প্রথম সন্তান নেওয়ার পর যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে
প্রথম সন্তান যেন একটি পরিবারে সুখ ও আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। আর প্রথম সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে মায়ের ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা সবই কিছুটা বেশি থাকে। একই কথা সন্তানের বাবা এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের জন্যও প্রযোজ্য। তবে সন্তান জন্মের পর থেকে সবারই কিছু বিষয় অবশ্যই জানতে হবে।

প্রথম সন্তান জন্মের পর একজন মায়ের আবেগ এবং শরীর অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। প্রসবোত্তর সময়কালে একজন মা এবং পরিবারের সবাই কীভাবে নবজাতকের যত্ন নিবে এবং কীভাবে একটি পরিবর্তিত পারিবারিক ইউনিট হিসাবে কাজ করবে তা জানা একান্ত দরকার। আসুন আমরা এই বিষয়ে বিশদ জেনে নেই।
প্রসবোত্তর সময়কাল সাধারণত একজন মায়ের শিশু প্রসবের পরে শুরু হয় এবং যখন মায়ের শরীর পুনরায় প্রায় গর্ভবতী অবস্থায় ফিরে আসে তখন শেষ হয়। এই সময়কাল প্রায়ই ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
সন্তান জন্মের পরের প্রথম ৪৮ ঘন্টা
প্রসবের পর প্রথম ৪৮ ঘন্টা মাকে একটু সতর্ক অবস্থানে থাকতে হয়। নিজের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার, ইনফেকশন যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা, সন্তানকে ব্রেস্ট ফিড করানো সব মিলিয়ে নতুন মাকে বেশ সতর্কতার সাথে কাজ করতে হয়। হোম ডেলিভারি অর্থাৎ বাড়িতেই নর্মাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে মা প্রসবের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই উঠে বসতে পারেন, অল্প অল্প হাঁটাচলাও করতে পারেন। তবে সিজারিয়ান সেকশন বা নর্মাল ডেলিভারি উইথ এপিসিওটমির জন্য অন্তত ২৪ ঘন্টা পূর্ণাঙ্গ বিশ্রাম প্রয়োজন। মা যত তাড়াতাড়ি হাঁটা চলা শুরু করবে, মায়ের Bowel & Bladder অর্থাৎ প্রস্রাব এবং কোষ্ঠকাঠিন্য জনিত সমস্যা তত কম হবে।
প্রসবের পর প্রথম ১৫ দিন মায়ের যোনীপথ দিয়ে Lochia নামক ডিসচার্জ বের হতে থাকে। প্রথম ৪ দিন এর বর্ণ থাকে লাল, পরে হলুদ, শেষদিকে হালকা সাদা। প্রথম মা হয়েছেন এমন নারীরা অনেকেই এই ডিসচার্জকে অস্বাভাবিক ভেবে ভয় পান। এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। তবে ডিসচার্জ থেকে অস্বাভাবিক বাজে গন্ধ এলে বা ডিসচার্জের পরিমাণ অতিরিক্ত বেশি বা অতিরিক্ত কম হলে অথবা ১৫ দিনের পরও ডিসচার্জ বন্ধ না হলে ইনফেকশন হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়৷ এই ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ না করে নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।
ব্রেস্ট ফিডিং নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনেকে ৬ মাস পূর্ণ হবার আগেই বাড়তি খাবার দিয়ে দেন। অনেকে আবার বাচ্চা খেতে চায় না বলে স্তনদান নিজে নিজেই বন্ধ করে বাজারের ফর্মুলা খাওয়াতে শুরু করেন। আবার ব্রেস্ট ফিডিং করানোর জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। একে 'প্রপার পজিশনিং এবং প্রপার এটাচমেন্ট' বলা হয়। আমাদের দেশের যেকোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই সংক্রান্ত পোস্টার বা দেয়ালিকা টানানো রয়েছে। তাও প্রথম বার মা হয়েছেন এমন মায়েরা যদি পোস্টার দেখে বিষয়টা না বোঝেন অথবা বুঝিয়ে দেয়ার মত পরিবারের কোনো বয়স্ক সদস্য যদি না থাকে তবে স্বাস্থ্য কর্মী বা ডাক্তারের কাছ থেকে বুঝে নিতে পারেন। কোনো অবস্থাতেই ৬ মাসের আগে অন্য খাবার শিশুকে দেয়া যাবে না।
