গর্ভাবস্থার পঞ্চম মাসঃ আপনার সন্তানের দুষ্টামি শুরু হবে এই মাসেই
চতুর্থ মাস শেষ করে পঞ্চম মাস এসে পরেছে। নতুন মা হবার আনন্দ ও উত্তেজনায় একে একে চারটি মাস আপনি পার করে ফেলেছেন। এখন আপনি পাঁচ মাসের গর্ভবতী। এই মাসটি সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারের দ্বিতীয় মাস। আসুন জেনে নেই কি হতে যাচ্ছে এই মাসে।
গর্ভাবস্থার পঞ্চম মাসে, আপনার শিশু আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে, বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলায়। আপনি হয়তো এই মাসের শুরুতে আপনার বাচ্চার নড়াচড়া এবং তারপর লাথি মারাও বুঝতে পারবেন। মাসের শেষের দিকে, আপনার শিশু নিয়মিত নড়াচড়া এবং ঘুমের একটি রুটিনের মধ্যে স্থির হয়ে যাবে। আর যখন আপনি বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করবেন ঠিক তখন আপনি দেখতে পাবেন যে শিশুটি সবচেয়ে বেশি নড়াচড়া করছে।
পঞ্চম মাসে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি
প্রতিটি শিশু নিজ নিজ গতিতে বেড়ে ওঠে। শিশুর বেড়ে ওঠা জেনেটিক ও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে।
পঞ্চম মাসে গর্ভস্থ শিশু প্রায় আট থেকে বারো ইঞ্চির মত লম্বা হয়। এই সময়ে শিশুর ত্বক ভার্নিক্স নামক একটি তৈলাক্ত পদার্থ দিয়ে আবৃত থাকে যা শিশুর ত্বককে সুরক্ষা প্রদান করে। পূর্ববর্তী মাসগুলোতে তৈরি হওয়া হাত পায়ের আঙুল এই মাসে আরো ভাল ভাবে গঠিত হয়, শিশুর যৌনাঙ্গ ও ভোকাল কর্ড বিকশিত হয়। মুখ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুখগহ্বরের টেস্টবাড তৈরি হয়। স্নায়ুতন্ত্র কাজ করতে শুরু করে, একটি নির্দিষ্ট বিরতিতে বাচ্চা ঘুমাতে এবং জেগে উঠতে শুরু করে। এছাড়াও মানুষের স্বাভাবিক দৈহিক রিফ্লেক্স যেমন হাই তোলা, আঙুল চোষা, মুখের নানা অঙ্গভঙ্গি করা, হাত পা ছোড়ার মত কাজও বাচ্চা এই পর্যায়ে করতে সক্ষম হয়।
পঞ্চম মাসের উপসর্গ
গর্ভধারণের পঞ্চম মাসে এসে একজন নারীর যে লক্ষণ ও উপসর্গ গুলি দেখা যায় তা হল-
বাচ্চার নড়াচড়া টের পাওয়া যায়
প্রাইমি বা প্রথম বার মা হচ্ছেন এমন মহিলাদের চেয়ে যারা এর আগেও মা হয়েছেন তারা এই নড়াচড়া আগে বুঝতে পারেন। প্রথম বার নিজের সন্তানের নড়াচড়া টের পাওয়াটা আসলেই অসাধারণ একটা বিষয়।
বেবি বাম্প
পঞ্চম মাসে জরায়ুর আকার অনেকটা বেড়ে যায়। ফলে এই মাসে বেবি বাম্প প্রকট হয়ে ওঠে। এ সময় গর্ভবতী মায়ের বাইরের অবয়ব দেখলে তার গর্ভাবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়।
স্তনের পরিবর্তন
পঞ্চম মাসে স্তনের আকার উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পায়। নবাগত শিশুর প্রথম খাদ্য কলোস্ট্রাম যাকে আমরা প্রচলিত বাংলা ভাষায় বলি শাল দুধ; এই কলোস্ট্রাম তৈরির যোগাড়যন্ত্র পঞ্চম মাসেই শুরু হয়ে যায়। এ কারণে স্তন বড় দেখায় ও ভারী বলে মনে হয়। এই সময় অনেক মায়ের ফোঁটা ফোঁটা কলোস্ট্রাম নিঃসৃত হতে পারে। তবে এতে ভয় পাবার কিছু নেই।
খিদে বেড়ে যায়
প্রথম ট্রাইমেস্টারের বমি বমি ভাব, খেতে অনীহার মত সমস্যা গুলি পঞ্চম মাসে সাধারণত থাকে না। বরং এ সময় অনেক মায়ের খিদে বেড়ে যায়। অনেক মায়ের নির্দিষ্ট কোনো খাবারের জন্য তীব্র আগ্রহ বা ক্রেভিং হয়। আপনি যদি একজন গর্ভবতী মা হয়ে থাকেন কিংবা আপনার স্ত্রী বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য যদি সন্তানসম্ভবা হয়ে থাকেন, আর তিনি যদি রাত বিরাতে আইসক্রিম কিংবা ফুচকা খাবার আবদার করে বসেন তাহলে এতে বিরক্ত হবেন না। এটি গর্ভাবস্থার একটি কমন সিনারিও।
ওজন বৃদ্ধি
