প্রথমবার সিজার হলে দ্বিতীয়বার কি নরমাল ডেলিভারি হওয়া সম্ভব?

সি-সেকশন পরবর্তী নরমাল ডেলিভারি করা যায় না, আমাদের দীর্ঘদিন ধরে জেনে আসা এই তথ্যটি একেবারেই ভুল। সি-সেকশন করেছেন এমন নারী ইচ্ছে করলেই তার পরবর্তী সন্তান স্বাভাবিকভাবে জন্ম দিতে পারেন। তবে জানতে হবে এর জানা অজানা বিষয়গুলো।

আমরা অনেকেই জানি যে, একবার কারো সিজারিয়ান বেবি বা সি-সেকশনের মাধ্যমে বাচ্চা জন্ম নিলে সেই মায়ের পরবর্তী প্রসবও সি-সেকশনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। তবে প্রশ্ন হলো, এই জানা কতটা সত্যি? আমরা অনেক তথ্যই জানি যার মেডিকেল কোন ভিত্তি নেই। চলুন, সি-সেকশন পরবর্তী নরমাল ডেলিভারি বা ভিবিএসি কী, এর ঝুঁকি, উপকারিতা ও সর্বোপরি এর বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সত্যিটা আজ জেনে নেওয়া যাক!

সীতারাম ভারতিয় ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এন্ড রিসার্চের ম্যাটার্নিলি প্রোগ্রাম হেড ডক্টর রিংকু সেনগুপ্তের গবেষণানুসারে, বর্তমান সময়ে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে দুইজনই সি-সেকশনের পর স্বাভাবিক ডেলিভারিতে বাচ্চা জন্ম দিতে চান এবং এর মধ্যে শতকরা ৯০ শতাংশই সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকলেও বাকিরা এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে কোন সমস্যা ছাড়াই যেতে পারেন বলে মনে করেন তিনি। 

তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার আগে চলুন দেখে নেওয়া যাক নরমাল ডেলিভারি ও সি-সেকশনের মধ্যকার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো।

সি-সেকশন, নাকি ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি- কোনটি ভালো?

সি-সেকশন ও ও ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি, দুটো প্রসব পদ্ধতিরই রয়েছে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক। চলুন, এক এক করে সেগুলো জেনে নেওয়া যাক-

১. নরমাল ডেলিভারিতে খুব কম সময়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা যায়। এর প্রভাবও শরীরে তুলনামূলকভাবে কম পড়ে। সাধারণত, নরমাল ডেলিভারির ২৪-৪৮ ঘন্টা পরই মা হাসাপতাল থেকে বাসায় চলে যেতে পারেন, যেটি সি-সেকশনের ক্ষেত্রে অনেকটা সময় বেশি নিয়ে থাকে।

২. সার্জারিতে রক্তপাত, ক্ষত, সংক্রমণ ইত্যাদির সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি, যা নরমাল ডেলিভারিতে একদমই থাকে না। সাথে থাকে না অ্যানেস্থেসিয়া সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদী সমস্যাও।

৩. নরমাল ডেলিভারিতে একজন মা তুলনামূলকভাবে সি-সেকশনের চাইতে দ্রুত শিশুকে শাল দুধ পান করা পারেন। একইসাথে শিশু মায়ের সংস্পর্শেও আসতে পারে খুব দ্রুত। এক্ষেত্রেও অ্যানেস্থেসিয়া একটা বড় ভূমিকা রাখে। 

৪. চিকিৎসকদের মতে, ভ্যাজাইনাল ডেলিভারিতে প্রাপ্ত চাপের কারণে শিশুর ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহ তুলনামূলকভাবে ভালো কাজ করে। নরমাল ডেলিভারিতে জন্ম নেওয়া শিশুর ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টও কম দেখা যায়।

সি-সেকশনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক একমাত্র দিক হলো এটি পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী করা সম্ভব। এতে করে মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যকে ঠিক রেখে শারীরিক ঝুঁকিও কমানো সম্ভব। তবে নরমাল ডেলিভারিতে স্বাস্থ্যগত সমস্যা কম থাকায় পূর্বে সি-সেকশন করা হলেও নরমাল ডেলিভারি করতে চান অনেক মা। তবে হ্যাঁ, এতে করে পূর্বের করা সি-সেকশন বেশকিছু সমস্যা তৈরি করতে পারে।

সি-সেকশনের পর নরমাল ডেলিভারিতে কেন সমস্যা দেখা দেয়?

সি-সেকশনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর পুনরায় নরমাল ডেলিভারি করার ক্ষেত্রে সাধারণত কোন সমস্যা দেখা না দিলেও অল্প কিছু ক্ষেত্রে এর অন্যথাও হতে পারে। কেন? চলুন, দেখে নেওয়া যাক কারণগুলো!

মূত্রথলীতে আঘাতের সম্ভাবনা

চিকিৎসকদের মতে, স্থুলতার কারণে মূত্রথলীতে আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বিধায় নারীদের নরমাল ডেলিভারিতে কম যেতে উৎসাহিত করা হয়। তবে ওজন স্বাভাবিক থাকলে এই সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। এক্ষেত্রে পূর্বে সিজারিয়ান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন যে নারী তার প্রয়োজন সিজারের কারণ সম্পর্কে জানা। কী কারণে পূর্বে সিজারিয়ান পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়েছিলো তার জন্য সেটার ভিত্তিতে পরবর্তীতে সাধারণ ডেলিভারির পরামর্শ দিতে পারেন চিকিৎসক। সাধারণত, এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভ্যাজাইনাল ডেলিভারির জন্য একজন সি-সেকশন করা নারীর উচিৎ ২-৩ বছর অপেক্ষা করা। অন্যথায় একজন নারীর মূত্রথলী পূর্বে আঘাতপ্রাপ্ত হলে পরবর্তীতে সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে। 

জরায়ুর ক্ষত

সি-সেকশন অনেক সময় জরায়ুতে ক্ষত রেখে যায়। ফলে পরবর্তীতে নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে এই ক্ষতই বৃদ্ধি পেয়ে আরো ভয়াবহ কিছু তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন তারা। অনেকসময় অতি সাধারণ এই ক্ষতর জন্যই পরবর্তীতেও সি-সেকশন করতে বলা হয় মায়েদের।

বয়স

চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের ক্ষেত্রে পূর্বে সি-সেকশন করা থাকলে সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে নরমাল ডেলিভারি করা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। নরমাল ডেলিভারি একজন মায়ের শরীর, জরায়ুর মুখ ইত্যাদিতে প্রচন্ড চাপ ফেলে। তুলনামূলক কমবয়সী নারী শরীর এই চাপ নিতে সক্ষম হলেও পরবর্তী সময়ে শরীরের এই সক্ষমতা কমে আসে। ফলে দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক সমস্যা থেকে শুরু করে মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত হতে পারে।

পূর্ববর্তী সিজারিয়ানের সময়

সি-সেকশন একজন নারীর শরীরে বেশ দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রাখে। নরমাল ডেল্ভারির চাইতে যা একটু বেশি। বিশেষ করে অ্যানেস্থেসিয়া ব্যবহারের কারণে এই সমস্যা মায়ের জন্য আরো ক্ষতিকর হয়ে পড়ে। তাই সিজারিয়ান বেবি নেওয়ার পর নরমাল ডেলিভারি করার ক্ষেত্রে কম করে হলেও অন্তত ২০ মাস অপেক্ষা করা উচিৎ। অন্যথায় বাড়তি চাপ মায়ের জন্য ভয়ঙ্কর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

যে কারণে আপনি সি-সেকশনের পর নরমাল ডেলিভারি করতে পারবেন না

উপরে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো মূলত সিজারিয়ানের পর নরমাল ডেলিভারিতে একজন মায়ের জন্য ঝুঁকি তৈরী করতে পারে। কিন্তু একটি বিষয় যদি উপস্থিত থাকে আপনার পূর্ববর্তী সিজারিয়ানে, সেক্ষেত্রে চাইলেও পরবর্তীতে নরমাল ডেলিভারি করতে পারবেন না আপনি। সাধারণত সি-সেকশনের ফলে তলপেট ও জরায়ুতে হওয়া ক্ষত দেখতে দুইরকমের হয়। আপনি সেটা না বুঝলেও এই পার্থক্যই আপনার নরমাল ডেলিভারিতে সমস্যা তৈরী করতে পারে। সাধারণত সি-সেকশন দুইভাবে করা হয়।

  • লম্বালম্বি ক্ষত

  • আড়াআড়ি ক্ষত

আপনার আগের সি-সেকশনটি যদি ভার্টিকাল বা লম্বালম্বি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনি পরবর্তীরে নরমাল ডেলিভারি করতে পারবেন না। কারণ পরবর্তীতে নরমাল ডেলিভারি করলে তাতে আপনার ও ক্ষতস্থান কেটে যেতে পারে, যা আপনার ও আপনার শিশুর জন্য ক্ষতিকর। সেক্ষেত্রে আপনাকে পুনরায় সি-সেকশনই করতে হবে। অন্যদিকে আপনার সি-সেকশনের ক্ষত যদি তলপেটের নিচের দিকে আড়াআড়ি করে কাটা হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আপনি নরমাল ডেলিভারির বেছে নিতে পারেন।

হাসপাতালভেদে ভিন্নতা

আপনি আপনার ডেলিভারির জন্য কোন হাসপাতাল বেছে নিচ্ছেন সেটাও এক্ষেত্রে অনেক বড় ব্যাপার হিসেবে কাজ করে। অনেক হাসপাতালে পূর্বে সি-সেকশন করেছেন এমন নারীদের নরমাল ডেলিভারি করতে উৎসাহিত করা হয় না। তবে যদি আপনার এমন নরমাল ডেলিভারি হয়ও, সেক্ষেত্রেও ঐ হাসপাতালকে পরবর্তী যেকোন ঝুঁকির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সাধারণত যে হাসপাতালগুলো এ ধরণের কেইস নিতে চান না, তাদের ইমার্জেন্সি সময়ের প্রস্তুতি থাকে না।

সি-সেকশনের পর ভ্যাজাইনাল ডেলিভারিঃ উপকারিতা কী কী?

সিজারিয়ানের পর নরমাল ডেলিভারির সবগুলো ঝুঁকি নিয়ে তো জানা হলো। তবে এই পদ্ধতি কিন্তু পুরোটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। নরমাল ডেলিভারির মতোই এই সি-সেকশন পরবর্তী নরমাল ডেলিভারির আছে বেশকিছু উপকারিতা।

এই পদ্ধতিতে ডেলিভারি সফল হলে একজন মা যে সুফলগুলো উপভোগ করতে পারবেন সেগুলো হলো-

১. সার্জারির সব রকমের সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন

২. রক্তপাত হওয়ার সমস্যা ঘটবে না, আর ঘটলেও রক্তপাত কম হবে

৩. মা নরমাল ডেলিভারির মতোই দ্রুত সেরে উঠবেন প্রসব সংক্রান্ত প্রভাব থেকে

৪. সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে আসবে

৫. মূত্রথলি বা বৃহদান্ত্রের কোনরকম ইনজুরি থেকে মুক্ত থাকা যাবে

৬. পরবর্তী প্রব্দের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সমস্যা অনেকটাই কমে আসবে

তবে হ্যাঁ, উপকারিতা আছে বলেই কোন নারী সি-সেকশনের পর দ্বিতীয়বার নরমাল ডেলিভারি করতে চাইবেন তা নয়। সি-সেকশনের পর নরমাল ডেলিভারি করতে অনেকেই ভয় পান ব্যথা ও অন্যান্য সমস্যার জন্য। অনেকের সাথে নরমাল ডেলিভারিতে নানান রকম ঝুঁকির সম্ভাবনা। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর পরামর্শে বা পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী নিজেও শেষ সময়ে পুনরায় সিজার করার সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন।

Default user image

সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি, লেখক, আস্থা লাইফ

জন্ম ২রা মার্চ, ১৯৯৪, নানুবাড়ী ঝিনাইদহে। বাবার বাসা বরিশাল। বাবা জাহিদুল ইসলাম, মা রোজী ইসলাম, ভাই সাকিব সাদমান বাঁধন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এমএসএস শেষ করে বর্তমানে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। লেখা এবং কাজ করার সুযোগ হয়েছে বহুক্ষেত্রে। বর্তমানে জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখছেন। নবীন সাহিত্যিক হিসেবে ২০১৮ সালে ‘আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরষ্কার’ পান লেখক।

Related Articles