গর্ভাবস্থায় খেজুর খাওয়ার উপকারিতা

খেজুর অপরিহার্য ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবারের একটি প্রাকৃতিক উৎস যা একটি সুস্থ গর্ভাবস্থাকে মেইনটেইন করতে সহায়তা করে। গর্ভাবস্থায় যে কোন খাবার পরিমিত ও সুষম হওয়া গুরুত্বপূর্ণ এবং গর্ভবতী নারীদের সুষম খাদ্যের অংশ হিসাবে খেজুর খাওয়া উচিত।

  • ২০০ টিরও বেশি গর্ভবতী মহিলার উপর করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে নিয়মিত খেজুর খেলে জরায়ু নরম হয় যা প্রসবকালীন সময়ে কষ্ট কমিয়ে দেয়।

  • আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে গর্ভাবস্থায় প্রসবের প্রত্যাশিত তারিখের চার সপ্তাহ আগে থেকে প্রতিদিন ছয়টি খেজুর খেলে ডেলিভারির প্রথম স্টেজের সময় কমে যায় এবং জরায়ুকে নরম করে দেয়।

গর্ভাবস্থায় নারীদের খাদ্যাভাসে নানান পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। এসময় উচ্চ পুষ্টিগুন সম্পন্ন খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।  জীবনধারণ ও খাদ্যের ব্যাপারে সচেতন হলেই এই অবস্থায় অনেক ঝুঁকি এড়িয়ে একটি সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করা সম্ভবপর হয় একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য। তাই এ সময় নিয়মিত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহন করা উচিত। অন্যান্য ফলের পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় খেজুর গ্রহণ মা এবং শিশু উভয়ের জন্যই বেশ উপকারী । 

গর্ভাবস্থায় খেজুর কেন খাবেন

  • খেজুরে বিদ্যমান প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুলি শিশুর বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং গর্ভাবস্থায় মায়ের সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে সহায়তা করে।

  • জরায়ুর পেশীর সঠিক সংকোচনে সহায়তা করে।

  • খেজুরের পুষ্টি উপাদান গর্ভাবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে মাতৃস্বাস্থ্যকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, যেমন রক্ত ​​উৎপাদনের জন্য আয়রন এবং নিউরাল টিউব বিকাশের জন্য ফোলেট প্রয়োজনীয় যা খেজুরে সর্বাধিক পরিমাণে বিদ্যমান।

  • খেজুরের পুষ্টি উপাদান গুলো গর্ভাবস্থায় সুস্থ কোষের বৃদ্ধি, অঙ্গ গঠন এবং সামগ্রিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে এবং ভ্রূণের বিকাশে অবদান রাখে।

  • খেজুর হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে একটি সুস্থ গর্ভাবস্থা বজায় রাখতে সহায়তা করে।

  • খেজুর গর্ভাবস্থায় রক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম এবং প্রসবকালীন অবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে।

  • রক্তাল্পতার ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।

  • মর্নিং সিকনেস বা সকালে বমি বমি ভাব মোকাবেলা করতে

  • রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ও যেকোনো প্রকার টক্সিসিটি থেকে মুক্তি পেতে ভূমিকা রাখে।,

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সহায়ক।

  • নিজ দেহ ও শিশুর বর্ধন ও বিকাশের জন্য ক্যালসিয়ামের  যে চাহিদা তার পরিমাণ বজায় রাখতে  সক্ষম।

খেজুরের পুষ্টিগুণ

প্রতি ১০০ গ্রাম খেজুরে উপস্থিত পুষ্টির পরিমাণ-

এনার্জি

২৮২ ক্যালরি

ফাইবার

৮ গ্রাম

প্রোটিন

২.৪৫ মিগ্রা

আয়রন

১.০২ মিলিগ্রাম 

ফোলেট

১৯ এমসিজি

ফ্যাট

০.৩৯ গ্রাম

ভিটামিন কে

২.৭ এমসিজি

পটাশিয়াম

৬৫৬ মিলিগ্রাম 

ম্যাগনেসিয়াম

৪৩ মিলিগ্রাম 

সোর্সঃ ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার

খেজুরে থাকা পুষ্টি  উপাদানগুলির কাজ

খেজুর বিভিন্ন পুষ্টিতে পরিপূর্ণ যা গর্ভবতী নারীদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। চলুন দেখে নেয়া যাক সেই পুষ্টি উপাদান এবং গর্ভাবস্থায় তাদের কার্যক্রমগুলো-