পঞ্চম মাস পুরো গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি একটা সময়। প্রথম চার মাস পার হয়ে গেসে, আরো চার মাস বাকি এমন একটা সময়। এই পঞ্চম মাসে গর্ভের সন্তান দ্রুত বাড়তে থাকে। মোটামুটিভাবে এ সময় মায়ের ওজন ২-৪ কেজি পর্যন্ত বাড়তে পারে।
লেগ ক্র্যাম্প
বাড়তে থাকা ওজন অনেক সময় লেগ ক্র্যাম্পের কারণ হতে পারে।
শ্বাসকষ্ট এবং বার বার প্রস্রাবের বেগ
আগেই বলেছি, গর্ভের শিশু এ সময় দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বাড়তে থাকা জরায়ু পেলভিসের বরাদ্দ জায়গা থেকে অনেকটাই বাইরে চলে আসে। ক্রমবর্ধমান জরায়ু ডায়াফ্রাম তথা ফুসফুসে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। ফলে মা শ্বাস নিতে কষ্ট অনুভব করেন।
আবার এই বাড়তে থাকা জরায়ু ব্লাডার বা মূত্রথলির উপরেও চাপ দেয়। ফলে বার বার প্রস্রাবের বেগ হতে থাকে।
স্ট্রেচ মার্কস
গর্ভাবস্থা এবং বাচ্চা জন্ম হবার পরেও যে লক্ষণটি নিয়ে মায়েরা বেশি চিন্তিত থাকেন তা হল স্ট্রেচ মার্কস। তলপেট, স্তন, উরু এবং নিতম্বের চারপাশে সাদা ছোট রেখার আকারের এই স্ট্রেচ মার্কস মায়েদের পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন বা বাচ্চার জন্ম পরবর্তী বিষণ্ণতার অন্যতম কারণ। ত্বকের তুলনায় শরীরের দ্রুত বৃদ্ধির কারণে এটি হয়ে থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে বাচ্চা জন্মানোর পর এগুলো আপনাআপনি মিলিয়ে যায়, আবার অনেক মায়ের এর জন্য ডার্মাটোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হয়।
কালচে ত্বক
গর্ভবতী মায়ের শরীরে মেলানিন উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে ত্বকের বিভিন্ন অংশ কালো কালো হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে মুখের বিভিন্ন অংশ যেমন কপাল, গাল ও নাকের আশেপাশে কালো হয়ে যায়।
মাড়ি থেকে রক্ত ক্ষরণ
গর্ভবতী মায়ের নরম ও সংবেদনশীল মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে। এতে ভয় পাবার কিছু নেই। গর্ভাবস্থায় হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে এটি হয়ে থাকে।
কোষ্ঠকাঠিন্য
অন্যান্য মাসের মত এ মাসেও মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য বজায় থাকে। আসলে গর্ভাবস্থার পুরোটা সময় জুড়েই মায়ের এই সমস্যাটা কম বেশি চলতে থাকে। গর্ভাবস্থায় খাবারের স্লো ডাইজেশন, আয়রন সমৃদ্ধ খাদ্যতালিকা, অনেক সময় আয়রন সাপ্লিমেন্টেশন খাওয়ার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য লেগেই থাকে।
অন্যান্য শারীরিক অস্বস্তি
বাড়তে থাকা পেট মায়ের স্বাভাবিক হাঁটাচলা, কাত হয়ে ঘুমানো, স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। মাঝেমাঝে কোনো কারণ ছাড়াই মায়ের বুক ধড়ফড় করতে পারে। রাতে ঘুম না আসার মত সমস্যাও হতে পারে কোনো কোনো মায়ের। এ ছাড়াও ভেরিকোজ ভেইন বা ত্বকের নীচে স্পষ্ট হয়ে ওঠা শিরা, লো ব্যাক পেইন, হার্ট বার্ন বা বুক জ্বালার মত সমস্যা পুরো প্রেগনেন্সিতেই বজায় থাকতে পারে।
পঞ্চম মাসে মায়ের করণীয়
-
ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খেতে হবে। আগের চারটি মাসের মত এই মাসেও মায়ের শরীরের অতিরিক্ত পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। পাশাপাশি আয়রন ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্টেশন নেয়া যেতে পারে।
-
পাইলস বা অর্শ্ব গর্ভাবস্থায় মায়েদের খুবই কমন একটি সমস্যা। এর সাথে কোষ্ঠকাঠিন্য তো আছেই। এ সমস্যা এড়ানোর জন্য বেশি বেশি আঁশযুক্ত শাক সবজি খেতে হবে। আর কোনো অবস্থাতেই জাঙ্ক ফুড অর্থাৎ বাইরের ভাজা পোড়া তেল মশলাযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। অনেক সময় মায়েরা বিশেষ কোনো খাবার খাওয়ার জন্য অতিরিক্ত রকমের ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বার্গার, পিজ্জা, ফুচকা, চটপটি এইসব খাবার গর্ভকালীন সময়ে খুব লোভনীয় বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে ঘরেই মাকে এসব খাবার বানিয়ে দেয়া যেতে পারে।
-
এ সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকাটা খুবই জরুরি। আর এজন্য নিয়মিত গোসল করতে হবে। নখ, দাঁত পরিষ্কার রাখতে হবে।
-
গর্ভবতী মায়ের রাতে অন্তত সাত থেকে আট ঘন্টা ঘুমানো উচিত। এছাড়া দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর হালকা একটু বিশ্রাম করা উচিত। ঘুমানোর সময় চেষ্টা করবেন বাম কাত হয়ে শোবার। এতে প্লাসেন্টায় রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায় এবং শিশুর বৃদ্ধি ঠিকঠাক ভাবে হতে পারে।
-
মায়ের পোশাক নিয়ে এসময় আলাদা নজর দেবার দরকার পরে। যেহেতু দিন দিন মায়ের পেট বড় হতে থাকে, পুরোনো জামা কাপড় টাইটফিট হতে শুরু করে। অনেকে ঘরে বসে ম্যাক্সি জাতীয় লুজ ফিটিং পোশাক পরতে পছন্দ করেন। লেগ ইডেমা বা পা ফুলে ওঠার কারণে অনেকের পুরোনো ব্যবহার্য জুতাও টাইট হয়ে যেতে পারে। ফিজিওলজিক্যাল ইডেমা হলে তাতে ভয় পাবার কিছু নেই। বাচ্চা জন্মের পরে এই সমস্যা কেটে যায়।
-
একজন মায়ের জন্য গর্ভকালীন সময়ে সক্রিয় জীবন যাপন করাটা খুবই জরুরি। বাড়ির কিংবা অফিসের স্বাভাবিক কাজকর্ম, অল্প স্বল্প হাঁটাচলা, আশেপাশের সবার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, ইতিবাচক চিন্তা ভাবনা করা, বই পড়া, সিনেমা দেখা, মেডিটেশন এই সবকিছু মায়ের সুস্থ শরীর ও সতেজ মানসিক অবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
-
যেহেতু এসময় লেগ ক্র্যাম্প হতে পারে, তাই একটানা বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা এক নাগাড়ে কোনো কাজ করা উচিত নয়। দশ পনের মিনিট পর পর হাত পা নেড়ে নিজেকে সচল রাখতে হবে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
প্রতি মাসে আল্ট্রাসাউন্ড কিংবা রক্ত প্রস্রাব পরীক্ষা অত্যাবশ্যকীয় নয়। তবে মাসে অন্তত একবার ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। বাচ্চা ঠিকভাবে বেড়ে উঠসে কিনা, মায়ের ওজন ট্রাইমেস্টার অনুযায়ী ঠিকঠাকভাবে বাড়ছে কিনা, এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা কিংবা জেস্টেশনাল হাইপারটেনশন বা গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ আছে কিনা সেটা জানার জন্য মাসে একবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ভালো। প্রয়োজন অনুযায়ী ডাক্তার ল্যাব ইনভেস্টিগেশন করাতে পারেন তবে সব ঠিকঠাক থাকলে শুধুমাত্র ক্লিনিক্যাল পরীক্ষাই যথেষ্ট। অনেক সময় বাচ্চা কোনো জন্মগত শারীরিক মানসিক ত্রুটি নিয়ে জন্মাবে কিনা সেটা বোঝার জন্য এই সময়ে চিকিৎসক মাকে এনোমালি স্ক্যান করাতে দিতে পারেন।
পঞ্চম মাসে একজন হবু মা গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি একটা পর্যায়ে অবস্থান করেন। আর মাত্র চার মাস পরেই আপনার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে। ছোট্ট একটু ভুল, অল্প একটু অসতর্কতাও মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে। গর্ভবতী মা ও আশেপাশের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা একটি সুস্থ শিশু জন্ম নেবার প্রধান নিয়ামক। তাই সতর্ক থাকুন, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে দেয়া ওষুধপত্র ও নিয়ম কানুন মেনে চলুন, আর যেকোনো অসুবিধায় নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করুন।