মিসক্যারেজ (পর্ব-১): আপনার গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
গর্ভপাত খুব অহরহ হয়ে থাকলেও এইসময় একজন নারীকে প্রচন্ড মানসিক ও শারীরিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আপনার ছোট্ট কিছু কাজই গর্ভপাতের ঝুঁকিকে অনেকটা বৃদ্ধি করে। চলুন, গর্ভপাতকে আরো একটু ভালোভাবে দেখে আসি এবং জেনে নিন এই খুঁটিনাটি সম্পূর্ণভাবে।
একটি শিশু জন্ম নিলে শুধু শিশুর নয়, জন্ম হয় একজন মায়েরও। তবে সবার মা হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়া এতোটাও সহজ হয় না। পরিসংখ্যান অনুসারে, গর্ভধারণ করার পর প্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ নারী গর্ভপাতের মুখোমুখি হন। অনেক সময় একজন নারী গর্ভধারণের কোন লক্ষণ বুঝে ওঠার আগেই এমনটা হয়ে থাকে। তাই গর্ভপাতের আসল সংখ্যাটা আরো বেশি মনে করেন অনেকে।
অনেকসময় আমরা গর্ভপাত বলতে বুঝে থাকি সন্তান জন্ম নেওয়ার সময় কোন কারণে তার মৃত্যু হওয়াকে। তবে সাধারণত গর্ভপাত সন্তান ভ্রুণ থেকে একটি শিশু মানব আকৃতি পাওয়ার সময়েয় হয়ে থাকে।
গর্ভপাত কিছু ছোটখাটো ব্যাপার মাথায় রেখে সাবধান থাকলেই অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। গর্ভপাতকে কমিয়ে আনার জন্যই তাই আজকে আমাদের এই আয়োজন।
গর্ভপাত কী?
একজন নারীর গর্ভকালীন সময়ে ২০ সপ্তাহের পূর্বে অনাগত সন্তানের মৃত্যুকেই গর্ভপাত বলা হয়। প্রথম ট্রাইমেস্টারে হওয়া এই ব্যাপারটিকে স্পন্টেনিয়াস অ্যাবোরশনও বলা হয়। তবে গর্ভপাত বা মিস্ক্যারেজ মানেই যে আপনার কোন ভুলের কারণেই সেটা হয়েছে এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। বেশিরভাগ গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ভ্রুণ বৃদ্ধি পাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং মিসক্যারেজ হয়ে থাকে।
অনেকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৩ সপ্তাহের মধ্যেও দূর্ভাগ্যজনক এই ঘটনাটি ঘটে থাকে। সব গর্ভপাত কিন্তু একই ধরণের নয়। গর্ভপাতের বেশ কয়েকটি রকম আছে। সেগুলো হলো-
১. মিসড মিসক্যারেজ
আপনি যদি আপনার অজান্তেই গর্ভধারণ করে গর্ভপাতের সম্মুখীন হয়ে থাকেন এবং না বুঝে থাকেন সেটাকে মিসড মিসক্যারেজ বলা হয়। সেক্ষেত্রে গর্ভপাতের লক্ষণ না পাওয়া গেলেও ভ্রুণের হৃদস্পন্দন না পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।
২. কমপ্লিট মিসক্যারেজ
আপনি যদি গর্ভধারণ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং রক্তপাত, টিস্যু ইত্যাদি বের হওয়ার ব্যাপারগুলো দেখেন, সেক্ষেত্রে আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে চিকিৎসক আপনার কমপ্লিট মিসক্যারেজের নিশ্চয়তা দিবেন।
৩. রিকারেন্ট মিসক্যারেজ
একাধিক গর্ভপাতকে রিকারেন্ট মিসক্যারেজ বলা হয়। সাধারণত্য ১% নারী-পুরুষ এই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন।
৪. থ্রেটেন্ড মিসক্যারেজ
আপনার সার্ভিক্স বন্ধ থাকলেও এক্ষেত্রে আপনি পেলভিক ক্র্যাম্পের মুখোমুখি হবেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের কড়া নজরদারিতে আপনার গর্ভধারণ চলতে পারে, তবে যেকোন সময় গর্ভপাতের সম্ভাবনা থেকে যায়।
৫. ইনএভিটেবল মিসক্যারেজ
এক্ষেত্রে আপনার রক্তপাত, ক্র্যাম্প ইত্যাদি হবে এবং আপনার সার্ভিক্স খুলে যাওয়া শুরু করবে। সাধারণত অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড বেরিয়ে গেলে এক্ষেত্রে গর্ভপাতকে এড়ানো কঠিন হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে সেটি কমপ্লিট মিসক্যারেজের দিকে এগোতে থাকে।
গর্ভপাত কেন হয়?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিসক্যারেজ হয়ে থাকে ভ্রুণ যেভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা, সেভাবে বেড়ে ওঠে না বিধায়। এর মধ্যে শতকরা ৫০ শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে গর্ভপাত বাড়তি বা মিসিং ক্রোমোজোমের কারণে হয়ে থাকে। বেশিরভাগ সময় ক্রোমোজোমের এই সমস্যাগুলো বাবা-মায়ের জন্য নয়, ভ্রুণের বৃদ্ধি ও গঠনের উপর নির্ভর করে হয়ে থাকে।