সন্তান জন্মের পর পোস্ট ন্যাটাল ভিজিট খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চা ঘরে হোক কিংবা হাসপাতালে, জন্মের পর মা ও শিশু উভয়েরই প্রথম ৬ সপ্তাহের মধ্যে অন্তত ৩ বার হসপিটাল ভিজিট আবশ্যক। মায়ের কোনো অস্বাভাবিক ব্লিডিং আছে কিনা, সেপসিস হবার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কিনা, জরায়ুর ইনভলিউশন ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, প্রথম বার ব্রেস্ট মিল্ক আসায় মায়ের স্তনে কোনো অস্বাভাবিকতা তৈরি হচ্ছে কিনা এসব জানার জন্য পোস্ট ন্যাটাল ভিজিট আবশ্যক।
এবার আসা যাক দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে। প্রথম মা হবার পর ফ্যামিলি প্ল্যানিং সহ অনেক বিষয়েই মায়েরা বিভ্রান্তিতে থাকেন। সেসব বিষয়েও কিছু কথা জেনে নেয়া যাক।
ফ্যামিলি প্ল্যানিং এবং বার্থ স্পেসিং
প্রথম সন্তান নেওয়ার ঠিক কতদিন পরে দ্বিতীয় সন্তান নেয়া উচিত তার স্পেসিফিক কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। নিজেদের সুযোগ সুবিধা ও মায়ের শারীরিক সক্ষমতা অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। তবে একটি সন্তান জন্ম দেয়ার পর মায়ের শারীরিক ক্ষয় পূরণ ও আরেকটি সন্তান জন্ম দেবার ধকল বহন করার মত শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুযায়ী এজন্য ১৮ থেকে ৩৬ মাস সময় প্রয়োজন। তাই অন্তত দেড় থেকে দুই বছর অপেক্ষা করে তবেই দ্বিতীয় সন্তান নেয়া উচিত৷ অন্যথায় মা ও শিশু দুজনেরই ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। ৩৫ বছর বা তার বেশি বয়স্ক মায়েদের জন্য এই আশঙ্কা আরো বেশি৷ বিশেষ করে এসব ক্ষেত্রে সন্তানের প্রিম্যাচ্যুরিটির সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়৷
প্রসব পরবর্তী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
নর্মাল ডেলিভারি বা সিজারিয়ান সেকশনের ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম নেবার পর প্রথম ৩ মাস সহবাস থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হয়। এবং এর পরবর্তী ৩ মাস সহবাসে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়। ভ্যাজাইনাল ডেলিভারিতে অনেক সময় মায়ের ভ্যাজাইনাল ওয়ালে Episiotomy নামক ইনসিশন দেয়া হয়। এই ক্ষেত্রে চিকিৎসক অতিরিক্ত আরো কয়েক সপ্তাহ সহবাস থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
জন্মের পর বাচ্চা যতদিন মায়ের বুকের দুধ খাবে, ততদিন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কম্বাইন্ড OCP যাকে আমরা রেগুলার পিল হিসেবে চিনি, মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে সন্তানের শরীরে পৌঁছে রিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তাই প্রজেস্টেরন অনলি পিল (POP) বা মিনিপিল ব্যবহার করাই শ্রেয়। এছাড়াও কনডম বা কপার টি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সন্তান জন্মদান পরবর্তী বিষণ্ণতা
আমাদের দেশে সন্তান জন্ম দেবার পর নবজাতকের প্রতি যতটুকু মনোযোগ দেয়া হয়, তার সিকিভাগও জন্মদাত্রী মাকে দেয়া হয় না। পোস্ট পার্টাম ব্লুজ, পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন, পোস্ট পার্টাম সিজোফ্রেনিয়া - এসব নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হতে দেখা যায় না। এক সমীক্ষা অনুযায়ী শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ মা প্রসব পরবর্তী বিষন্নতায় আক্রান্ত হন। সাধারণত প্রসবের পর প্রথম ৩ মাসের মধ্যেই এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে৷ অতিরিক্ত চিন্তা করা, সারাদিন খিটখিটে মেজাজ, কোনো কারণ ছাড়াই কান্নায় ভেঙে পড়া, সন্তানের প্রতি অবহেলা, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা এমনকি আত্নহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়।
পোস্ট পার্টাম ব্লুজ এই সমস্যার প্রথম ধাপ। সাধারণত এর জন্য ওষুধপত্র দরকার পড়ে না। পরিবারের বাকি সদস্যদের সহায়তা এবং পরিচর্যায় এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
তবে পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন এবং পোস্ট পার্টাম সাইকোসিসের জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিভিন্ন রকম এন্টি ডিপ্রেসিভ ওষুধ বা হরমোনাল প্যাচের মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা হয়৷ আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ মনে হলেও নিয়মিত ফলোআপ চালিয়ে যেতে হবে এবং পরবর্তীতে বাচ্চা নেবার সময় যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
শারীরিক ফিটনেস
গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের দশ থেকে এগারো কেজি ওজন বাড়ে। বাচার জন্মের পর ধীরে ধীরে এই ওজন কমতে শুরু করে। সন্তান জন্মের সাথে সাথেই ৫ থেকে ৬ কেজি ওজন কমে যায়। আর মায়ের শরীরের বাড়তি ওজন কমতে ছয় থেকে আট মাস, কারো কারো ক্ষেত্রে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগে। তবে অনেক মায়ের পক্ষেই একদম ঠিক আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। ছয় মাস পরেও যদি মায়ের শরীর আগের অবস্থায় ফিরে না যায় তাহলে জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং এক বছর পরেও যদি অবস্থার পরিবর্তন না ঘটে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অতিরিক্ত ওজন কমানোর প্রথম ধাপ হচ্ছে একটি ডায়েট চার্ট মেনে চলা। সন্তান জন্মের পর বেশি বেশি না খেয়ে বরং সুষম ও পুষ্টিকর খাবার বারে বারে খাওয়া উচিত। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে সেটা মায়ের অতিরিক্ত ক্যালরি ঝরানোর পক্ষে কাজ করে। তাই প্রথম ছয় মাস শিশুকে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং করানো আবশ্যক। নিজেকে সব সময় সক্রিয় রাখুন। প্রতিদিন নিয়ম করে অন্তত ৩০ মিনিট হালকা ব্যায়াম করুন। অনেক মা শরীরের স্ট্রেচ মার্কের জন্য কমপ্লেক্সে ভোগেন। এর জন্য একজন ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নিতে পারেন।
ইমিউনাইজেশন
সন্তান জন্মের পর ইমিউনাইজেশন বা টিকা প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শুধু বাচ্চার জন্যই নয়, মায়ের জন্যও। বাংলাদেশ সরকারের EPI শিডিউল অনুযায়ী বাচ্চাকে সমস্ত টিকা সময় মত দিতে হবে। পাশাপাশি মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ এবং বাচ্চার গ্রুপ যদি পজিটিভ হয় তাহলে প্রসবের পর পরই মাকে এন্টি ডি গামা গ্লোবিউলিন ইনজেকশন দিতে হবে। যেন পরবর্তী গর্ভধারণের সময় Rh-incompatibility তৈরি হয়ে বাচ্চার ক্ষতি না হয়। রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ এমন মায়েদের প্রথম সন্তান জন্মের ৭২ ঘন্টার মধ্যে এই ইনজেকশন নিতে হবে। নতুবা পরবর্তী সন্তান এরিথ্রোব্লাস্টোসিস ফিটালিস নামক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
প্রথম সন্তান জন্ম দেয়া মায়ের জীবনে একটি প্রধান মাইলফলক। সন্তান জন্ম দেয়ার পর মায়ের দায়িত্ব শতগুণ বেড়ে যায়। তাই নিজের ও সন্তানের প্রতি মাকে সচেতন হতে হবে। মা হওয়া মানেই বুড়িয়ে যাওয়া নয়, বরং জীবনের অন্য একটি দরজা খুলে যাওয়া মাত্র এটা মাথায় রেখেই মাকে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে।