ত্রিশোর্ধ নারীদের যে ৭টি পরীক্ষা অবশ্যই করা উচিত
বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হওয়া খুবই জরুরি। বিশেষ করে ৩০ বছর বয়সের পরে নারীদের বিশেষ কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে যেগুলো এড়ানোর জন্য বিশেষ কিছু সচেতন পদক্ষেপ গ্রহন করা উচিত।
-
৩০ বছর বয়সের পরে নারীদের সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণগুলি উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখা যায়
-
অপ্রত্যাশিত ওজন বৃদ্ধি, চুল পড়া, এবং অস্বাভাবিক মোলস (আঁচিল বা তিল) এমন সব জিনিস যা আপনার ত্রিশের শুরুতেই খেয়াল করা উচিত
-
প্রতিরোধমূলক যত্ন আপনাকে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা এড়াতে সাহায্য করতে পারে
২৫ বছরের পর থেকেই নারী শরীরের অসংখ্য কোষের কর্মক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে, ফলে এর প্রভাব শরীরের অনেক অঙ্গে পড়তে শুরু করে। আর এর ফলাফল হিসেবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করে, ত্বকের সৌন্দর্য কমতে থাকে, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমতে শুরু করে। ফলে শরীরে বাসা বাধে নানাবিধ রোগ।
কিন্তু যেহেতু অনেক মহিলা এই দশকে ক্যারিয়ার, বিয়ে, গর্ভাবস্থা এবং সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাই তাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের দেখভাল না রাখা অস্বাভাবিক নয়। এটা একটা মস্ত বড় ভুল। আর তাই বয়স ৩০ পেরুলেই নারীদের উচিত স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানা এবং সেগুলো প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহন করা।
৩০ বছর বয়সের পরে মহিলাদের যে সমস্ত শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে
আগেই বলেছে বয়স ৩০ পার হলে মহিলাদের নানাবিধ স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। চলুন দেখি এই সময় মহিলাদের কি কি সারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে-
১) হাঁপানি
অনেকেই হাঁপানি কে শিশুদের রোগ বলে মনে করেন কিন্তু বড়রাও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি পরিসংখ্যান মতে ৩৫ বছরের পরে মহিলাদের মধ্যে হাঁপানি সংক্রান্ত মৃত্যু ঝুঁকি বেশী থাকে।
২) পিঠে ব্যাথা
পিঠে ব্যাথা বা ব্যাক পেইন খুবই কমন একটি সমস্যা। এমনকি পুরুষ হোক বা নারী, আপনি এমন মানুষ খুব কমই খুঁজে পাবেন যিনি জীবনে কোন না কোন সময় পিঠের ব্যাথায় ভুগে নাই। আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে এই সমস্যা আরো বেশী প্রকট কেননা এখন সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বেড়ে গেছে। আর সিজার পরবর্তী নারীদের মধ্যে পিঠে ব্যাথা খুব কমন।
৩) হৃদরোগ
বিশ্বব্যাপী হৃদরোগ ৩০ ঊর্ধ নারীদের এক নম্বর শত্রু। এমনকি ধীরে ধীরে এই বয়সের সীমা আরো কমে আসছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সার্কুলেশনে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, ৩৫ থেকে ৭৫ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের মোট সংখ্যা কিছুটা কমেছে অপরদিকে, অপেক্ষাকৃত কম বয়সের মহিলাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪) বাত
বাত বা আর্থ্রাইটিস ত্রিশোর্ধ নারীদের আরো একটি সাধারন সমস্যা। আর্থ্রাইটিস ফাউন্ডেশনের মতে, নারীদের বাতের সূত্রপাতের গড় বয়স ৩০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। তবে সত্যি বলতে বাতের নির্ধারিত কোন বয়স নেই, আরো কম বয়সেও নারী শরীরে বাতের আক্রমন হতে পারে। সন্তান জন্মদানের পর ওজন বৃদ্ধিও হাড়ের সন্ধিস্থলের ব্যাথার একটি বড় কারন। তবে ৩০ পেরোলে বাত সংক্রান্ত সমস্যার প্রতি সচেতন হওয়া জরুরি।
৫) হাড় ক্ষয়
এর কারন হল ৩০ বছর হলেই মহিলাদের হাড়ের ঘনত্ব কমতে থাকে। হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে শুরু হয় ব্যাথা। হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারন ক্যালশিয়ামের ঘাটতি। এমনকি গুরুতর পর্যায়ে হাড় ভঙ্গুর পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
৬) মেটাবলিক রেট কমে যাওয়া
অল্প বয়সে মেটাবলিজম বেশী থাকে শরীরে ফলে এলোমেলো খাদ্যাভ্যাসে তেমন কোন সমস্যা হয় না কিন্তু ৩০ পেরোলে শরীরে মেটাবলিক রেট কমতে শুরু করে ফলে আপনার এলোমেলো খাদ্যাভ্যাস আপনার ওজন বৃদ্ধির কারন হতে পারে। আপনার শরীরের ফিটনেস ধরে রাখার জন্য এবং মেটাবলিক রেট বাড়ানোর জন্য নিয়মিত শরীর চর্চা করা অত্যন্ত জরুরি।
৭) ডায়াবেটিস
ওজন বৃদ্ধির সাথে সাথে অনেক মহিলার বয়স ত্রিশ পেরোতে না পেরোতে আরো একটি বড় বোঝা্র সাথে লড়াই করতে হয়, আর সেটা হল টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি এড়াতে ওজন নিয়ন্ত্রন ও পরিমিত খাদ্যাভাস খুবই জরুরি। এছাড়াও নিয়মিত শরীরচর্চা বা হাটা এই রোগের ঝুঁকি অনেকটায় কমিয়ে দেয়।
৩০ বছর বয়সের পরে যে পরীক্ষাগুলো অবশ্যই মহিলাদের করা উচিত
৩০ পেরুলেই যে পৃথিবীর সব রোগ আপনার শরীরে এশে ঘাটি গাড়বে তা কিন্তু নয়। তবে নারী শরীর ৩০ এর পর থেকেই মূলত ক্ষয় প্রাপ্ত হতে শুরু করে ফলে নানাবিধ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই সমস্ত রোগের ঝুঁকি এড়াতে তাই নিয়মিত কিছু শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে নেয়া জরুরি। চলুন দেখি ৩০ বছর বয়সের পরে যে পরীক্ষাগুলো অবশ্যই মহিলাদের করা উচিত।
১) পেল্ভিক এক্সামিনেশন
আপনার বয়স যদি ৩০ পেরিয়ে থাকে তাহলে আপনার জন্য এই পরীক্ষা জরুরি। এতে আপনার জরায়ুর সঠিক অবস্থান জানতে পারবেন। সন্তান জন্মদানের পর অনেক মহিলারই জরায়ু নিচে নেমে যায়, এমনকি অনেক সময় সেটা বাইরে বেরিয়ে আসে, এমন অবস্থায় সেটা অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে কেটে ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না। তবে পেলভিক এক্সামিনেশনের মাধ্যমে আপনি জরায়ুর সঠিক অবস্থান জানতে পারবেন এবং সময় থাকতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
২) প্যাপ স্মেয়ার পরীক্ষা
প্যাপ স্মেয়ার খুব সহজ এবং ব্যাথা মুক্ত একটি পরীক্ষা। জরায়ুমুখ থেকে রস নিয়ে এই টেষ্ট করা হয়। জরায়ু ক্যান্সার শনাক্তকরণের জন্য এটি খুবই কার্যকর একটি পরীক্ষা। ক্যান্সার, ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা, বা জরায়ুমুখের প্রদাহ শনাক্ত করতে এই টেষ্ট করা হয়ে থাকে।
৩) মেমোগ্রাফি
দুনিয়াজুড়ে স্তন ক্যান্সার মহিলাদের জন্য এখন একটি আতংকের নাম। আর ত্রিশোর্ধ নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশী থাকে। স্তন ক্যান্সার প্রাথমিকভাবে দীর্ঘদিন কোন প্রকার লক্ষন প্রকাশ ছাড়াই শরীরে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে। তাই ৩০ বছর বয়সের পর প্রতি ১ বছর পর পর মেমোগ্রাফি করা উচিত। কারন প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা গেলে এই রোগের সাথেও লড়াই করা সম্ভব।
৪) ত্বক পরীক্ষা
স্তন ক্যান্সারের মত ত্বকের ক্যান্সারও ত্রিশোর্ধ মহিলাদের একটি মারাত্বক রোগ। এখন বাজারে অসংখ্য রঙ ফর্সাকারী ক্রিম রয়েছে এবং মহিলারা সেসব ক্রিমের সাইড ইফেক্ট সম্পর্কে না জেনেই ব্যবহার করা শুরু করে। এমনকি অতিরিক্ত নিম্ন মানের মেকআপ ব্যবহারের কারনেও ত্বকের অনেক বেশী ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে যা পরবর্তিতে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। তাই একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর পর ত্বক পরীক্ষা করা জরুরি।
৫) চোখের পরীক্ষা
৩০/৩৫ বছর বয়স পরে শুধু মহিলাদের নয়, পুররুষদেরও দৃষ্টি দুর্বল হতে শুরু করে। মহিলারা সেলাই এবং রান্নার কাজ বেশী করার কারনে তাদের দৃষ্টি আরো দ্রুত কমে। তাই ৩০ বছর পার হলেই নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করানো উচিত।
উপর্যুক্ত পরীক্ষাগুলো ছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ন পরীক্ষা রয়েছে যেগুলো ৩০ বছর পার হলেই নিয়মিত করা দরকার। যেমন-
-
কোলেস্টেরল টেস্ট-দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে হার্টের মারাত্বক ক্ষতি হতে পারে। তাই হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত কোলেস্টেরল টেস্ট করতে হবে।
-
হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা- আগেই বলেছি যে ৩০ বছরের পরেই মহিলাদের হাড়ের ঘনত্ব কমতে শুরু করে এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। হাড়ের ঘনত্ব নির্নয়ের জন্য ডেক্সা স্ক্যান নামে একটি টেস্ট রয়েছে। এই টেস্ট ৩০ বছর পরে সব মহিলাদেরই করা উচিত।
-
ডায়াবেটিস টেস্ট- ডায়াবেটিস বা প্রিডায়াবেটিস নির্নয়ের জন্য মহিলাদের প্রতি বছর বছর রক্তে সুগার টেস্ট করা উচিত। বিশেষ করে যদি মাতৃত্বকালীন রক্তে সুগার বেশী থাকে, ওজন বেশী থাকে বা ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস থাকে তবে অবশ্যই প্রতি বছর বছর রক্তে সুগার টেস্ট করা উচিত।
৩০ বছর বয়সের পর মহিলাদের জীবনযাপনের কিছু নিয়ম
বয়সের বৃদ্ধির সাথে সাথে পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই জীবন যাত্রায় পরিবর্তন আনা জরুরি। বিশেষ করে ত্রিশোর্ধ মহিলাদের শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং কর্মক্ষমতা কমে যায়। তবে ৩০ বছর বয়সের পর মহিলাদের জীবনযাপনের কিছু নিয়ম মেনে চললে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক সমস্যা থেকে বেচে থাকা যায়। চলুন দেখি সেই নিয়মগুলো কি কি-
-
কফি খাওয়া কমিয়ে দিন এমনকি চায়ের সাথেও দুধ এবং চিনি বন্ধ করে দিন।
-
শরীর যাতে ভেঙ্গে না পড়ে তাই ধুমপান এবং অ্যালকোহলকে পুরোপুরি না বলুন।
-
৩০ পেরোলে নারীদেহে পটাশিয়ামের ঘাটতি দেখা যায় তাই নিয়মিত পাকা কলা খাওয়া উচিত।
-
সারা দিনে ৩টা বড় মিল এবং দুই মিলের মাঝখানে হালকা ২টা ছোট মিল নিতে হবে। প্রতি বেলায় পরিমিত খাবার সময় মত খেতে হবে।
-
প্রতিবেলার খাবারে সবজি রাখুন। বিশেষ করে পালং শাক। কারন এতে আছে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন এ, বি২, সি, ই, কে, এবং ফসফরাস ও জিংক।
-
হাড়কে মজবুত রাখতে ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খান। চর্বি জাতীয় খাবার যথা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।
-
সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন আধাঘন্টা হালকা শরীরচর্চা করুন। প্রতিদিন নিয়ম করে হাটুন।
-
যে কোন শারীরিক সমস্যাকে ছোট করে দেখবেন না।
৩০ বছর বয়সের পরে মহিলাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও কিছু সচেতন পদক্ষেপ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আপনি যদি ত্রিশোর্ধ নারী হোন তাহলে এই আর্টিকেল আপনার জীবনযাপনের মান উন্নয়নে সাহায্য করবে। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।