ক্রোমোজোমজনিত সমস্যার কারণে গর্ভকালীন সময়ে-
-
ব্লাইটেড ওভাম, যেখানে কোন ভ্রূণই তৈরি হয়নি
-
ইন্ট্রটেরাইন ফেটাল ডিমাইস, যেখানে একজন নারী গর্ভপাত বা গর্ভধারণের কোন লক্ষণই বুঝতে পারেননি এবং
-
মোলার বা আংশিক মোলার প্রেগনেন্সি, যেখানে দুইটি ক্রোমোজোমই বাবার কাছ থেকে আসে ইত্যাদি সমস্যাগুলো হতে পারে।
এক্ষেত্রে অবশ্য মোলার বা আংশিক মোলার গর্ভধারণকে চিকিৎসকেরা গর্ভধারণ বলে মনে করেন না, যেহেতু দুইটি ক্রোমোজোমই বাবার কাছ থেকে আছে এবং প্ল্যাসেন্টা আর ভ্রুণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
মায়ের শরীরের নানারকম সমস্যার কারনেও এই গর্ভপাত হতে পারে, যেমন-
-
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস
-
সংক্রমণ
-
হরমোনজনিত সমস্যা
-
ইউটেরাস বা সারভিক্সের সমস্যা
-
থাইরয়েডের সমস্যা
সাধারণত, প্রথম ট্রাইমেস্টারের ক্রোমোজোম সংক্রান্ত সমস্যার কারণেই বেশি গর্ভপাত হলেও এরপর গর্ভপাত হলে সেটা মায়ের শারীরিক সমস্যা বা ইনফেকশনের কারণেই হয়ে থাকে। দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে মিসক্যারেজগুলো হয়ে থাকে দীর্ঘকালীন স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যেমন ডায়াবেটিস, কিডনি, এপিএস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ফুড পয়জনিংও ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।
তবে অনেকেই ভেবে থাকেন ব্যায়াম, সাইকেল চালানো, শারীরিক সম্পর্ক, অতিরিক্ত কাজ করা ইত্যাদির কারণেও এমন মিসক্যারেজ হয়, যা মোটেও সত্যি নয়। অনেকে আবার গর্কালীন সময়ে ঝাল ঝাবার ও বিমানে চলাচল থেকে দূরে থাকেন। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে এই কারণগুলোও খুব একটা কাজ করে না।
গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাব্য সময় কোনটি?
প্রাথমিক গর্ভকালীন সময়ে হওয়া দূর্ঘটনাকেই মূলত গর্ভপাত বলা হয়। এই সময় গ্যাস্টেশনাল স্যাকে যে ভ্রুণ থাকে তাতে প্রথম ছয় বা সাত সপ্তাহ পর্যন্ত কোন হৃদস্পন্দন থাকে না। এইসময় গর্ভপাত হওয়ার ৩১ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে।
গর্ভধারণের সময় ছয় সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা কমে ১০ শতাংশে চলে যায়। এই সময় হার্টের বিট পাওয়া যাওয়ায় গর্ভপাতের সম্ভাবনা কমে আসে। সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারের দিকে, অর্থ্যাৎ, গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহের পর গর্ভপাতের সম্ভাবনা কমে ১ শতাংশে নেমে আসে। তবে এরপরেও যে গর্ভপাতের সম্ভাবনা একেবারে থাকে না তা না।
গর্ভপাতের লক্ষণগুলো কী?
গর্ভপাতের সময় সবচেয়ে বেশি যে লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় সেটি হলো ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং। হালকা রক্তপাত থেকে শুরু করে বাদামী স্রাব, এমনকি বড় বড় জমাট রক্ত পর্যন্ত দেখা দিতে পারে এসময়। তবে এই রক্তপাত মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়ে আবার শুরু হতে পারে।
উল্লেখ্য, গর্ভধারণের প্রথম ট্রাইমেস্টারে হালকা রক্তপাত হতে পারে এবং তার মানে এই নয় যে সেটা গর্ভপাতই। তাই এক্ষেত্রে রক্তপাত দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সাথে কথা বলে নেওয়াটাই ভালো। রিকারেন্ট মিসক্যারেজের ক্ষেত্রে অবশ্য এমন সমস্যা হলে সরাসরি প্রেগন্যান্সি ইউনিটে পরীক্ষার জন্য যাওয়া ভালো।
এছাড়াও গর্ভপাতের লক্ষণ হিসেবে-
-
তলপেটে ব্যথা
-
ভ্যাজাইনা থেকে টিস্যু বা ফ্লুইড বের হওয়া
-
গর্ভধারণের লক্ষণ না বোধ করা ইত্যাদিও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা।
গর্ভপাতের ঝুঁকি কাদের জন্য বেশি থাকে?
