গর্ভাবস্থার প্রথম মাস : মাতৃত্বের প্রথম স্বাদ
একজন নারীর গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলি সম্পর্কে কখনও খেয়াল করেছেন! এই সময়ে তার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, চিকিৎসা সংক্রান্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা এবং বিষণ্ণতা নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
-
আপনার শেষ মাসিকের পর থেকে তৃতীয় সপ্তাহে গিয়ে গর্ভাবস্থার প্রথম মাস শুরু হয়।
-
পাঁচ এবং ছয় সপ্তাহের মধ্যে, আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনি গর্ভবতী এবং শারীরিক উপসর্গেগুলি ক্রমশই বাড়তে থাকে।
-
গর্ভাবস্থার প্রথম মাসের সমস্যাগুলির মধ্যে রয়েছে অ্যাক্টোপিক গর্ভাবস্থা, গর্ভপাত এবং টেরাটোজেন।
-
আপনার গর্ভাবস্থায় আপনি যে পরিবর্তনগুলির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মেজাজ পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক।
একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য প্রতিটি দিন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভের সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য এসময় গর্ভবতী মাকে নানা রকম নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। ঠিক মতো নিজের যত্ন নেওয়া, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা এন্টিনেটাল চেক আপ (ANC) করানো, সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এসব দিকে বিশেষ নজর রাখতে হয়।
প্রথম দিকে গর্ভস্থ ভ্রূণ একগুচ্ছ কোষ হিসেবে থাকে। পরবর্তীতে তা থেকে বিভিন্ন অঙ্গতন্ত্রে সজ্জিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষের আকৃতি ধারণ করে। তাই গর্ভাবস্থার প্রথম কয়েক মাস মা ও শিশু উভয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। আসুন তাহলে গর্ভাবস্থার প্রথম মাসের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন তথা লক্ষণ ও উপসর্গ, প্রয়োজনীয় সতর্কতা, যত্ন ও পরিচর্যা এসব নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেই।
ফার্টিলাইজেশন প্রক্রিয়া
স্বামী-স্ত্রীর মিলনের পর স্বামীর শুক্রাণু ও স্ত্রীর ডিম্বাণুর মধ্যে ফিউশন প্রক্রিয়াকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় ফার্টিলাইজেশন বা নিষেক প্রক্রিয়া। আর এই ফার্টিলাইজেশন প্রক্রিয়াটি সংগঠিত হয়ে থাকে স্ত্রীর শরীরে। ফার্টিলাইজেশন প্রক্রিয়াটি প্রথমে ডিম্বনালীতে সম্পন্ন হয়। এরপর শুক্রাণু কর্তৃক নিষিক্ত ডিম্বাণু ফেলোপিয়ান টিউব বা ডিম্বনালী হয়ে ইউটেরাস বা গর্ভাশয়ে আসে এবং ইমপ্ল্যান্টেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় হালকা রক্তপাত হতে পারে, একে বলে 'ইমপ্ল্যান্টেশন ব্লিডিং'।
এর পর থেকে গর্ভবতী মায়ের শরীরে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে।
প্রথম মাসের লক্ষণ ও উপসর্গ
গর্ভবতী মায়ের শরীরে এ সময় হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন বা এইচসিজি (hCG) নামক হরমোনের আধিক্য দেখা যায় এবং এই হরমোনের প্রভাবে মায়ের শারীরিক ও মানসিক বেশকিছু লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন -
পিরিয়ড না হওয়া
গর্ভাবস্থাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এর একেকটি ভাগকে বলে ট্রাইমেস্টার। প্রথম বারো সপ্তাহ ফার্স্ট ট্রাইমেস্টারের অন্তর্ভুক্ত।
অনেক গর্ভবতী মা প্রথম মাসে বুঝতেই পারেন না যে তিনি গর্ভবতী। বিশেষ করে আমাদের দেশে অধিকাংশ মায়েরই নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতনতার অভাব দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে মেন্সট্রুয়াল সাইকেল রেগুলার এমন বেশির ভাগ মায়েদের ক্ষেত্রে প্রেগনেন্সির প্রথম লক্ষণ হতে পারে পিরিয়ড না হওয়া। পিরিয়ড বা মাসিক না হওয়া মানেই আপনি গর্ভবতী বিষয়টা এমন নয় তবে হঠাৎ মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে অথবা মাসিক হতে দেরি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।
মর্নিং সিকনেস
প্রথমদিকের লক্ষণ গুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি লক্ষণ হচ্ছে মর্নিং সিকনেস। শতকরা ৫০ শতাংশ গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে এই লক্ষণ দেখা যায়। হালকা বমি বমি ভাব, খাবারে অনীহা, ক্ষুধামান্দ্য, মাথা ঘুরানো এগুলোকে একসঙ্গে মর্নিং সিকনেস বলা হয়। এই সমস্যা দিনের যেকোনো সময় হতে পারে তবে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বেশি হয়।
মুড সুইং
যদিও বেশির ভাগ মহিলাই প্রথম দিকে মা হওয়ার আনন্দ ও উত্তেজনায় অন্য কোনোদিকে নজর দেবার সময় পান না, তবে কোনো কোনো মায়ের কিন্তু এসময় প্রচন্ড মুড সুইং হতে দেখা যায়। এসময় শরীরে বিভিন্ন হরমোন লেভেলের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে, তার ফলে মায়ের মন মেজাজেরও বারংবার বদল ঘটতে থাকে। এই মুহূর্তে হয়ত খুব উৎফুল্ল ভাব, পর মুহূর্তেই দেখা গেল হতাশ বিষণ্ণ চেহারা।
খাবারের রুচির পরিবর্তন
পুরোনো দিনের সিনেমায় আচার খাওয়া কিংবা টকজাতীয় ফল খাওয়াকে গর্ভবতী হবার লক্ষণ হিসেবে দেখানো হতো। বিষয়টা পুরোপুরি ভিত্তিহীন নয়। অনেক মায়েরই এসময় সাধারণ খাবারে অনীহা জন্মে। এবং তা থেকে বিশেষ কোনো খাবারের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি তৈরি হতে পারে। আবার বিশেষ কোনো খাবারের গন্ধ, বিশেষ কোনো ফ্লেভারের প্রতি তীব্র অনিচ্ছাও দেখা যায় কারো কারো ক্ষেত্রে।
এছাড়াও আরো কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে-
-
বারবার প্রস্রাব হওয়া
-
স্তনে অস্বস্তি বা হালকা ব্যথা অনুভূত হওয়া
-
স্তন স্ফীত হয়ে যাওয়া
-
মুখে মেটালিক টেস্ট
-
ক্লান্ত ভাব
-
কোষ্ঠকাঠিন্য
সকলের সব উপসর্গ থাকবে এমন নয়, এর মধ্যে কয়েকটা লক্ষণ দেখা দিলে ঘরে বসেই প্রেগনেন্সি কিট দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। আজকাল বাজারে নানা রকম প্রেগনেন্সি কিট কিনতে পাওয়া যায়। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সম্ভব হলে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী আলট্রাসাউন্ড সহ অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হবে।
সমস্যা ও সতর্কতা
গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই গর্ভবতী মায়ের নানাবিধ সমস্যার দিকে নজর রাখতে হবে। প্রথম মাসের সমস্যাগুলির মধ্যে একটোপিক প্রেগনেন্সি, মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত অন্যতম। এছাড়াও এসময়ে বাচ্চার টেরাটোজেনজনিত সমস্যা হতে পারে। তাই সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
এক্টোপিক প্রেগনেন্সি
প্রথম দিকের সমস্যাগুলির মধ্যে এক্টোপিক প্রেগনেন্সি অন্যতম। নিষিক্ত ডিম্বাণু সাধারণত ইউটেরাসে প্রতিস্থাপিত হয়। এর বাইরে অন্য কোথাও প্রতিস্থাপিত হলে তাকে এক্টোপিক প্রেগনেন্সি বলে। ডিম্বাণু গর্ভাশয়ের বদলে ডিম্বনালীতে প্রতিস্থাপিত হলে, ধীরে ধীরে তা আকারে বড় হয় এবং এক পর্যায়ে নালী ফেটে গিয়ে ইন্টারনাল ব্লিডিং হয় এবং প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়। শুরুতেই চিহ্নিত করা গেলে মেডিকেশনের মাধ্যমে গর্ভপাত করানো সম্ভব হয়। নতুবা সার্জারিই এক্ষেত্রে একমাত্র উপায়। অনেক সময় ডিম্বনালী ফেটে গেলে তা পুনরূদ্ধার করা সম্ভব হয় না। তখন ডিম্বনালী কেটে ফেলে দিতে হয়। এ থেকে পরবর্তীতে বন্ধ্যাত্ব অর্থাৎ সন্তান ধারণে অক্ষমতা দেখা দিতে পারে।
গর্ভপাত
মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের সম্ভাবনা প্রথম ট্রাইমেস্টারে সবথেকে বেশি থাকে। গর্ভাবস্থার প্রথমদিকে নানা কারণে গর্ভপাত হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি যে কারণে গর্ভপাত ঘটে তা হল ভ্রূণের ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা। এছাড়াও হরমোনের গরমিল এবং ইউটেরাসের অস্বাভাবিক গঠনের কারণেও গর্ভপাত হতে পারে।
টেরাটোজেন
টেরাটোজেন বলতে নানা রকম সংক্রমণ, ভাইরাল ইনফেকশন, এলকোহল, ধূমপান, কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ওষুধ সেবনকে বুঝায় যার ফলে অনাগত সন্তানের জন্মগত কোনো ত্রুটি হতে পারে। গর্ভধারণ সফল হলেই সুস্থ স্বাভাবিক শিশুর জন্ম হবে এমনটা নাও হতে পারে। গর্ভস্থ ভ্রূণ কোন পরিবেশে কি অবস্থায় বেড়ে উঠছে সেটাও সমান গুরুত্বের সঙ্গে নজরে রাখতে হবে। বাচ্চার শারীরিক গঠনের জন্য প্রথম তিন মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের সকল অর্গান সিস্টেম এ সময়ে তৈরি হয়। তাই এসব ক্ষতিকর টেরাটোজেন থেকে প্রথম কয়েক মাস মাকে যথাসাধ্য দূরে রাখতে হবে যেন বাচ্চার শরীরে গঠনগত কোনো ত্রুটি কিংবা অঙ্গবিকৃতি না হয়। এজন্য গর্ভাবস্থায় যেকোনো ওষুধ সেবন করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
যেসব বাবা মা ধূমপায়ী কিংবা মদ্যপায়ী, তাদের এসময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। প্যাসিভ স্মোকিং গর্ভের সন্তানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব বাবা মায়েরা ধূমপান করেন, তাদের সন্তান লো বার্থ ওয়েট (LBW) বা অস্বাভাবিক কম ওজন নিয়ে জন্মায়। এসব বাচ্চাদের ঠোঁট কাটা, তালু কাটা ইত্যাদি অস্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে৷ গর্ভবতী মায়ের মদ্যপানের ফলে বাচ্চা জন্মের পর ফিটাল এলকোহল সিনড্রোম বা এফএএস (FAS) নামক রোগে আক্রান্ত হতে পারে৷
প্রি পারটাম ডিপ্রেশন বা গর্ভবতী মায়ের বিষন্নতা জনিত সমস্যা
আগেই বলেছি, অনেক মা এসময় বিষণ্ণতা বা মেজর ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন। যদিও আমাদের দেশে গর্ভবতী মায়ের বিষণ্ণতা একটি উপেক্ষিত বিষয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪ থেকে ১২ শতাংশ মা গর্ভাবস্থায় ডিপ্রেশনে ভোগেন। এই মায়েদের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হল -
-
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা
-
হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই কান্না করা কিংবা সামান্য কারণে অস্থির হয়ে যাওয়া
-
সব সময় মনমরা থাকা
-
আগের চেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ এবং সংবেদনশীল আচরণ
-
ঠিকমতো ঘুম না হওয়া
-
স্বাভাবিক যৌনমিলনে অনিচ্ছা
এসব লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে একজন সার্টিফায়েড মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দারস্থ হতে হবে।
প্রথম মাসে মায়ের যত্ন
-
গর্ভধারণের বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর মাকে নিয়মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে৷
-
তিনবেলা পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। সবুজ শাকসব্জি, রঙিন ফল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে।
-
আঁশজাতীয় খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে। তাই খাদ্যতালিকায় আঁশজাতীয় খাবার রাখতে চেষ্টা করুন।
-
প্রচুর পানি এবং তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। বার বার প্রস্রাব হওয়ার দরুন অনেকেই পানি খাওয়া কমিয়ে দেন। ভুলেও এই কাজ করবেন না।
-
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভ্রমণ করা যাবে তবে উঁচু নিচু রাস্তা, দূরপাল্লার ভ্রমণ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত।
-
নিয়মিত ব্যায়াম করতে পারেন। তবে ভারী জিনিসপত্র তোলা যাবে না।
-
রোজ অন্তত ৭-৮ ঘন্টা ঘুমাতে চেষ্টা করুন। গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷
মায়ের অনেক কষ্ট, অনেক ত্যাগের ফলে একটি শিশু পৃথিবীর আলোর মুখ দেখতে পায়। একটু খানি অসতর্কতা, সামান্য কোনো ভুলে এই কষ্ট যেন বৃথা না যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আর এই লক্ষ রাখার দায়িত্ব শুধু মায়ের একার নয়, পরিবারের সবার৷