মোলার প্রেগন্যান্সি কেন হয়? কেন আক্রান্ত মায়েরা ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকেন?

মোলার প্রেগন্যান্সির পরিপূর্ণ চিকিৎসা না হলে এ থেকে জন্ম নিতে পারে মারণঘাতি ক্যান্সার। অথচ এই প্রেগন্যান্সি নিয়ে আমাদের জানার পরিধি খুবই সীমিত। আসুন জেনে নেই মোলার প্রেগন্যান্সি কী, এর চিকিৎসা এবং বিস্তারিত।

  • মোলার প্রেগন্যান্সির চিকিৎসা এবং পরবর্তী ফলো আপ ঠিক ভাবে না হলে তা থেকে কোরিও কারসিনোমা (ক্যানসার) তৈরি হতে পারে।

  • আগে মোলার প্রেগন্যান্সি ছিল এমন মায়েদের মধ্যে শতকরা ৩ থেকে ৫ জন মা কোরিও কারসিনোমাতে আক্রান্ত হন।

মোলার প্রেগন্যান্সি - নামের ভেতর প্রেগন্যান্সি শব্দটা থাকলেও আদতে এটি একটি অস্বাভাবিক গর্ভাবস্থা যাতে গর্ভবতী মায়েদের ফিটাস বা ভ্রূণের কোনো অস্তিত্বই থাকে না। সেখানে গর্ভস্থ সন্তানের জায়গায় থাকে শুধু একগুচ্ছ ভেসিকল। মোলার প্রেগন্যান্সির তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি দুই ধরনের চিকিৎসাই অত্যন্ত জরুরি। তাই আসুন আজ মোলার প্রেগন্যান্সি নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।

মোলার প্রেগন্যান্সি আসলে কি?

মোলার প্রেগন্যান্সি একটি Gestational Trophoblastic Disease বা GTD যেখানে ভ্রূণের পরিবর্তে জরায়ুতে থোকা থোকা আঙুরের মত কিছু ভেসিকল তৈরি হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে ভ্রূণ কিংবা অ্যামনিওটিক স্যাকের অস্তিত্ব না থাকলেও কিছু হরমোনের প্রভাবে মায়েদের শরীরে গর্ভাবস্থার প্রথম দিকের লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং মায়েরা স্বভাবতই নিজেকে গর্ভবতী বলে ধরে নেন।

মোলার প্রেগন্যান্সির বয়সসীমা

মোলার প্রেগন্যান্সির নির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা নেই। যেকারো যেকোনো বয়সে এই সমস্যা হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি একটু হলেও বেশি থাকে। যেমন -

  • কিশোরী বা কম বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে

  • চল্লিশোর্ধ্ব মায়েদের ক্ষেত্রে

  • এর আগে ৩ বা ততোধিক সন্তান আছে এমন মায়েদের ক্ষেত্রে

কিভাবে বুঝবেন এটি মোলার প্রেগন্যান্সি

  • যোনিপথে কোনো কারণ ছাড়াই রক্তপাত হতে পারে। এসময়ে আঙুরের থোকার মত ভেসিকলগুলি ফেটে গিয়ে সাদা জেলির মত পদার্থ বের হয়ে আসে। রক্তের সাথে এমন জেলি ন্যায় থকথকে কিছু বের হতে দেখলে সাথে সাথে নিকটস্থ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে যাওয়া উচিত।

  • তলপেটে ব্যথা হতে পারে।

  • অনেক সময় আঙুরের থোকা মত কিছু জিনিস যোনিপথে বের হয়ে আসে।

  • গর্ভাবস্থায় প্রথম দিকে বমি বমি ভাব, কিছু খেলেই বমি হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে অত্যধিক বমি হওয়াটা অস্বাভাবিক। মোলার প্রেগন্যান্সির মায়েদের হাইপারএমেসিস বা অত্যধিক বমি জনিত সমস্যা হয়ে থাকে।

  • কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই গর্ভবতী মা এসময় অসুস্থ বোধ করতে পারেন।

প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা

স্বাভাবিক গর্ভধারণের পর যেসব স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়, মোলার প্রেগন্যান্সির মায়েদেরও সেই একই পরীক্ষা করতে বলা হয়৷ যেমন-

  • রক্ত পরীক্ষা

  • আলট্রাসনোগ্রাম

  • পেটের এক্সরে

  • সেরাম HCG লেভেল ( মোলার প্রেগন্যান্সিতে HCG এর পরিমাণ মাত্রারিক্ত বেশি থাকে )  

  • অনেক সময় সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করারও প্রয়োজন হতে পারে।

পার এবডোমিনাল পরীক্ষা

যেতেতু মোলার প্রেগন্যান্সিতে গর্ভের সন্তানই অনুপস্থিত, তাই মায়ের পেটে হাত দিলে বাচ্চার নাড়াচাড়ার কোনো আভাস পাওয়া যায় না। বাচ্চার হাত পা কিংবা বাচ্চার হৃৎস্পন্দন বোঝার জন্য ডাক্তার যেসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন তার কোনোটাতেই কোনো আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। জরায়ুর আকার ট্রাইমেস্টার বা সপ্তাহ অনুযায়ী যতটুকু হবার কথা শতকরা ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়।

পার ভ্যাজাইনাল পরীক্ষা

ভ্যাজাইনাল পথে পরীক্ষা করলে অনেক সময় আঙুলের ন্যায় ভেসিকল গুলি হাতে চলে আসে।

মোলার প্রেগন্যান্সি জনিত শারীরিক জটিলতা

  • অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং তার ফলাফল স্বরূপ শকে চলে যাওয়া

  • সেপসিস হতে পারে

  • জরায়ু ফেটে যেতে পারে অথবা ছিদ্র হয়ে যেতে পারে

  • কোয়াগুলেশন ফেইলিওর হতে পারে

  • পরবর্তীতে কোরিও কারসিনোমা হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

এক্ষেত্রে জেনে রাখা ভালো, কোরিও কারসিনোমা একটি ম্যালিগন্যান্ট টিউমার যা কোরিওনিক ভিলাই থেকে উৎপন্ন হয়। মূলত মোলার প্রেগন্যান্সি নিয়ে আমাদের এত কথা বলার কারণ এই কোরিও কারসিনোমা। মোলার প্রেগন্যান্সির চিকিৎসা এবং পরবর্তী ফলো আপ ঠিক ভাবে না হলে তা থেকে কোরিও কারসিনোমা তৈরি হতে পারে। যা থেকে ভ্যাজাইনা বা অন্যান্য স্ত্রী জননাঙ্গ ছাড়াও যকৃত, ব্রেইন, ফুসফুসে মেটাসটাসিস হতে পারে।

মোলার প্রেগন্যান্সি হলেই যে কোরিও কারসিনোমা হবে বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। আগে মোলার প্রেগন্যান্সি ছিল এমন মায়েদের মধ্যে শতকরা ৩ থেকে ৫ জন মা কোরিও কারসিনোমাতে আক্রান্ত হন।

তবে আশার কথা এই যে, এই কারসিনোমার চিকিৎসা রয়েছে। রোগের তীব্রতা অনুযায়ী চিকিৎসার ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কেমোথেরাপি রেডিয়েশন অথবা অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু ফেলে দেবার প্রয়োজন হতে পারে। আবার কারো কারো উপর দুই ধরনের চিকিৎসার কম্বিনেশন থেরাপিও প্রয়োগ করার দরকার হতে পারে।

চিকিৎসা

  • জরায়ুর ভিতরে জমে থাকা রক্ত, পানি, ভেসিকল সহ সব কিছু যন্ত্রের সাহায্যে টেনে বের করে নিয়ে আসাকেই বলা হয় সাকশন ইভাকুয়েশন। সাধারণত সাকশন ইভাকুয়েশন এর মাধ্যমে যে প্রডাক্ট অব কনসেপশন পাওয়া যায় পরবর্তীতে তার হিস্টোলজিক্যাল পরীক্ষা করা হয়।

  • গর্ভবতী মায়ের বয়স যদি ৪০ বা তার চেয়ে বেশি হয় এবং যদি তার ৩ বা ততোধিক সন্তান জীবিত থাকে এবং যদি তিনি আর সন্তান নিতে আগ্রহী না হয়ে থাকেন তবে গর্ভবতী মা এবং তার স্বামীর সম্মতিক্রমে হিসটেরেকটমি বা অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করা যেতে পারে।