গর্ভধারণের ক্ষেত্রে একাধিক বিষয় রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। সেটি যেমন বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, তেমনি ভ্রুণ বা উভয় কারণের জন্যই হতে পারে। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে যে কারণগুলো ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে ভূমিকা রাখে সেগুলো হলো-
-
মা-বাবার জীবনযাপন পদ্ধতি। মা-বাবা যদি মানসিক চাপ, ধূমপান, মদ্যপানের মতো অভ্যাসের সাথে যুক্ত থাকেন, সেক্ষেত্রে এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
-
বাবা-মায়ের বয়স। এক্ষেত্রে ১৫ বছরের কম এবং ৩৫ বছরের বেশি বয়সীর ক্ষেত্রে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
-
পূর্বে গর্ভপাতের শিকার হয়েছেন এমন মায়ের ক্ষেত্রে পুনরায় গর্ভপাতের মতো ব্যাপারটির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
-
অনেকে অনেকদিন সন্তান না হওয়ার পর সন্তানধারণ করলে সেক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যার কারণেই গর্ভপাতের মতো ব্যাপার ঘটে।
-
ওজন গর্ভপাতের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। অতিরিক্ত বেশি বা কম ওজন, দুটোই গর্ভধারণের জন্য ক্ষতিকর।
-
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস বা থাইরয়েডের মতো ক্রনিক মেডিকেল কন্ডিশনের কারণেও গর্ভপাত হয়ে থাকে। একইসাথে যৌনমিলনের মাধ্যমে সংক্রমিত অসুখও হতে পারে গর্ভপাতের কারণ।
-
ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, ইউটেরাসের অবস্থার ও আকৃতিও গর্ভপাতের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।
-
কিছুক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্যাফেইন পান বা রেডিয়েশনের মুখোমুখি হলে গর্ভপাতের মতো সমস্যার মুখোমুখি হন নারীরা।
অনেকে ভেবে থাকেন জন্ম নিয়িন্ত্রণ পিল গ্রহণ করলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, সেটি মোটেও সঠিক নয়। তবে হ্যাঁ, উপরিউক্ত কারণগুলোর মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে কোন কারণ গর্ভপাতের জন্য মুখ্য ভূমিকা রাখে, অনেকের জন্য রাখে না। মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, জীবনযাপন পদ্ধতি- এই সবকিছু ভেদে এই সম্ভাবনাও কমে যায় এবং বৃদ্ধি পায়।
গর্ভপাত এড়ানোর উপায়
বেশিরভাগ গর্ভপাতই জেনেটিক অস্বাভাবিকতার কারণে হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে কিছু করার না থাকলেও আপনি যদি গর্ভধারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে কিছু সচেতনতা আপনাকে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করতে পারে। গর্ভপাত থেকে দূরে থাকতে-
-
গর্ভধারণের এক থেকে দুই মাস পূর্ব থেকে প্রতিদিন ৪০০ এমসিজি ফলিক এসিড গ্রহণ করুন
-
নিয়মিত শরীরচর্চা করুন
-
স্বাস্থ্যসম্মত, ব্যালেন্সড ডায়েট গ্রহণ করুন
-
মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকুন
-
ওজন স্বাভাবিক রাখুন
-
ধূমপাত করা থেকে বা ধূমপায়ীর আশেপাশে থাকা থেকে বিরত থাকুন
-
ক্যাফেইন বা অ্যালকোহল পান করা থেকে দূরে থাকুন
-
প্রয়োজনীয় টিকাগুলো দ্রুত গ্রহণ করুন
-
রেডিয়েশন বা আর্সেনিক, লিড ইত্যাদির মতো বিষাক্ত উপাদান থেকে দূরে থাকুন
-
যেকোন আঘাত থেকে আপনার তলপেটকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করুন
-
গর্ভকালীন সময়ে ওষুধ সেবনের ব্যাপারে সতর্ক হোন এবং চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন
-
এক্স-রে ও সংক্রামক অসুখের মতো ব্যাপারগুলো থেকে দূরে থাকুন
মিসক্যারেজ এর দ্বিতীয় পর্বে থাকছে একজন নারীর গর্ভপাত হওয়ার পর কি কি সমস্যা হতে পারে এবং তার চিকিৎসা ও করণীয়। আরও জানতে পারবেন গর্ভপাতের পর আবার সন্তান নেওয়া সম্ভব কিনা?