আয়রন

গর্ভবতী নারীদের অন্যান্য নারীদের তুলনায় বেশি আয়রনের প্রয়োজন হয়। খেজুর  প্রচুর পরিমাণ এ আয়রন সমৃদ্ধ  যা গর্ভবতী নারীদের রক্তে হিমোগ্লোবিন এর সঠিক পরিমাণ নিশ্চিত করে রক্তাল্পতা উপশম করতে সহায়ক। আয়রন দেহের বিভিন্ন বিপাকীয় প্রক্রিয়াগুলিতে সহায়তা করে এবং মা ও গর্ভে থাকা শিশু  উভয়েরই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাড়িয়ে তোলে।

ফোলেট (ভিটামিন B9)

ফোলিক অ্যাসিড গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান গুলোর মধ্যে একটি। এটি নিউরাল টিউব ডেভেলপমেন্ট এবং শিশুর মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডে জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।

প্রাকৃতিক চিনি ও শক্তির উৎস

খেজুর প্রাকৃতিকভাবে শক্তির একটি উৎকৃষ্ট উৎস। গর্ভাবস্থায় প্রচুর ক্যালোরির প্রয়োজন হয়, তাই যখনই গর্ভবতী মা ক্ষুধার্ত হবেন তখন কয়েকটি খেজুর খেতে পারেন গর্ভবতী মহিলারা প্রায়ই ক্লান্ত অনুভব করেন । এক্ষেত্রে খেজুর খাওয়ার ফলে এটি যে শক্তি সরবরাহ করে তা থেকে গর্ভবতী নারীরা উপকৃত হতে পারেন। এটিগর্ভাবস্থায় ওজনকে তীব্রভাবে প্রভাবিত না করে শরীর ও গর্ভে থাকা শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালোরি সরবরাহ করে।

প্রোটিন

খেজুরে এমন প্রোটিন থাকে যা দেহের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরিতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত খেজুর গ্রহণ করা গর্ভবতী মহিলাদের সারভিক্যাল ডাইলেশন অন্য গর্ভবতী মহিলাদের তুলনায় বেশি । সুতরাং, খেজুর গ্রহণের ফলে প্রসবের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রসব বেদনা কম হতে পারে। খেজুর অক্সিটোসিন প্রভাব বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে  যার ফলে গর্ভাশয়ের সংকোচন ও জরায়ুর সংবেদনশীলতা বাড়ে।

ফ্যাটি এসিড

খেজুর স্যাচুরেটেড এবং আনস্যাচুরেটেড  ফ্যাটি অ্যাসিড সরবরাহ করে যা শক্তি উৎপাদনে সহায়ক । পাশাপাশি এসব ফ্যাটি অ্যাসিড প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন উৎপাদন করতে সহায়তা করে।  অক্সিটোসিন এবং প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয়।

পটাসিয়াম

পটাসিয়াম শরীরের লবণের ভারসাম্য এবং রক্তচাপ বজায় রাখতে সহায়তা করে। এর অভাবে গর্ভাবস্থায় মাংসপেশীতে খিঁচ ধরা বা ক্র্যাম্প জাতীয় কিছু বিষয় ঘটে। খেজুরে থাকা পটাসিয়াম এ ধরনের সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারে। এই পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি কিডনিতে সমস্যার জন্য দায়ী।

ম্যাগনেসিয়াম

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হাড় এবং দাঁত গঠনের জন্য ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন। খেজুর ম্যাগনেসিয়াম এর বেশ ভালো উৎস। খেজুরে থাকা ম্যাগনেসিয়াম রক্তে শর্করা ও রক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

ক্যালসিয়াম

শিশুর হাড় ও দাঁতের বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ফাইবার

গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য  একটি সাধারণ বিষয় । তবে খেজুর খাওয়ার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব খেজুরে উচ্চ পরিমাণে ফাইবার সরবরাহ রয়েছে, খেজুর শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রাও হ্রাস করে। খেজুর খাওয়ার ফলে এটি পাকস্থলীকে ভরপুর থাকতে এবং দেহের একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সহায়তা করবে – যা গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ফ্রুক্টোজ

খেজুরে ফ্রুক্টোজ থাকে সব থেকে বেশি যা গর্ভাবস্থায়  সর্বোচ্চ পরিমাণ শক্তির চাহিদা নিশ্চিত করে। নানান শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে গর্ভাবস্থায় প্রচুর শক্তি দানকারী খাদ্য খাদ্যতালিকাতে থাকা জরুরী। খেজুরগুলি তাৎক্ষণিক শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম।

ভিটামিন কে

ভিটামিন কে রক্ত ​​জমাট বাঁধতে সহায়তা করে। এটি গর্ভাবস্থাতে শিশুর হাড়ের কাঠামোর বিকাশেও সহায়ক এবং খেজুর এই ভিটামিনের সেরা উৎসগুলির মধ্যে অন্যতম। ভিটামিন কে-এর অভাব গর্ভাবস্থায় শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।

ভিটামিন এ

দৃষ্টিশক্তি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ভ্রূণের বিকাশকে সমর্থন করে।

ভিটামিন B6

বিপাক, স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা এবং প্রোটিন সংশ্লেষণে সাহায্য করে।

গর্ভাবস্থার বিভিন্ন ট্রামেস্টারে খেজুর যেভাবে খাবেন

প্রথম ট্রামেস্টারে

প্রথম ট্রামেস্টারে কোষ্ঠকাঠিন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। খেজুর খেলে সেই সমস্যা থেকে সমাধান পাওয়া যায়। এই সময়ে অন্ত্রের সমস্যা এবং অভ্যন্তরীণ যেকোনো অস্বস্তিকে প্রশমিত করতে খেজুর খাওয়া জরুরী। তবে গর্ভবতী নারী যদি রক্তের শর্করার সমস্যা বা গ্রুপ বি স্ট্রেপ সংক্রমণ (গর্ভবতী মহিলার মলদ্বার বা যোনিতে হওয়া এক ধরনের সংক্রমণ) থাকে তবে প্রথম ট্রামেস্টারে খেজুরে খাওয়ার পরিমাণ সীমাবদ্ধ রাখা বাঞ্ছনীয়।

দ্বিতীয় ট্রামেস্টারে

দ্বিতীয় ট্রামেস্টারের সময় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই এই সময়টিতে খেজুর খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। তবে, শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী  অল্প কয়েকটি খেজুর এই সময়ে খাওয়া যেতে পারে।

তৃতীয় ট্রামেস্টারে

বিশেষজ্ঞদের মতে, তৃতীয় ট্রামেস্টারে খেজুর খাওয়া অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ কারণ এটিতে থাকা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য জরায়ু সংকোচনে সহায়তার মাধ্যমে প্রসব শ্রম হ্রাস এবং সমগ্র প্রসব প্রক্রিয়াটিকে সহজতর করতে সহায়তা করে।

পরিশেষে

প্রাকৃতিক চিনি উপাদানের কারণে খেজুর পরিমিতভাবে খাওয়া অপরিহার্য।  গর্ভবতী মহিলাদের তাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা একজন নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করা উচিত যাতে গর্ভাবস্থায় খেজুর খাওয়ার পরিমাণ তাদের খাদ্যতালিকাগত চাহিদার সাথে সামঞ্জ্যপূর্ণ হয়।

Default user image

রাইসা মেহজাবীন, লেখক, আস্থা লাইফ

রাইসা মেহজাবীন, গভর্নমেন্ট কলেজ অফ এপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্স এ ডিপার্টমেন্ট অফ ফুড এন্ড নিউট্রিশন এ পড়ালেখা করছি। পড়ালেখার পাশাপাশি খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে লেখালেখি করছি। স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে খাদ্য ও পুষ্টি সচেতনতা। সেই লক্ষ্যেই এই বিষয়ক লেখালেখিতে মনোনিবেশ করা।

Related Articles