গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাসঃ পুষ্টির উপর বাড়তি নজর দিতে হবে এখন থেকেই
গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাস একটি উত্তেজনাপূর্ণ সময়। আপনার পেট এই সময়ে বাড়তে থাকবে, এবং আপনার বাচ্চা দ্রুত বিকাশ লাভ করবে। এই মাসেই আপনার সন্তান তাদের রুচি বোধের বিকাশ ঘটায়। আপনার এবং শিশুর উভয়ের জন্যই ভালো পুষ্টির নিশ্চিত করতে হবে এখন থেকেই।
গর্ভবতী মায়ের যত্ন নেওয়ার অর্থ শুধু খাওয়া আর চলাফেরা নিয়ে সাবধান থাকা নয়। গর্ভাবস্থার প্রথম ও দ্বিতীয় মাসের মত তৃতীয় মাসও ফার্স্ট ট্রাইমেস্টারের অন্তর্গত। মূলত নয় থেকে বারো সপ্তাহ সময়কে গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাস বলা হয়। আজকের লেখায় প্রেগনেন্সির এই বিশেষ সময়টা নিয়ে কিছু কথা তুলে ধরব।
তৃতীয় মাসে শিশুর শারীরিক পরিবর্তন
নয় থেকে বারো সপ্তাহ - এই সময়ের মধ্যে শিশুর কঙ্কালতন্ত্র গঠিত হয়, তবে হাড়গুলো খুবই কোমল ও নমনীয় থাকে। তৃতীয় মাস শেষ হতে হতে বাচ্চার বাহ্যিক গঠন প্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যায়। বাচ্চার কান, হাত, পা, হাত পায়ের আঙুল পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হয়। দাঁত ও হাতের নখ তৈরি হওয়া শুরু হয়। পাশাপাশি যৌনাঙ্গ, মূত্রনালি সহ অন্যান্য রেচন তন্ত্র গঠন হতে থাকে। মোটকথা ভ্রূণ থেকে পূর্ণাঙ্গ মানব শিশু হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া এই মাসেই শুরু হয়।
মায়ের সম্ভাব্য শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন
-
ধীরে ধীরে মায়ের জরায়ু বড় হতে থাকে। এ মাসের শেষদিকে আপনার বাহ্যিক অবয়ব দেখে আপনার প্রেগনেন্সি সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায়।
-
যেহেতু গর্ভস্থ শিশু আকারে বড় হচ্ছে, তাই মায়ের ওজন বাড়তে শুরু করে। স্তন ভারী হয়ে যায় এবং শরীরে রক্তের ভলিউম বেড়ে যায়।
-
পুরানো জামাকাপড় আস্তে আস্তে টাইট হতে শুরু করে, গর্ভবতী মা ঢিলাঢালা লুজ ফিটিং পোশাকে আরাম বোধ করেন।
-
তৃতীয় মাসেও প্রথম দুই মাসের মতই মর্নিং সিকনেস বা বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরানো বজায় থাকে। তবে শেষ দিকে ক্রমেই এ সমস্যা কমে আসতে থাকে। স্ফীত হয়ে ওঠা জরায়ু মূত্রাশয় বা ব্লাডারের উপর চাপ দেওয়ায় বার বার প্রস্রাবের বেগ হতে পারে।
-
পর্যাপ্ত ঘুমানো সত্ত্বেও প্রথম দুই মাসের মতই তৃতীয় মাসেও মা ক্লান্ত, অবসন্ন বোধ করতে পারেন।
-
হরমোনের ওঠানামার কারণে খাবার স্লো ডাইজেশন হয় অর্থাৎ খাবার হজম হতে বেশি সময় নেয়। এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য বা বদহজম হতে পারে। অনেক মা এ সময় পেট ফাঁপা কিংবা টক ঢেকুর ওঠার অভিযোগ করে থাকেন।
-
এছাড়াও বিভিন্ন হরমোনের কারসাজিতে অন্ননালী এবং পাকস্থলী রিলাক্সড অবস্থায় থাকে। ফলে হার্টবার্ন বা বুক জ্বালা পোড়া হতে পারে।
-
তেলতেলে মুখ, ব্রণসহ স্কিনের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
-
শরীরে বিশেষ করে স্তনের চারদিকে, পেটে, কোমড়ে বা নিতম্বে স্ট্রেচ মার্ক দৃষ্টিগোচর হতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। এ নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নেই। মা চাইলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কোনো ক্রিম বা তেলজাতীয় স্কিন প্রডাক্ট ব্যবহার করতে পারেন। বাচ্চা জন্মানোর পর থেকেই এই দাগ কমতে শুরু করে। তাই স্ট্রেচ মার্ক নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
-
এ সময় শরীরে অতিরিক্ত এস্ট্রোজেনের কারণে অতিরিক্ত যোনি স্রাব হতে পারে।
এই মাসে আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যানের মাধ্যমে বাচ্চার নড়াচড়া দেখা যায়। তবে মা এখনই সেটা অনুভব করতে পারবেন না।
যদিও এ মাসের শেষদিকে মিসক্যারেজ হবার সম্ভাবনা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তবে গর্ভাবস্থার পুরোটা সময় ধরেই মাকে বিভিন্ন রকম সতর্কতা মেনে চলতে হয়।
তৃতীয় মাসে মায়ের করনীয়
তৃতীয় মাসে মায়ের কি কি করা উচিত আর কি কি করা উচিত নয় আসুন সেই সম্পর্কে জেনে নেই এখন -
-
এ সময় মায়ের দরকার পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম। চিত হয়ে না ঘুমিয়ে মায়ের কাত হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে।
-
হালকা সুতির ঢিলাঢালা পোশাক পড়তে হবে। যেহেতু এই মাস থেকেই জরায়ু এবং জরায়ুর ফলশ্রুতিতে মায়ের পেট স্ফীত হতে থাকে, তাই ঢিলাঢালা জামা কাপড়েই মা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। স্তন ধীরে ধীরে স্তন্যদানের জন্য উপযোগী হয়ে ওঠে। ফলে আরামদায়ক ব্রা ব্যবহার করাও গুরুত্বপূর্ণ।
-
প্রেগনেন্সিতে অনেক মায়ের মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে। এম্নিতেই গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর ডেন্টিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।
-
এ সময় মায়ের ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ঘুম না হওয়া, ছাড়া ছাড়া ঘুম, মাঝরাতে কোনো কারণ ছাড়াই ঘুম ভেঙে যাবার মত ঘটনা ঘটলে চিন্তিত হবেন না কিংবা ইচ্ছামত ঘুমের ওষুধও খাওয়া যাবে না। নিয়মিত ব্যায়াম, অল্প স্বল্প শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। মোটকথা, মাকে সক্রিয় থাকতে হবে।
-
মায়ের দরকার স্বাস্থ্যকর, ঘরে তৈরি, সুষম একটি খাদ্য তালিকা। প্রতি বেলায় খাবারে প্রাণীজ প্রোটিন এবং ফলমূল তাজা সব্জির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আয়োডিন ও ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। রোজ অন্তত এক গ্লাস দুধ, একটি মৌসুমি ফল এবং একটি করে ডিম মাকে অবশ্যই খেতে হবে।
-
এ সময় মায়ের মুড ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়। মুড সুয়িং গর্ভবতী মায়েদের একটি প্রধান সমস্যা। নিজের শরীরের এই হঠাৎ পরিবর্তন মায়েদের দিশাহারা করে তোলে। পুরানো পছন্দের জামাটা গায়ে ফিট হচ্ছে না, আগের মত দৌড়ঝাঁপ করে কোনো কাজ করা যাচ্ছে না। এমন হাজারটা পরিবর্তনের মাঝে মায়ের বার বার মুড সুয়িং হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পরিবারের বাকি সদস্যদের সাহায্য প্রয়োজন। সকলে মিলে ঘরের কাজ ভাগ করে নেওয়া, গর্ভবতী মাকে সময় দেয়া, প্রেগনেন্সির শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন দিক নিয়ে নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি আলোচনা করলে এই সমস্যা খুব সহজেই কাটিয়ে ওঠা যাবে।
-
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন এবং ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্টেশন নেয়া যেতে পারে।
-
পার্সোনাল হাইজিন এ সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। অনেকেই মনে করে পার্সোনাল হাইজিন বলতে শুধুমাত্র যৌনাঙ্গ ও তার আশেপাশের জায়গা পরিষ্কার রাখাকে বুঝায়। বিষয়টা মোটেই সেরকম নয়। নিয়মিত গোসল করা, হাত পাতের নখ কাটা, নিয়মিত দাঁতের যত্ন নেয়া, বহিঃ যৌনাঙ্গ পরিষ্কার রাখা এই সবই পার্সোনাল হাইজিনের মধ্যে পড়ে।
-
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। অন্তত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা, রক্তে শর্করার পরিমাণ এবং রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেশার নিয়মিত পরীক্ষা করাতে হবে।
তৃতীয় মাসে যা যা করা যাবে না
-
ভারী কাজ করা যাবে না। আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে গর্ভবতী মায়েরা একদম আট নয় মাস পর্যন্ত ঘরের সব কাজ স্বাভাবিক নিয়মেই করতে থাকেন। দূর থেকে খাবার পানি আনা, ভারী জিনিসপাতি তোলা কোনো কাজই বাদ দেন না। এটা একেবারেই উচিত না। একজন গর্ভবতী মা অবশ্যই তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেন, তবে এ ধরনের ভারী কাজ না করাই ভালো।
-
ক্রমবর্ধমান জরায়ুর কারণে ট্রান্সভার্স সারভাইকাল লিগামেন্ট সহ অন্যান্য লিগামেন্ট প্রসারিত হয়। ফলে অনেক মা পিঠে বা কোমড়ে ব্যথার অভিযোগ করে থাকেন। মনে রাখতে হবে, ব্যথা বেদনা যাই হোক না কেন ব্যথা কমানোর ওষুধ সহ যেকোনো ওষুধ খাবার আগে অতি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
-
বিভিন্ন রকম জাংক ফুড কিংবা সী ফুড খাওয়া থেকে মাকে বিরত থাকতে হবে। মায়েরা এ সময় এম্নিতেই বদহজম, বুক জ্বালাপোড়ার মত সমস্যায় ভোগেন। জাংক ফুড সেই সম্ভাবনা আরো বাড়িয়ে দেয়। আমাদের ত্রুটিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে নদী নালা খাল বিলের পাশাপাশি সমুদ্রও মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে। বর্তমানে নানা রকম সী ফুডে উচ্চ মাত্রার মার্কারি বা পারদ এবং অন্যান্য ভারী মৌল পাওয়া যাচ্ছে। তাই এই সময় সী ফুড এড়িয়ে চলাই মঙ্গল।
-
প্রথম তিন মাস দূরপাল্লার ভ্রমণ না করাই ভালো। প্রথম দুই মাসের মত তৃতীয় মাসেও গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে। তাই উঁচু নিচু পথ, ঝাঁকি লাগতে পারে এমন ভ্রমণ এড়িয়ে চলুন। নিতান্তই প্রয়োজন হলে লঞ্চ বা নদীপথে যাবার চেষ্টা করুন। এ সময় বাস জার্নি বা ট্রেন জার্নির চেয়ে লঞ্চ জার্নি অনেক বেশি নিরাপদ এবং স্বস্তিদায়ক।
-
ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ধূমপান গর্ভস্থ শিশুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে গর্ভস্থ শিশুর গ্রোথ রিটারডেশন বা স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, শিশু লো বার্থ ওয়েট (LBW) বা অস্বাভাবিক কম ওজন নিয়ে জন্ম নিতে পারে এমনকি গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে।
-
প্রথম দুই মাসের মতন তৃতীয় মাসেও সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে।
গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাস অথবা ফার্স্ট ট্রাইমেস্টারের শেষ মাস - যেভাবেই বলি না কেন সন্তান প্রত্যাশী দম্পতির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় তাতে সন্দেহ নেই। পৃথিবীর প্রত্যেক মায়ের জন্যই এই সময়টা একই সাথে আনন্দের ও শঙ্কার। গর্ভবতী মা যেন স্বামী ও পরিবারের অন্যদের সহায়তায় এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টা আনন্দে, সাবধানে, স্বস্তিতে কাটান সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে।