম বেড়ে যায়। এই বেড়ে যাওয়া রক্ত শুধু যে পায়ুপথে পাইলস তৈরি করে তা নয়, পায়ের শিরা ফুলে উঠে ভেরিকোজ ভেইন নামক সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। আপনি যদি এর আগের ব্লগগুলো পড়ে থাকেন, তাহলে ইতিমধ্যেই আপনি ভেরিকোজ ভেইন সম্পর্কে জানেন। তবুও বলে রাখি, এই সমস্যা হলে পা দুটো উঁচু করে রাখুন। শোবার আগে পায়ের নীচে একটা বালিশ দিতে পারেন। বসার সময় পায়ের উপর পা তুলে বসবেন না। বাচ্চা ডেলিভারি হবার পরে এ সমস্যা এম্নিতেই চলে যায়। তাই দুশ্চিন্তার কারণ নেই।

বার বার প্রস্রাবের বেগ

গর্ভাবস্থার প্রথম মাস থেকেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি প্রস্রাব হওয়া কিংবা বার বার প্রস্রাবের বেগ হওয়া জনিত সমস্যা শুরু হয়। দিন দিন সেটা বাড়তেই থাকে। থার্ড ট্রাইমেস্টারে সেটা সবচেয়ে বেশি হয়। অষ্টম মাসে বাচ্চা আপনার ব্লাডার বা মূত্রথলির ঠিক উপরে থাকে৷ জন্ম নেবার প্রস্তুতি হিসেবে বাচ্চা ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে থাকে। আর সেইসাথে মায়ের প্রস্রাব জনিত অস্বস্তিও বৃদ্ধি পায়৷ এটা স্বাভাবিক একটি ঘটনা। তবে যেসব মায়েরা চাকরি করেন কিংবা নিয়মিত বাড়ির বাইরে যান তাদের জন্য বিষয়টা অস্বস্তিকর হতে পারে। যদি প্রস্রাব লিক হয়, কিংবা হাচি কাশি বা হাসতে গেলে প্রস্রাব বের হয়ে আসছে বলে মনে হয়, সেক্ষেত্রে প্যান্টি লাইনার বা কোনো ধরনের পাতলা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়।

ব্রাক্সটন হিকস কনট্রাকশন

অনেক মায়ের অষ্টম মাসের শুরুতে কিংবা সপ্তম মাসের শেষ দিকে এসে ব্রাক্সটন হিকস কনট্রাকশন বা প্রাকটিস কনট্রাকশনের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। এই কনট্রাকশন গুলো প্রসব সময়কালীন কনট্রাকশনের চেয়ে আলাদা ধরনের হয়। প্রসব কালীন কনট্রাকশনগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর হতে থাকে, এবং সময়ের সাথে সাথে কনট্রাকশনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। ব্রাক্সটন হিকস কনট্রাকশন সময়ের সাথে সাথে তীব্র থেকে তীব্রতর হয় না এবং একটু হাঁটাচলা করলে কিংবা পজিশন চেঞ্জ করলে কনট্রাকশন বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও সন্দেহ থাকলে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে পারেন। অষ্টম মাসে সাধারণত ট্রু লেবার পেইন বা প্রসব কালীন ব্যথা শুরু হয় না৷ আর হলে সেটা প্রিটার্ম লেবার বা অপরিণত প্রসবের লক্ষণ। সেক্ষেত্রে কোনো রকম দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

ব্রেস্ট মিল্ক লিকেজ

শিশুর প্রথম ও প্রধান খাবার মায়ের শাল দুধ। শিশুর জন্মদানের প্রস্তুতি হিসেবে শাল দুধ বা কলোস্ট্রাম আরো আগে থেকেই তৈরি হতে থাকে। অষ্টম মাসে এসে অনেক মায়ের স্তন থেকে অল্প অল্প হলুদ রঙের তরল পদার্থ নির্গত হতে দেখা যায়৷ এক্ষেত্রে চিন্তার কিছু নেই। সন্তান জন্মের পরে এ অবস্থা আপনা আপনি ঠিক হয়ে যায়৷ মায়ের জামা কাপড় ভিজে গিয়ে যেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় সেজন্য ব্রেস্ট প্যাড ব্যবহার করা যেতে পারে।