  • মায়ের রক্তের গ্রুপ যদি নেগেটিভ হয়, তবে এন্টি ডি ইনজেকশন গ্রহণ করতে হবে৷

অন্তত এর পরের ১ থেকে ২ বছর নিয়মিত ফলো আপ ও চেক আপের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

ফলোআপ প্রটোকল

প্রতিবার ফলোআপ চেক আপ করার সময় ডাক্তারের সাথে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। কিছু লক্ষণ মায়ের মধ্যে দেখা যাচ্ছে কিনা সেটাই মূলত আলোচনা করা হয়। সেগুলো হল -

  • কোনো অস্বাভাবিক ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং হচ্ছে কি না

  • বুকে ব্যথা, কাশির সাথে রক্ত যাওয়া কিংবা শ্বাস নিতে কোনো রকম অসুবিধা বোধ করেন কি না

  • রক্ত বমি হচ্ছে কি না

  • চোখের দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে কি না

  • মাথা ব্যথা, হাত পা অবশ হয়ে আসে কি না

  • প্রস্রাবের সাথে রক্ত যায় কি না

  • যোনীপথে ছোটো ছোটো চাকার মত কিছু অনুভব হয় কি না

বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখুন

সাকশন ইভাকুয়েশন কিংবা অন্য কোনোভাবে গর্ভাবস্থার অবসান ঘটার পরে প্রথম দিকে বিটা এইচসিজি (HCG) র পরিমাণ খুব বেশি থাকে। এর পরিমাণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত প্রতি সপ্তায় HCG এর পরিমাণ চেক করতে হবে। HCG স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে এলেও প্রথম ৬ মাস প্রতি মাসে এবং তার পর থেকে প্রতি ৩ মাস পর পর HCG লেভেল দেখতে হবে। অন্তত প্রথম ২ বছর পর্যন্ত HCG লেভেল বার বার চেক করে যেতে হবে৷

একটি মোলার প্রেগন্যান্সির পরে অন্তত ২ বছরের আগে সন্তান না নেয়াই ভালো। এক্ষেত্রে কনট্রাসেপশন হিসেবে কনডম, DMPA ইনজেকশন ব্যবহার করতে পারেন। তবে ইনট্রা ইউটেরাইন কোনো ডিভাইস ব্যবহার করা যাবে না৷ তবে নিতান্তই যদি আবশ্যক মনে করেন, তবে ৬ মাস পরে বিটা HCG লেভেল যখন স্বাভাবিকে নেমে আসবে তখন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভধারণ করা যেতে পারে।

মোলার প্রেগন্যান্সি এবং একটোপিক প্রেগন্যান্সি একই?

মোলার প্রেগন্যান্সি একটোপিক প্রেগন্যান্সির মতই একটি জটিল এবং অস্বাভাবিক অবস্থা। পার্থক্য শুধু এই যে একটোপিক প্রেগন্যান্সির সময়ে একটি পূর্নাঙ্গ ভ্রূণ মাতৃগর্ভে তৈরি হয়। জরায়ুর ঠিক যে জায়গায় থাকা দরকার সেই জায়গায় থাকে না, তবে ভ্রূণের অস্তিত্ব বজায় থাকে।

কিন্তু মোলার প্রেগন্যান্সি এমনই এক সমস্যা যেখানে ভ্রূণের কোনো অস্তিত্বই থাকে না। নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই বলে এই সমস্যা একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে মোলার প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে আগে থেকেই জানা থাকলে সন্তান প্রত্যাশী দম্পতিরা এ সম্পর্কে সজাগ থাকতে পারেন।

 

 আরও জানুনঃ

Default user image

ডাঃ ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প স্বল্প লেখালেখি করতে ভালো লাগে। আস্থা লাইফের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্লগগুলি মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনতা তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস। ভালো লাগে ঘুমাতে, গান শুনতে, নানা রকম খাবার খেতে আর সবচেয়ে ভালো লাগে কথা বলতে।

Related Articles