অষ্টম মাসে মায়ের কি কি সমস্যা হতে পারে

প্রি একলাম্পসিয়া

মায়েরা এই সময়ে উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগতে পারেন। এর সাথে যদি প্রস্রাবে অতিরিক্ত প্রোটিন পাওয়া যায় তাহলে সেই অবস্থাকে প্রি একলাম্পসিয়া বলা হয়৷ এর ফলে গর্ভের সন্তানের ব্লাড ফ্লো কমে যায়। ফলে শিশুর বৃদ্ধি ব্যহত হয়। তাই এ সময়ে নিয়মিত রক্তচাপ মেপে চার্টে লিখে রাখতে হবে। পরপর তিন দিন প্রেশার হাই হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

প্রিটার্ম লেবার

বাচ্চা সময়ের আগেই জন্ম নিলে আমরা সেই বাচ্চাকে প্রিম্যাচিওর শিশু বলি। আর সময়ের আগেই প্রসব বেদনা শুরু হলে তাকে বলি প্রিটার্ম লেবার। বাচ্চার পজিশন, প্লাসেন্টার বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা, মায়ের কো মরবিডিটি বা কোনো সিস্টেমিক ডিজিজের কারণে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই প্রসব বেদনা শুরু হতে পারে। অষ্টম মাসে জন্ম নিলে সাধারণত শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি কম থাকে। তবে সেক্ষেত্রে শিশুকে জন্মের পর বেশ কিছুদিন  ইন্টেন্সিভ কেয়ারে রাখতে হয়।

অষ্টম মাসে মায়ের কি কি করা উচিত

  • স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। অল্প অল্প করে বারে বারে খেতে হবে। কোনোভাবেই কোনো ধরনের ভাজাপোড়া রিচ ফুড খাওয়া যাবে না। ফাইব্রাস ফুড বা আঁশজাতীয় খাবার বেশি বেশি খেতে হবে যেন কোষ্ঠকাঠিন্য না হয়। এছাড়াও বাচ্চার ব্রেইন ডেভেলপমেন্টের জন্য ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিডযুক্ত খাবার খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত।

  • পানি এবং অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। এ সময় হাইড্রেটেড থাকাটা খুবই জরুরি।

  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন। পেলভিক মাসলের জন্য খুবই কার্যকরী একটি ব্যায়ামের নাম 'কিগাল এক্সারসাইজ'। আপনি খুব সহজেই ইউটিউব দেখে কিংবা ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী এই ব্যায়াম করতে পারেন। ব্যায়াম করা সম্ভব না হলে রোজ অন্তত আধা ঘন্টা হাঁটুন।

  • আপনার নিজের এবং গর্ভস্থ শিশুর জন্য ভিটামিন ডি খুবই জরুরি। তাই রোজ সকালে ঘড়ি ধরে অন্তত পনেরো মিনিট রোদে হাটাহাটি করুন, সকালের রোদ গায়ে লাগান।

  • যেহেতু ডেলিভারির সময় এগিয়ে আসছে, হাসপাতালে যাবার প্রস্তুতি শুরু করতে পারেন এখন থেকেই। স্যানিটারি প্যাড, ঢিলাঢালা ফিডিং গাউন, ব্রেস্ট প্যাড, মিল্ক পাম্প এসব জিনিস আগে থেকেই কিনে রাখতে পারেন।  

আট মাসের একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য সময়টা একই সাথে খুশির ও উৎকন্ঠার। তিল তিল করে যে শিশুকে নিজের মধ্যে বড় করে তুলেছেন, সে এখন বাইরে আসার জন্য প্রস্তুত। আর মাত্র অল্প কয়েকটা দিন! এই সময়ে মা এবং মায়ের আশেপাশের সবাই, সন্তানের বাবা থেকে শুরু করে আত্নীয় প্রতিবেশী পর্যন্ত প্রত্যেকের মায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। আর যেকোনো সমস্যা তা যত ছোটোই হোক না কেন, ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত৷

Default user image

ডাঃ ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প স্বল্প লেখালেখি করতে ভালো লাগে। আস্থা লাইফের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্লগগুলি মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনতা তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস। ভালো লাগে ঘুমাতে, গান শুনতে, নানা রকম খাবার খেতে আর সবচেয়ে ভালো লাগে কথা বলতে।

Related Articles